ফেনী জেলার জনপ্রিয় খাবারের তালিকা

বাঙালির খাওয়া দাওয়া নিয়ে শখ আহ্লাদ সেই প্রাচীন কাল থেকেই। আত্নীয় বাড়ি বেড়াতে গেলে পেট পুরে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হলেই যেন আর কিছু চাই না। মন ভালো নেই তো পছন্দের খাবার খাও, মনে সবার আনন্দ তাও খাওয়া দাওয়ার ধুম শুরু, উৎসব অনুষ্ঠানে তো কোনো কথাই নেই। এলাকা ভেদে খাওয়া দাওয়ায় আছো নানা বৈচিত্র্য। তাইতো পর্যটকেরা বেড়াতে আসলে তাদের মূল আকর্ষণ থাকে বাঙালির বৈচিত্র্যময় খাওয়া দাওয়ার ওপর।চলুন আজ জেনে নেয়া যাক বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ফেনী জেলার জনপ্রিয় খাবার সম্পর্কে।

১. খন্ডলের মিষ্টি

ফেনী জেলার মিষ্টান্ন জাতীয় খাবারের মধ্যে সবথেকে ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার খন্ডলের মিষ্টি। খন্ডলের মিষ্টির ইতিহাস ৫০ বছরের পুরোনো। ফেনী জেলার খন্ডল নামক স্থানে এই মিষ্টি তৈরির প্রচলন শুরু হয়েছিল, আর উৎপত্তি স্থলের নামানুসারে এই মিষ্টির নামকরণ করা হয়েছে।

খন্ডলের মিষ্টি তৈরি করা হয় খাঁটি গরুর দুধের ছানা, ময়দা ও চিনির সিরা দিয়ে। দুধ থেকে ছানা তৈরি করে প্রথমে পানি ঝড়িয়ে নেয়া হয়। ছানাকে ঘন ও শক্ত করার জন্য মেশানো হয় সামান্য ময়দা। ময়দা ও ছানার মিশ্রন দিয়ে মন্ড তৈরি করে তা থেকে ছোট ছোট মিষ্টি বানানো হয়। মিষ্টি তেলে ভেজে চিনির সিরায় ডুবিয়ে রেখে তৈরি করা হয় সুস্বাদু খন্ডলের মিষ্টি।

সব মিষ্টিই সাধারণত ঠান্ডা করে খাওয়া হয় কিন্তু খন্ডলের মিষ্টি গরম গরম খেতেই বেশি ভালো লাগে – আর এটাই খন্ডলের মিষ্টির বিশেষত্ব।

২. মহিষের দুধের ঘি

গরুর দুধের পাশাপাশি মহিষের দুধের ঘি তৈরি করা হয় এটা কম বেশি সবাই-ই জানি। ফেনি জেলায় বানিজ্যিক ভাবে মহিষের দুধের ঘি তৈরি করা হয়। মহিষের দুধে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল না থাকায় এই ঘি-এ কোনো ধরনের ক্ষতি হয় না। মহিষের দুধ সংগ্রহ করে উচ্চ তাপমাত্রায় জ্বাল করে দুধ থেকে ঘি আলাদা করা হয়। সেই ঘি প্যাকেটজাত করে বাংলাদেশের সব জেলায় বাজারজাত করা হয়।

ফেনি জেলায় ঘুরতে বা বেড়াতে আসলে অনেকেই মহিষের দুধের ঘি কিনে নিয়ে যায়। এর উপকারিতা ও পুষ্টিগুণের জন্য মহিষের দুধের ঘি এতো বেশি জনপ্রিয়।

৩. শুটকি ভুনা

ফেনি জেলার সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাবার তালিকার সব থেকে প্রিয় খাদ্য শুটকি ভুনা। এই জেলায় বিভিন্ন ধরনের শুটকি খাওয়ার প্রচলন আছে। চ্যাপা, লইট্যা, ফাইস্যা, চিংড়ি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দুপুরে গরম গরম ভাতের সাথে শুটকি ভুনা থাকলে আর কি চাই।
ফেনি জেলার মানুষ শুটকি ভুনায় শুধু পেয়াজ ও রসুন ব্যবহার করে। শুটকি ভালোভাবে ধুয়ে পছন্দমতো সাইজে কেটে নেয়া হয়। বেশি করে পেয়াজ, কাঁচা মরিচ ও রসুন কেটে তেলে ভেজে তার মধ্যে শুটকি দিয়ে ভুনা করা হয়। সকালে বা দুপুরের খাবারে শুটকি ভুনা এই জেলার সাধারণ একটি খাবার।

৪. কাটা বেগুন

সব জেলাতেই বেগুন সাধারণ একটা সবজি। এই বেগুন দিয়ে রান্না করা যায় নানা বৈচিত্র্যের তরকারি। ফেনি জেলায় বেগুনের তরকারিকে বলা হয় কাটা বেগুন। বেগুন চাক চাক করে কেটে তার সাথে অন্যান্য সবজি মিক্স করে রান্না করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নাম রয়েছে এই তরকারির। সাধারণত গরম ভাতের সাথে কাটা বেগুন এর তরকারি খাওয়া হয়। তবে সকালের নাশতায় রুটি, পরোটার সাথেও কাটা বেগুন খাওয়ার প্রচলন আছে।

৫. রূপচাঁদা মাছ

ফেনী জেলার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে সুপরিচিত ফেনী নদী। এই নদীতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু মাছ। এসব মাছের মধ্যে রূপচাঁদা মাছ বেশ জনপ্রিয় ও সুস্বাদু। ফেনি বেড়াতে গেলে অতিথি আপ্যায়নে স্পেশাল পদ হিসেবে থাকে রূপচাঁদা মাছ। ফেনী শহরের বেশ কিছু হোটেলেও স্পেশাল আইটেম হিসেবে পাওয়া যায় সুস্বাদু এই মাছ।

রূপচাঁদা মাছ বিভিন্ন পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। তবে রূপচাঁদা মাছ ভাজা খেতে সবথেকে বেশি সুস্বাদু। মাছ কেটে ভালোভাবে ধুয়ে মসলা মাখিয়ে ডুবো তেলে মচমচে করে ভাজা হয়। গরম গরম ভাতের সাথে রূপচাঁদা মাছ খেতে বেশ মজার। রূপচাঁদা মাছ ভুনাও কিন্তু বেশ মজার হয়।

৬. পানতুয়া পিঠা

শীতকালে যখন ফেনী জেলার ঘরে ঘরে পিঠা পুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়, তখন সবথেকে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পানতুয়া পিঠা। বিকেলের নাশতায় হালকা খাবার হিসেবেও এই পিঠা তৈরি করা হয়। খুব সাধারণ উপকরণে ঝামেলা ছাড়াই বানানো যায় বলে হুটহাট বাড়িতে মেহমান চলে আসলে নাশতা হিসেবেও এই খাবারটি বানিয়ে পরিবেশন করা হয়।

পানতুয়া পিঠা বানাতে ব্যবহার করা হয় ডিম, ময়দা, চিনি ও সামান্য তেল। ডিম, চিনি ও ময়দা দিয়ে পাতলা গোলা তৈরি করে রাখা হয়। করাইয়ে ডিম পোচ করে আলাদা করে তুলে রাখা হয়। চ্যাপ্টা কড়াইয়ে গোলা দিয়ে পাতলা করে ভেজে তার উপরে পোচ করা ডিম দিয়ে পেচিয়ে নেয়া হয়।

 এভাবে কয়েকবার গোলা দিয়ে ভেজে পেচিয়ে পেচিয়ে মোটা করে নিয়ে কড়াই থেকে নামানো হয়। পাতলা করে পিস পিস কেটে পরিবেশন করা হয় মজাদার পানতোয়া পিঠা। অনেকে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করে পিঠায় ফুটিয়ে তোলে বাহারি নকশা। দেখতেও লাগে যেমন সুন্দর খেতেও ঠিক তেমনই মজা।

৭. খোলাজা পিঠা

ফেনী ও নোয়াখালী জেলার খুবই জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী পিঠা ‘খোলাজা পিঠা’। এটা চিতই পিঠারই একটু ভিন্নধর্মী ফিউশন। চালের গুঁড়ো, লবন ও পানি দিয়ে একটু ঘন গোলা তৈরি করে রেখে দেয়া হয় কিছুক্ষণের জন্য। তারপর মাটির খোলায় পাতলা করে দিয়ে ভেজে নেয়া হয় পিঠা। ভেতরটা কিছুটা ছিদ্র ছিদ্র এবং আকৃতি হয় রুটির মতো। খোলাজা পিঠা সাধারণত হাঁসের মাংস দিয়ে খাওয়া হয়। তবে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, মুরগির মাংস বা গরুর মাংস দিয়েও খেতে দারুণ মজার। শীতের সময় সকালের নাশতা হিসেবে বেশিরভাগ বাড়িতেই এই পিঠা তৈরি করা হয়।

৮. খিলি পিঠা

ফেনী জেলার আরও একটি মজাদার ও জনপ্রিয় পিঠা হলো খিলি পিঠা। কাঁঠাল পাতায় মুড়িয়ে বানানো হয় বলে দেখতে অনেকটা পানের খিলির মতো হয় বলে এই পিঠার নামকরণ করা হয়েছে খিলি পিঠা। তাল দিয়ে তৈরি করা হয় বলে একে অনেকে তালের খিলি-ও বলে।

একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো, সুজি, বেকিং পাউডার, চিনি ও তালের কাথ মিশিয়ে খামির তৈরি করা হয়। সেই খামির বেশ কিছুক্ষণ রেখে দেয়া হয়। তারপর কাঁঠাল পাতা দিয়ে টুথপিক এর সাহায্যে পানের খিলির মতো তৈরি করে তার মধ্যে খামির ভরে ভাপে সিদ্ধ করা হয়। ভাপে দেয়ার আগে উপর থেকে ছড়িয়ে দেয়া হয় নারকেল কোড়া। ভাপ থেকে নামিয়ে পাতা ছাড়িয়ে ধোয়া ওঠা খিলি পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা।

৯. লেবুর কাজী

ফেনী সহ চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বেশ জনপ্রিয় খাবার লেবুর কাজী। একে অনেকে লেবু রসুনের টকও বলে থাকে। প্রচন্ড গরমে যখন অতিষ্ঠ জনজীবন তখন দুপুরের খাবারে প্রথম পাতে ভাতের সাথে লেবুর কাজী যেন নিয়ে আসে প্রশান্তির ছোয়া।
চেবু চিপে রস বের করে তার সাথে কাঁচা মরিচ কুচি, রসুন কুচি সরিষার তেল ও পানি মিশিয়ে বানানো হয় লেবুর কাজি। দুপুরের খাবারে তরকারি খাওয়ার আগে লেবুর কাজী দিয়ে কিছুটা ভাত খাওয়া হয়। লেবুর টক ও রসুনের ঝাঁঝালো স্বাদে একদমই অন্যরকম স্বাদের সৃষ্টি হয়।

১০. তেল ছাড়া শুঁটকির তরকারি

ফেনী জেলার সাধারণ মানুষের প্রিয় খাবার তেল ছাড়া শুঁটকির তরকারি। শুধু ফেনীতেই নয় বাংলাদেশের অনেক জেলাতেই এই রান্নাটির প্রচলন রয়েছে। কয়েক ধরনের সবজি একসাথে কেটে ধুয়ে একটি হাড়িতে নেয়া হয়। তার মধ্যে ধুয়ে রাখা শুঁটকি, কাঁচা মরিচ ও অন্যান্য মসলা একসাথে দিয়ে জ্বাল করা হয়। সবজি সিদ্ধ হলে চুলা থেকে নামিয়ে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়। তেলছাড়া রান্না হলেও খেতে একদমই দারুন এবং স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো।

খাদ্য সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যের ছোয়া রয়েছে আমাদের দেশের প্রতিটি জেলাতেই। নিজস্ব অথেনটিক স্বাদের রন্ধন প্রনালীর জন্য ফেনী জেলার মতো প্রতিটি জেলাই আলাদা আলাদা ভাবে নিজের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।

Scroll to Top