বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত জেলা সিলেট,যা কিনা বাংলার একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জেলাকে বলা হয় দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও বিশ্বের দ্বিতীয় লন্ডন। বাংলা অঞ্চলের প্রাচীন জনপদ হওয়ার ফলে এই অঞ্চলের সংস্কৃতিও বেশ পুরোনো। তারই ধারাবাহিকতায় সিলেটের স্থানীয় লোকজন বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত। সিলেট অঞ্চলের সংস্কৃতির একাংশ জুড়ে রয়েছে এখানকার খাদ্যাভ্যাস।চলুন সিলেট জেলার কিছু ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার সম্পর্কে জেনে আসি।
১.সাতকড়া
সিলেটের সাতকড়ার নাম শোনেননি এমন লোক খুব কমই আছে।সাতকড়া নামটা শুনলেই প্রথমে সিলেট জেলার নাম মনে ভেসে ওঠে।স্থানীয় ভাষায় সাতকড়াকে ” হাতকরা” বলা হয়।
সাতকড়া একটি লেবু জাতীয় ফল যা সাধারণত গরুর মাংসের সাথে রান্না করা হয়।বানিজ্যিক ভাবে সিলেটে সাতকড়া উৎপাদন করা হয় এবং প্রতি বছর প্রচুর পরিমানে সাতকড়া বিদেশে রপ্তানি হয়।বর্তমানে সাতকড়া কে সিলেট জেলার জি আই পণ্যের ট্যাগ দেয়ার জন্য ডকুমেন্টেশনের কাজ চলছে।বিদেশে রপ্তানিকৃত সাতকড়া দিয়ে খুব দামি পারফিউম তৈরি করা হয়।সিলেট অঞ্চলের মানুষ সাতকরা দিয়ে বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে পরিবেশন করে।যেমন:
১. গরুর মাংসের সাথে সাতকড়া
২. সাতকড়া দিয়ে ছোট মাছের চচ্চরি
৩. সাতকড়ার আচার ( ইত্যাদি)
২.আখনি বিরিয়ানি
সিলেটিদের ইফতারিতে আখনি একটা বহুল প্রচলিত খাবার।বিশেষ করে ইফতারিতে যদি কোনো অতিথি থাকে তাহলে আয়োজনে আখনি থাকবেই। সব অঞ্চলের মানুষের যেমন ছোলা মুড়ি ছাড়া ইফতারি পরিপূর্ণ হয় না,ঠিক তেমনই সিলেটি দের আখনি বিরিয়ানি ছাড়া ইফতারি পরিপূর্ণ হয় না। আখনি বিরিয়ানি সিলেটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে।সিলেট ছাড়া রংপুর ও জামালপুরেও এই খাবারটি খুব জনপ্রিয়।
প্রস্তুত প্রনালী :
একটি হাড়িতে দই ও পোলাওয়ের চাল দিয়ে পোলাও রান্না করে নিতে হবে।পোলাও রান্নায় এক্সট্রা কোনো পানি ব্যাবহার করা যাবে না।দই গুলতে যতোটুকু পানি প্রয়োজন তা দিয়েই পুরো রান্নাটা সেরে ফেলতে হবে।
আলাদা হাড়িতে মাংস ও কেটে রাখা চোট চোট মার্বেলের সাইজ আলু বিভিন্ন মসলা দিয়ে রান্না করতে হবে।
তারপর চাল ও মাংস একসাথে মিশিয়ে তার মধ্যে গাজর কুচি দিয়ে দমে রাখতে হবে ইফতারের আগ পর্যন্ত।
পরিবেশন :
আখনি বিরিয়ানি গরম গরম খেতেই খুব মজা।খাওয়ার সময় ছোলা বুট মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।অনেকে আবার রান্নার সময়ই ছোলাবুট দিয়ে দেয়।
৩.বিন্নি চালের পায়েস
পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত ফসলের মধ্যে বিন্নি চাল সবথেকে ঐতিহ্যেবাহী ও দামি চাল।বিন্নি চালের খাবারকে পাহাড়ি অঞ্চলের স্থানীয়রা খুবই বিলাসবহুল একটি খাবার হিসেবে ভাবে।সিলেট পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ার সুবাদে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে বিন্নি চালের পায়েস খুবই জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী একটি ডেজার্ট আইটেম।বিয়ে বাড়ি হোক কিংবা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান অথবা অতিথি আপ্যায়নে বিন্নি চালের পায়েস তাদের চাই ই চাই।বর্তমানে শুধু সিলেটেই নয় বিন্নি চালের কদর রয়েছে পুরো বাংলাদেশে।
প্রস্তুত প্রনালী :
পায়েস তৈরির জন্য চাল ভালোভাবে ধুয়ে ১/২ ঘন্টা আগে ভিজিয়ে রাখতে হবে। আগের দিন রাতে ভিজিয়ে রাখলে সব থেকে বেশি ভালো হয়।রান্নার সময় একটি পাতিলে দুধ জ্বাল করে অর্ধেক করে নিতে হবে। তার মধ্যে ভিজিয়ে রাখা চাল দিয়ে সিদ্ধ করতে হবে।দিয়ে দিতে হবে গরম মসলা ও তেজ পাতা।সিদ্ধ হয়ে গেলে তার উপরে ছড়িয়ে দিতে হবে খেজুরের গুড়। তারপর আবার ভালোভাবে নেড়ে নামিয়ে ফেলতে হবে।
পরিবেশন :
বিন্নি চালের পায়েস গরম না খেয়ে ঠান্ডা করে খেতেই বেশি ভালো লাগে। খাওয়ার সময় উপরে কাজু,কিসমিস, ও জাফরান ছড়িয়ে দিলে খেতে আরও বেশি সুস্বাদু হয়।
৪.হুটকি শিরা
হুটকি মানে শুঁটকি আর শিরা মানে ঝোল।হুটকি শিরা মানে শুঁটকির ঝোল।সিলেটি দের কাছে খুবই জনপ্রিয় খাবার হুটকি শিরা।এটা মূলত তেল চর্বি ছাড়া রান্না করা এক ধরনের সবজি।যে কোনো মৌসুমি সবজি,চিংড়ি ও শুঁটকি দিয়ে এই খাবারটি রান্না করা হয়।বিশেষ করে সিদল শুটকি দিয়ে এই খাবারটি বেশি ভালো লাগে।
প্রস্তুত প্রনালী :
ঠান্ডা পানিতে শুঁটকি ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে।একটা হাড়িতে কাটা পেয়াজ ও থেতলে রাখা রসুন লাল মরিচ,বাটা মরিচ, চিংড়ি ও শুঁটকি দিয়ে ভালোভাবে কষিয়ে নিয়ে হবে।তার মধ্যে দিয়ে দিতে হবে কেটে রাখা বিভিন্ন সবজি।পানি দিয়ে বেশি আঁচে রান্না করতে হবে।মাঝে মাঝে নেড়ে দিতে হবে।শেষে দিয়ে দিতে হবে নাগা মরিচ।একটু ঝোল ঝোল রেখেই নামিয়ে নিতে হবে হুটকি শিরা। পুরো রান্নার প্রসেসিং এ কোনো প্রকার তেল ব্যবহার করা যাবে না।
পরিবেশন:
হুটকি শিরা সাধারণত গরম গরম ভাতের সাথে খাওয়া হয়।
৫.নুন গড়া
নুন গড়া সিলেট জেলার ঐতিহ্যবাহী এক ধরনের নোনতা স্বাদযুক্ত পিঠা বা মুখরোচক খাবার।আঞ্চলিক ভাষায় এই পিঠাকে নুনর বড়া,নুনের পিঠা,নুনিয় পিঠা বলা হয়।বাড়িতে মেহমান আসলে বা ঈদের সময় এই পিঠা মোটামুটি প্রতি বাড়িতেই বানানো হয়।নুন গড়া বানাতে উপকরণ খুব কম লাগে এবং বানানোও খুব সহয বিধায় সিলেটি দের বিকেলের নাশতায় প্রায়ই এই খাবারটি দেখা যায়।নুন গড়া বানাতে প্রয়োজন পেয়াজ,আদা, রসুন, হলুদ,লবন,তেল এবং চালের গুড়ো।
প্রস্তুত প্রনালী :
প্রথমে একটা হাড়িতে পরিমানমতো পানি দিয়ে তার মধ্যে পেয়াজ, আদা বাটা,রসুন বাটা,হলুদ গুড়ো,পাঁচ ফোড়ন (অপশনাল), লবন দিয়ে কিছুক্ষণ জ্বাল করে নিতে হবে।তার মধ্যে দিয়ে দিতে হবে চালের গুড়ো।নরম তুলতুলে করে সিদ্ধ করা চালের গুড়োর কাই একটা পাত্রে ঢেলে ঠান্ডা করতে হবে।তারপর একটু মোটা করে রুটি বেলে নিয়ে ইচ্ছামতো আকৃতিতে কেটে নিতে হবে নুন গড়া। এরপর তেলে ভেজে নিলেই হয়ে যাবে মজাদার নুন গড়া পিঠা।
পরিবেশন:
গরম গরম নুন গড়া পিঠা খালি খেতেই ভালো লাগে। তাছাড়া বিকেলের নাশতায় চায়ের সাথে নুন গড়া খাওয়ার মজাই অন্যরকম।
৬.হাঁস – বাঁশ
হাঁস – বাঁশ মূলত হাঁসের মাংস ও বাঁশের কোড়ল দিয়ে রান্না করা তরকারি জাতীয় এক ধরনের খাবার যা সিলেটি রন্ধনশালার ঐতিহ্যকে বহন করে।সিলেটের যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে হাঁস বাঁশ খুবই কমন একটি খাবার।হাঁসের মাংস,কচি বাঁশের কোড়ল ও বিভিন্ন ধরনের মসলা যেমন: পেয়াজ, আদা, রসুন,হলুদ,মরিচ,শর্ষে বাটা,বাদাম বাটা ও দুধ দিয়ে হাঁস বাঁশ রান্না করা হয়।
প্রস্তুত প্রনালী :
একটি পাতিলে পরিমানমতো তেল দিয়ে তার মধ্যে পেয়াজ কুচি ভেজে নিতে হবে।পেয়াজ একটু নরম হলে আদ,রসুন,শর্ষে বাটা,বাদাম বাটা দিয়ে ভালো করে ভাজতে হবে।ভাজা হয়ে গেলে সামান্য পানি দিয়ে ও অন্যান্য মসলা দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে কিছুক্ষণ। এর পর সামান্য পানি দিয়ে ছোট করে কেটে রাখা চামড়া ছাড়ানো হাঁসের মাংস দিয়ে রান্না করতে হবে।সিদ্ধ হয়ে গেলে তার মধ্যে কুচি করে রাখা বাঁশের কোড়ল ও কাঁচামরিচ দিয়ে কিছুক্ষণ দমে রাখতে হবে।নামানোর সময় গুড়ো দুধ সামান্য পানিতে গুলে ও পাঁচফোড়ন (অপশনাল) দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
পরিবেশন:
হাঁস বাঁশ তরকারি জাতীয় খাবার তাই সাধারণত ভাত বা পোলাওয়ের সাথে খাওয়া হয়।
৭. সাত রং চা
সাত রং চা এমন এক ধরনের উষ্ণ পানীয় যা সাতটি রং নিয়ে তৈরি এবং স্বাদও সাত রকমের।একই কাপ বা গ্লাসে সাত স্তরে সাজানো থাকে সাতটি রং ও স্বাদ বিশিষ্ট চা।শরবতের মিষ্টি স্বাদ থেকে শুরু করে লবঙ্গের ঝাঁঝালো স্বাদ সবই পাওয়া যায় একই গ্লাসে।প্রথম চুমুকে এক স্বাদ পেলে পরের চুমুকে পাওয়া যায় আরেক স্বাদ।সিলেটের খুবই জনপ্রিয় পানীয় এই সাত রং চা।
প্রাপ্তি স্থান :
আপনি চাইলেই বাংলাদেশের যে কোনো জায়গায় বসে সাত রং চা খেতে পারবেন না।সাতরং চা খেতে হলে আপনাকে চলে যেতে হবে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে।শুধুমাত্র সিলেটের নীলকন্ঠ টি কেবিনে এই চা পাওয়া যায়। নীলকন্ঠ টি কবিনের স্বত্বাধিকারী এই চা উদ্ভাবন করেন এবং তার এই গোপন চা বানানোর পদ্ধতি কারো কাছে শেয়ার করেননি।যদিও আশে পাশে আরও কয়েকটি দোকানে সাত রং চা তৈরি করা হয়, কিন্তু তার মতো অথেনটিক স্বাদ আর কোথাও পাওয়া যায় না।
সিলেটের আরও কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো :
- চোঙা পিঠা
- বিরইন
- চিকেন টিক্কা মশালা
- কুকি বিস্কুট
- নাগা মরিচের আচার ( ইত্যাদি )