কক্সবাজারের একটি জনপ্রিয় ও উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পট হলো হিমছড়ি। কক্সবাজার গিয়ে একটা দিন হিমছড়ি স্পটে কাটিয়ে না আসলে পুরো ট্যুর-টাই একদম বৃথা হয়ে যাবে। কেননা হিমছড়িতে একই সাথে পাহাড়, সমুদ্র আর পাহাড়ি ঝর্ণার এক অনবদ্য সৌন্দর্য একসাথে উপভোগ করতে পারবেন।
প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্যের সকল দুয়ার খুলে দিয়েছে হিমছড়িতে এসে। কক্সবাজার থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে হিমছড়ি অবস্থিত। তাই চাইলেই হাতে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা সময় নিয়ে সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
পাহাড় চূড়া থেকে সাগরের উত্তাল পরিবেশের ভিউ, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য, ঝাউবন সব মিলিয়ে এক মায়াময় পরিবেশে কাটাতে পারবেন জীবনের কিছুটা সময়। সৌন্দর্য পিপাসুদের যেন প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে যায় প্রকৃতির এই অপার বিষ্ময়। আর বর্ষায় তো হিমছড়ির সম্মিলিত সৌন্দর্য আরও কয়েক গুন পর্যন্ত বেড়ে যায়।
হিমছড়ি কীভাবে যাবেন?
হিমছড়ি যেতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে। ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন বা প্লেনে সরাসরি কক্সবাজার যেতে পারবেন। ঢাকার সায়দাবাদ, গুলিস্তান থেকে নিয়মিত কক্সবাজারের উদ্যেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেন যোগে সরাসরি কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনে পৌঁছাতে পারবেন।
অথবা বাজেট একটু বেশি থাকলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আকাশপথে কক্সবাজার যেতে পারবেন।
কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি, ইজিবাইক কিংবা খোলা জিপ পাবেন। সিএনজি বা অটো রিজার্ভ করে গেলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে যেতে পারবেন। সংখ্যায় ১০ জন বা তার বেশি হলে খোলা জিপ ভাড়া করে যেতে পারবেন। ভাড়া পড়বে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা।
হিমছড়ির দর্শনীয় স্থানের তালিকা
হিমছড়ি কেন যাবেন তা জানতে না চেয়ে বলতে পারেন হিমছড়ি কেন যাবেন না। প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই জীবনে একবার হলেও হিমছড়ি যেতে হবে। মূলত হিমছড়ি ইকোপার্ক কে কেন্দ্র করে হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। ইকোপার্কে প্রবেশ করতে ২০ টাকা মূল্যে টিকেট কাটতে হবে। হিমছড়ি পর্যটন এলাকার মূল আকর্ষণ গুলো এখানে ধারাবাহিক ভাবে উল্লেখ করা হলো।
১. মেরিন ড্রাইভ সড়ক
হিমছড়ি পৌছানোর পরেই যে আপনি প্রকৃতির সন্নিকটে যেতে পারবেন এমনটা কিন্তু না। কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি যাওয়ার পুরো পথটাই মূলত রোমাঞ্চকর একটি এডভেঞ্চার হবে। কক্সবাজার টু হিমছড়ি মেরিন ড্রাইভ সড়ক আপনাকে মুগ্ধ না করে পারবে না।
এই পথের এক পাশে সুউচ্চ পাহাড় আর অন্যপাশে বঙ্গোপসাগরের তীর। গাড়িতে যেতে যেতে দেখতে পাবেন সাগরের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালুকাময় সমুদ্রতীরে। রাস্তার দুই ধারে গাছের সারি, পাখির কিচিরমিচির, সমুদ্রের গর্জন আর পাহাড়ের গাম্ভীর্যতা আপনাকে কল্পনার জগতে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ পুরোটা পথ আপনাকে একটা লাক্সারিয়াস ট্রিপ এর অনুভূতি দেবে।
২. হিমছড়ি পাহাড়
হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্রের মূল আকর্ষণ হলো হিমছড়ি পাহাড়। হিমছড়ি পয়েন্টে প্রবেশ করলে পাহাড়ের পাদদেশে দেখতে পাবেন একটি সিড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে। সিড়ি বেয়ে একদম পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারবেন। তবে পাহাড় চূড়ায় পৌঁছাতে হলে আপনাকে অনেক ধাপ সিড়ি অতিক্রম করতে হবে।
সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা যেমন কষ্টকর তেমনই আবার আনন্দদায়ক। কেননা চলার পথে পাহাড়ি পরিবেশ খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে পারবেন। আর হিমছড়ির মূল আকর্ষণ পাহাড়ের চূড়ায়। এটাই মূলত হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। পাহাড় চূড়ায় দাড়িয়ে সমুদ্রের একটি চমৎকার ভিউ উপভোগ করতে পারবেন।
সবথেকে ভালো হয় দুপুরের পরে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতে। তাহলে হিমছড়ি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের এক অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। মনে হবে সাগরের অতল জলরাশির মধ্যে সূর্যটি ডুবে যাচ্ছে। এমন একটা দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করার জন্য হাজারো পর্যটক অপেক্ষায় বসে থাকেন।
৩. হিমছড়ি ঝর্ণা
একই ট্রিপে পাহাড়, ঝর্ণা, সমুদ্র সবকিছু! ব্যাপারটা আসলেই খুব ইন্টারেস্টিং। হিমছড়ি পয়েন্টে পৌঁছালেই দেখতে পাবেন মানুষ দলবেঁধে ঝর্ণার দিকে ছুটছে। ঝর্নার সঠিক পথ বাতলে দেয়ার জন্য অনেক সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন। নির্দেশনে অনুযায়ী কিছুটা পথ হাটলেই চোখে পড়বে স্বচ্ছ পানির শীতল ঝর্ণাধারা।
পাহাড়ের খাদ বেয়ে বিরতিহীনভাবে জলধারা নেমে তা মিলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে। এ যেন এক মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির চাক্ষুষ প্রমান। ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে ফটোশুট করতে না পারলে তো ভ্রমণের আসল মজাই পাবেন না। তাই ঝর্ণার তলদেশের জলরাশি মাড়িয়ে চলে যেতে পারেন ঝর্ণার একেবারে পাশে। বর্ষার সময় হিমছড়ি ঝর্ণার গর্জন যেন একরকম দাপটে পরিনত হয়।
৪. সমুদ্র সৈকত
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে একটু অন্যভাবে চিনতে পারবেন হিমছড়ি গিয়ে। মেরিন ড্রাইভের পুরোটা পথ জুড়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সান্নিধ্য পাবেন। আর হিমছড়ি পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে একপাশে দেখতে পাবেন সবুজে ঘেরা পাহাড়ি পরিবেশ আর অন্যপাশে নিরব নিস্তব্ধ ও কোলাহল মুক্ত সমুদ্র সৈকত।
মন চাইবে সাগরের এই তীরে দাঁড়িয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেই। আর কোনো ভাবে হিমছড়ি পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারলে তো সমুদ্র সৈকতের আরও নতুন নতুন ভিউ উপভোগ করতে পারবেন। তখন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে আপনার কাছে একটি ছবির জগৎ বলে মনে হবে। আর এই বিশাল জলরাশির শেষ প্রান্ত যে কোথায় তা খুঁজে পাবেন না বলে মনে হবে দূরের দিগন্তের সাথে সাগরের সখ্যতা হয়ে গেছে।
৫. বার্মিজ মার্কেট
হিমছড়ি পয়েন্ট পৌঁছেই সবার আগে চোখে পড়বে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বার্মিজ মার্কেট। এখানে পাহাড়ি উপজাতিদের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনাবেচা করা হয়। এখান থেকে শামুকের তৈরি বিভিন্ন গহনা ও শো-পিস কিনতে পারবেন। আরও পাবেন হরেক রকমের বার্মিজ আচার।
আর কক্সবাজারের আচার তো পুরো বাংলাদেশে জনপ্রিয়। আরও পাবেন তাতের পোশাকের দোকান, প্রসাধনী সামগ্রীর দোকান, জুতা, বাদাম, চকোলেট সহ বিভিন্ন রকম জিনিসপত্র। তবে সবথেকে বেশি নজড় কাড়বে পাহাড়ি ফলের দোকানগুলো। রং বেরঙের ফলের পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন দোকানীরা। কচি পেয়ারা, পাকা পেঁপে, বুনো বাদাম, কলা, আনারস, বড়ই সহ অনেক ধরনের তাজা ফল কিনতে পারবেন হিমছড়ি থেকে।
৬. পাহাড়ের সবুজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য
হিমছড়ি পাহাড়ের পুরোটা জুড়েই সবুজ প্রকৃতি বেষ্টিত। পাহাড় চুড়া থেকে সমুদ্রের ভিউ উপভোগ করার সময় চোখে পড়বে সবুজের সমারোহে আবৃত ঝাউবন। আছে হাজারো পাহাড়ি গাছপালা। আর পাহাড়ের গাছে গাছে আছে কয়েকশো প্রজাতির পাখি। পাখির কলকাকলি আর পাহাড়ি বুনো গাছের ছায়ায় ঘেরা পরিবেশে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্য কক্সবাজারে বসে হবে না।
এজন্য আপনাকে কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি চলে যেতে হবে। পাহাড়ি বনের ভেতরের দিকে চলে গেলে দেখা মিলতে পারে বুনো হাতি, হরিণ কিংবা বানরের। এরা পাহাড়ি বনে অবাধে চলাফেরা করে। বণ্য পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে এসব প্রাণী দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। তাইতো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখার পাশাপাশি প্রায় বেশিরভাগ পর্যটক ছুটে চলে আসে হিমছড়ি।
কোথায় থাকবেন? হিমছড়িতে থাকার হোটেল রিসোর্ট
কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি গিয়ে এক বেলার মধ্যেই ঘুরেফিরে আবার কক্সবাজার ফিরে আসতে পারবেন। তাই হিমছড়িতে থাকার কোনো প্রয়োজন পড়বে না। আর কক্সবাজারের সাধারণ থেকে লাক্সারিয়াস মানের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। চাইলে কক্সবাজারের বিভিন্ন রিসোর্টেও রুম ভাড়া করে থাকতে পারবেন।
খাওয়ার ব্যবস্থা
যেহেতু হিমছড়ি গিয়ে কয়েকঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসতে পারবেন তাই কক্সবাজার থেকে খাওয়ার ঝামেলা শেষ করাই ভালো৷ তবে পাহাড় চূড়ায় উঠলে অনেকটা ক্যালরি বার্ন হবে তাই সাথে কিছু শুকনো খাবার ও মিনারেল ওয়াটার রাখতে পারেন। তাছাড়া বার্মিজ মার্কেট থেকে চকোলেট, বাদাম ও বিভিন্ন প্রকার ফল কিনে খেতে পারবেন।
হিমছড়ি সম্পর্কে এতো রোমাঞ্চকর তথ্য জানার পরেও কীভাবে হিমছড়ি ভ্রমণ প্লান না করে থাকতে পারবেন? আপনার পরবর্তী কক্সবাজার ট্যুর প্লানে অবশ্যই হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্র সবার আগে প্রাধান্য বলে আশাকরি। ধন্যবাদ।
ছবি ক্রেডিটঃ Tareq Ahmed