সাপের কামড় যেকোনো মানুষের জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আমাদের দেশে প্রায়ই অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়তই সাপের কামড়ের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে আমাদের গ্রামাঞ্চলে সাপের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা দেয়। এই কারণে আমাদের সবাইকে সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে জানতে হবে। আসুন আমরা এই আর্টিকেল থেকে সাপের কামড় সম্পর্কিত সকল বিষয় যেমন, সাপের কামড়ের চিহ্ন কী এবং এর লক্ষণ গুলো কী কী, সাপের কামড়ের করনীয় কী এবং সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা, প্রতিষেধক ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
সাপের কামড় থেকে বাঁচার উপায়
শুরুতেই আমাদের জানা উচিত কীভাবে আমরা সাপের কামড় থেকে বাঁচতে পারব:
১। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাপকে মাড়িয়ে দেওয়ার কারণে সাপে মানুষকে কামড় দেয়। তাই বনজঙ্গলে হাঁটার সময় অবশ্যই সতর্ক ভাবে হাঁটতে হবে। প্রয়োজনে পায়ে লম্বা জুতা বা বুট ব্যবহার করতে হবে। কখনোই খালি পায়ে হাঁটা যাবে না। একইসাথে অন্ধকারে হাঁটার সময় টর্চলাইট, লাঠি ইত্যাদি সাথে রাখতে হবে।
২। চারপাশে হাঁটার সময় আমাদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য প্রচুর শব্দ করতে হবে। যাতে সাপ দূরে সরে যায়।
৩। মনে রাখতে হবে সাপ কখনোই নিজে থেকে কাউকে কামড় দেয় না। তাই কখনো যদি সাপ সামনে পড়ে যায় তাহলে ধীর-স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কেননা সাপকে প্ররোচনা দিলে সে আক্রমণ করে বসবে।
৪। কখনও কোনো গর্তের মধ্যে হাত রাখা যাবে না। সাপকে ধরার, মারার কিংবা উত্যক্ত করা যাবে না।
৫। বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘুমানোর রুমে সাথে কোনো খাদ্যসামগ্রী, যেমন- ধান-চাল কিংবা হাঁস-মুরগি, কবুতর ইত্যাদি রাখা যাবে না ।
৬। গ্যারেজ, পরিত্যক্ত রুম? শেড বা স্টোররুমে প্রবেশ করার সময় দরজা খুলে প্রথমে লাইট জ্বালিয়ে সাপ আছে কিনা দেখতে হব।
৭। চেষ্টা করতে হবে যাতে মেঝেতে ঘুমাতে না হয়। প্রয়োজনে খাটের ওপর মশারী দিয়ে ঘুমাতে হবে।
৮। আমরা যখন মাছ ধরব তখন ‘চাই’ কিংবা ‘জাল’র মধ্যে হাত দেওয়ার পূর্বে সাপ আছে কি-না তা পরীক্ষা করে দেখব।
সাপের কামড়ের চিহ্ন
সাপে কামড় দিলে প্রধানত যে চিহ্নটি প্রকাশ পাবে তা হলো, সাপের দুটি দাঁতের চিহ্ন। যেকোনো বিষধর কিংবা বিষহীন সাপ হোক না কেন, সাপে কামড় দিলেই ঐ স্থানে সাপের দাঁতের চিহ্ন বিদ্যমান হবে।
এছাড়া কেউ যদি শুকনো সাপের কামড়ের শিকার হয় অর্থাৎ যে সাপের বিষ নেই, তাহলে কামড়ের জায়গাটির চারপাশে ফোলাভাব এবং লালভাব থাকবে।
কিন্তু কাউকে যদি বিষধর সাপের কামড় খেয়ে থাকেন, তাহলে তার ব্যপক উপসর্গ থাকবে।
বিশেষ করে, চামড়ায় কামড়ের দাগ। এই দাগ খোঁচা ক্ষত বা ছোট পেরেকের খোঁচার মতো হতে পারে। কামড়ের চারপাশে তীক্ষ্ণ জ্বলন্ত ব্যথা অনুভব হবে।
সাপের কামড়ের লক্ষণ
যখন কোনো ব্যক্তিকে সাপে কামড় দেয়, তখন তার বিভিন্ন উপসর্গ প্রকাশ পায়। যার মধ্যে অন্যতম হলো,
- প্রধানত চামড়ায় কামড়ের দাগ থাকবে। এটা খোঁচা ক্ষত বা ছোট চিহ্নের মতো।
- কামড়ের চারপাশে তীক্ষ্ণ জ্বালা হতে পারে, সাথে প্রচন্ড ব্যথা যা কামড়ের কিছুক্ষণ অনুভব হতে পারে। যেমন পায়ে কামড়ের জন্য কুঁচকিতে বা বাহুতে কামড়ানোর জন্য বগলে ব্যাথ্যা হতে পারে। কিন্তু সবাই ব্যথা অনুভব করে না।
- কামড়ের জায়গায় লালভাব, ফোলাভাব এবং টিস্যুর ক্ষতি বা সম্পূর্ণ ধ্বংসও হতে পারে।
- অস্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধা এবং রক্তপাত হতে পারে। গুরুতর রক্তপাতের ফলে রক্তক্ষরণ বা কিডনি ফেলিউর হতে পারে।
- নিম্ন রক্তচাপ, দ্রুত হৃদস্পন্দন এবং পালস কমে যাওয়া।
- বমি বমি ভাব এবং বমি, ডায়রিয়া, অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করা, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা এবং দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে।
- শ্বাস নিতে অসুবিধা, বা গুরুতর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়া।
- লালা ঝরা এবং ঘামের বৃদ্ধি পাওয়া।
- পেশীতে দুর্বলতা এবং মুখ বা অন্যান্য অঙ্গে অসাড়তা।
- গলায় অত্যধিক আঁটসাঁটতা এবং জিভ ফুলে যাওয়ায় কথা বলতে অসুবিধা হয়।
- ছোট বাচ্চারা খুব ফ্যাকাশে হয়ে যেতে পারে।
সাপের কামড় বুঝার উপায়
সাপে কামড়ালে বেশ কিছু চিহ্ন থাকবে। বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তির চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসবে, আক্রান্ত স্থানে প্রচুর জ্বালা যন্ত্রণা হবে, রোগী চোখে ঝাপসা দেখবে। তার ঢোক গিলতে অসুবিধা হবে। ধীরে ধীরে গলা বন্ধ হয়ে আসবে এবং শরীর ফুলে উঠবে।
এছাড়া কিছু কিছু বিষয় বা পরীক্ষা আছে যা দেখে কোন সাপে কামড় দিয়েছে তা বুঝা যাবে।
- সাপের কামড়ে যদি রোগী ঝিমিয়ে পড়ে বা চোখের পাতা বুজে আসে, কিংবা চোখে ঝাপসা দেখে বা কথা জড়িয়ে আসে তাহলে বুঝতে হবে এটা কেউটে সাপে কামড় দিয়েছে।
- এছাড়া আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে ২ মিলি রক্ত নিয়ে একটি ছোট টেস্ট টিউবে সোজা করে রেখে দিব। ২০ মিনিট পর টিউবটিকে কাত করলে যদি রক্ত জমাট না বাঁধে তাহলে বুঝতে হবে এটি চন্দ্রবোড়ার কামড়। একইসাথে আক্রান্ত রোগীর দাঁতের মাড়ি, পুরাতন ঘা বা কাশির সঙ্গে রক্ত পড়তে থাকবে।
- এছাড়া কালাচ সাপে কামড়ালে রাতে পেটে যন্ত্রণা, গলায় ব্যথা, গাঁটে ব্যথা, খিচুনি এই জাতীয় লক্ষণ দেখা দিবে।
সাপ কামড় দিলে করনীয়
সাপে কামড়ালে দ্রুত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন,
- সাপ শনাক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। রঙ, আকার, মাথার আকৃতি, আক্রমণ পদ্ধতি ইত্যাদি।
- রোগীর পোশাক ঢিলাঢালা করে তাকে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে রাখতে হবে। গয়নাগটি থাকলে খুলে ফেলতে হবে।
- হাত বা পায়ে আক্রান্ত হলে সাথে তা শক্ত কোনো কিছু দিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে। যাতে বিষাক্ত রক্ত সারা শরীরে প্রবাহিত হতে না পারে।
- রোগীকে শান্ত এবং স্থির থাকতে হবে। আক্রান্ত স্থান হৃৎপিণ্ড লেভেলের নীচে থাকতে হবে। নড়াচড়া করা যাবে না কেননা এতে রক্তের প্রবাহ বাড়াবে এবং বিষ দ্রুত হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে যেতে পারে।
- নিজে থেকে কোন প্রকার অ্যান্টি-ভেনোম দেওয়া যাবে না।
- রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
সাপ কামড় দিলে যা করা যাবে না
- রোগীকে মানসিক চাপ দেওয়া
- ক্ষত কেটে ফেলা বা বিষ বের করে ফেলা
- কিছু খেতে বা পান করতে দেয়া
- রোগীকে একা ছেড়ে দেওয়া
- ক্ষতস্থানে বরফ লাগানো
- আক্রান্ত অঙ্গটিকে যেকোনো দ্রবণে ভিজিয়ে রাখা
- কোনো ব্যথা উপশমকারী ওষুধ গ্রহণ করা
সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা
সাপে কামড় দিলে প্রথমে রোগীকে শান্ত, ধীর স্থির করে এমনভাবে বসাতে হবে যাতে আক্রান্ত স্থান হৃৎপিন্ড লেভেলের উপরে না যায়।
শরীরের যাবতীয় অলংকার বা ঘড়ি ইত্যাদিসহ আঁটসাঁট পোশাক খুলে ফেলে হবে।
পায়ে কামড় দিলে, আক্রান্ত স্থানের হালকা উপরে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে। যাতে বিষাক্ত রক্ত শরীরে বেশী প্রবাহিত হতে না পারে।
এরপর সাবান পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান ধুয়ে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সাপের কামড়ের ইনজেকশন
যেকোনো ব্যক্তিকে সাপ কামড় দিলে তাকে সাথে সাথেই সাপের ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। আর এই সাপের ভ্যাকসিনকে বলা হয় অ্যান্টিভেনম। সাপে কামড়ানো রোগীকে ৫ থেকে ১০টি অ্যান্টিভেনম দিতে হয়।
এই অ্যান্টিভেনমের প্রতি ফাইলের দাম পড়ে নূন্যতম প্রায় এক হাজার টাকা। একজন সাপেকাটা রোগিকে কমপক্ষে ৫-১০টি বা আরো বেশী অ্যান্টিভেনম এর ভায়াল দিতে হতে পারে।
বাংলাদেশে সকল সরকারি হাসপাতালে এই ভ্যাকসিন ফ্রীতে দেওয়া হয়।
সাপের কামড়ের ভ্যাকসিনের নাম
সাপের কামড়ের প্রচলিত ভ্যাকসিনের নাম অ্যান্টিভেনম। যা সরকারি হাসপাতালে ফ্রীতে পাওয়া যায়। এবং অন্যান্য হাসপাতালে ও ঔষধের দোকানেও পাওয়া যায়। যার দাম পরে প্রায় ১০০০ টাকা।
এছাড়াও কিছু কিছু অ্যান্টিভেনম রয়েছে যা দেশের বাইরের ভ্যাকসিন। আর তা হলো,
- Asvs Injection
- CroFab- ক্রফ্যাব
- অ্যান্টিভেনিন (ক্রোটালিডি) পলিভ্যালেন্ট
- Anavip-অনভিপ
- Antivenin Polyvalent – অ্যান্টিভেনিন পলিভ্যালেন্ট
- antivenin (micrurus fulvius) – অ্যান্টিভেনিন (মাইক্রোরাস ফুলভিয়াস) ইত্যাদি।
সাপের কামড়ের ভ্যাকসিন কোথায় পাওয়া যায়
সাপের কামড়ের ভ্যাকসিন দেশের সকল সরকারি হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এছাড়াও অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালও টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে গ্রীষ্ম বর্ষাকালে ব্যাপক সাপের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা সাপের কামড়ের সম্মুখীন হন। কিন্তু তাদের অজ্ঞতার কারণে ডাক্তারি চিকিৎসা না করে কবিরাজ দিয়ে ঝাড়ফুক করে। যা কখনোই উচিত নয়। তাই যেকোনো সাপে কাটা রোগীকে চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।