সন্দীপ ভ্রমণ গাইড | সন্দীপে যাওয়ার উপায়, থাকার হোটেল ইত্যাদি

শহরের জনকোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমুদ্রের অববাহিকায় গড়ে ওঠা সাদামাটা একটি দ্বীপে কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যেতে চাইলে পরিকল্পনা করতে পারেন সন্দীপ ভ্রমনের। দ্বীপের সাধারণ মানুষের আতিথেয়তা, মন ভোলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদীর কলকল শব্দ, সমুদ্রের গর্জন ও সবুজের সমারোহ যে কাউকে মুগ্ধ করতে পারবে। হাতে দুই দিন সময় নিয়ে গেলে ঘুরে দেখতে পারবেন পুরো দ্বীপের মনোরম সৌন্দর্য।

বাংলাদেশের পর্যটন এলাকা গুলোর মধ্যে এই দ্বীপটি বেশ উল্লেখযোগ্য। যাতায়াত ব্যবস্থা খুব বেশি ভালো না হলেও দ্বীপে পৌছানোর পরে সব কষ্ট ভুলে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে ছবির মতো সুন্দর এই দ্বীপে। সন্দীপের উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ, যাওয়ার উপায়, থাকা খাওয়াসহ প্রয়োজনীয় সকল তথ্য বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরা হবে আজকের আয়োজনে।

সন্দীপ কোথায় অবস্থিত?

বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল এই দ্বীপটি। সন্দীপ মূলত চট্টগ্রাম জেলার একটি দ্বীপ উপজেলা যা বাংলাদেশের একটি প্রাচীন দ্বীপ হিসেবে পরিচিত। অতীতের সুবিশাল পরিসরে গড়ে ওঠা দ্বীপটির বর্তমান আয়তন মাত্র ৮০ বর্গমাইল। ধারনা করা হয় পনেরো শতকের দিকে এর মোট আয়তন ছিল ৬৫০ বর্গমাইল।

সন্দীপ ভ্রমণের মূল আকর্ষণ সমূহ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোরম পরিবেশে বেষ্টিত এই দ্বীপের পুরোটাই একটি আকর্ষণের বিষয়। যেদিকে দুচোখ যায় শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র। সবুজে মোড়ানো চর, ছায়ায় ঘেরা গ্রাম, গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, স্থানীয়দের আতিথেয়তা পুরোটাই যেন এক আকর্ষণ।

সুযোগ পেলে সাইকেল ভাড়া নিয়ে চক্কর দিয়ে আসতে পারেন পুরো দ্বীপটি । বর্তমানে সন্দীপ ভ্রমনে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ থাকে দ্বীপে ক্যাম্পিং করার বিষয়ে৷ স্থানীয় বাজারে ক্যাম্পিং এর জন্য সকল প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পেয়ে যাবেন। তাছাড়া স্থানীয়দের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারলে তারাই সব কিছুর আয়োজন করে দেবে।

এখানকার সাধারণ জনগন বেশ আন্তরিক, তাদের মন মতো হলে সকল অসুবিধায় তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে। শীতকাল ক্যাম্পিং এর জন্য উপযুক্ত সময়। দ্বীপের পশ্চিম দিকে নদীর পাড়ে রহমতপুর নামক স্থানটি ক্যাম্পিং এর জন্য উপযুক্ত জায়গা।

নদীর পাড়ে তাবু খাটিয়ে কুয়াশায় মোড়া একটি চমৎকার রাত উপভোগ করার পাশাপাশি নিজেরাই রান্না করে ছোটখাটো একটা বনভোজনের আয়োজন করে ফেলতে পারবেন।

এই দ্বীপের আর একটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ হলো উত্তর সীমান্তে অবস্থিত মরিয়াম বিবি সাহেবানী মসজিদ। অসাধারন স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন সম্বলিত এই মসজিদটি ঐতিহাসিক তাজমহলের আদলে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সাথে উপভোগ করতে পারবেন মসজিদ সংলগ্ন অপার সৌন্দর্যে ভরপুর একটি দিঘির স্বচ্ছ পানির কলধ্বনি।

আবার মাঝে মাঝেই দেখা যায় জারি ও বাউল গানের আসর। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখতে পারবেন। আছে ঘন বন ও সবুজে ঘেরা কয়েকটি সৌন্দর্যমণ্ডিত চর। যেমন: উত্তরের আমানুলার চর, দ্বীপের উত্তর পূর্ব দিকের উড়ির চর এবং দক্ষিণে অবস্থিত কালিয়ার চর। আরও ঘুরে দেখতে পারেন কালাপানিয়া দীঘি, সবুজ চর,ছোয়াখালী, সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া জেটি ঘাট ইত্যাদি।
সব মিলিয়ে সাদামাটা, সুন্দর, জনকোলাহল মুক্ত পরিবেশে ছুটির দিনগুলো বেশ শান্তিপূর্ণ ভাবে কাটাতে পারবেন সন্দীপে ঘুরতে এসে।

পুরো দ্বীপটি অল্প সময়ে ভালোভাবে ঘুরে দেখতে চাইলে বাইক ভাড়া নেয়া হবে সবথেকে বুদ্ধিমানের কাজ। এতে যানবাহন ও স্থানীয় গাইড দুইটি সুবিধা একসাথে পাওয়া যাবে।
বাইক ভাড়া নিতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা মনসুর ভাইয়ের সাথে।

সন্দীপ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

শীতকাল সন্দীপ ভ্রমণের একেবারে উপযুক্ত সময়। এই সময় দ্বীপের বেশিরভাগ অংশের পানি নেমে যায় ও চরগুলোও ভালোভাবে জেগে ওঠে, রাস্তাঘাট শুকনো ও পরিচ্ছন্ন থাকে। অন্যদিকে বর্ষার সময় বেশিরভাগ এলাকা থাকে কর্দমাক্ত ও পানিতে ঢাকা। তাছাড়া শীতকালে খাওয়া দাওয়ার বিষয়েও এক দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। সেই সাথে শীতকালের অতিথি পাখির কলকাকলীতে মুখরিত পরিবেশ তো রয়েছেই।

সন্দীপ যাওয়ার উপায়

সন্দীপ যেতেতু চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত তাই ঢাকা থেকে বা অন্যান্য জেলা থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরাঘাট যেতে হবে প্রথমে। কুমিরাঘাট পৌছে সেখান থেকে নদীপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যাবে সন্দীপে।

ঢাকা থেকে কুমিরাঘাট

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গামী যে কোনো বাসে চেপে কুমিরাঘাট পৌছাতে পারবেন। ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী বাস সার্ভিসের মধ্যে আছে – হানিফ, শ্যামলী, এস আলম, সৌদিয়া, গ্রীন লাইন, সিল্ক লাইন, সোহাগ, বাগদাদ এক্সপ্রেস, ইউনিক পরিবহন ইত্যাদি।

যে কোনো একটি চট্টগ্রাম গামী বাসে চেপে বাসের কনট্রাকটরকে বলে রাখলেই হবে কুমিরাঘাটের সন্দীপ ফেরিঘাট যাওয়ার রাস্তার মাথায় নামিয়ে দিতে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নন এসি বাস ভাড়া ৪৮০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা। এবং এসি বাসের ভাড়া পড়বে ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা। বাস থেকে নেমে লোকাল অটোতে বা সিএনজিতে চেপে সরাসরি কুমিরা ঘাটঘর চলে যেতে হবে।

চট্টগ্রাম থেকে কুমিরাঘাট

বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে চট্টগ্রাম পৌছে সেখান থেকে খুব সহযেই কুমিরাঘাট পৌছাতে পারবেন। চট্টগ্রামের অলংকার মোড়, এ কে খান মোড় অথবা কদমতলী থেকে ফেনী গামী যে কোনো বাসে চেপে কুমিরা ঘাটঘর পৌছাতে পারবেন। জনপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে ৪০ থেকে ৮০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে সিএনজি বা প্রাইভেট কার রিজার্ভ করেও কুমিরাঘাট পৌছাতে পারবেন। সেক্ষেত্রে রিজার্ভ ভাড়া পরবে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো।

কুমিরাঘাট থেকে সন্দীপ :

কুমিরাঘাট থেকে সন্দীপ যাওয়ার জন্য স্পিডবোট, ছোট লঞ্চ বা ট্রলার পাওয়া যায়। স্পিডবোটে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা এবং সন্দীপ পৌছাতে সময় লাগবে ৩০ মিনিটের মতো। ছোট লঞ্চ বা ট্রলারে জনপ্রতি ভাড়া ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা এবং পৌছাতে সময় লাগবে দুই থেকে তিন ঘন্টা।

সন্দীপের গুপ্তছড়া ঘাটে নেমে সিএনজি ভাড়া করে চলে যেতে পারেন টাউন কমপ্লেক্সে। এখানে রাতে থাকার জন্য হোটেল পাবেন। অথবা ক্যাম্পিং করে থাকতে চাইলে চলে যেতে পারেন পশ্চিম পাড়ের রহমতপুর। সিএনজি ভাড়া ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা নিতে পারে।

সন্দীপে থাকার ব্যবস্থা :

সন্দীপের এনাম নাহার, টাউন কমপ্লেক্স ও সেনের হাটে সাধারণ থেকে মাঝারি মানের কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। চাইলে এখানে রাতে থাকতে পারবেন অথবা নিজেরা তাবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করেও থাকতে পারবেন। সরকারি ডাক বাংলোতেও থাকার ব্যবস্থা হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে উপজেলা পরিষদ থেকে পূর্ব অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে। ডাক বাংলোতে থাকার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন-
মাহমুদুর রহমান- ০১৮১১-৩৪১৭২২

সন্দীপের টাউন কমপ্লেক্স এর কয়েকটি হোটেল –

১. হোটেল গ্রীন ভিউ
ভাড়া- সিঙ্গেল বেড ৫০০ টাকা এবং ডাবল বেডে ৮০০ টাকা।
মোবাইল: ০১৮১৫-১৯০৭০৭
বা, ০১৭১২-৯৮৫৩০৯

২. জামান গেস্ট হাউস
ভাড়া- সিঙ্গেল রুম ৪০০ টাকা ও ডাবল রুম ৮০০ টাকা।
মোবাইল: ০১৮৭৪-৯১৫১৭৪
বা, ০১৮৯১-৬৪১৪৫৬

৩. হোটেল রয়েল ইন
ভাড়া- সিঙ্গেল রুমে ৫০০ টাকা এবং ডাবল রুম ১,০০০ থেকে ২,৫০০ টাকা পর্যন্ত।
মোবাইল : ০১৮৭৪-৭৭৭৭৭৫

সন্দীপে খাওয়ার ব্যবস্থা

সন্দীপে খাওয়ার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল পাবেন যেখানে ভাত, মাছ, মাংস, সবজি সহ বিভিন্ন নাশতার আইটেম খেতে পারবেন। প্রতি বেলায় খাওয়ার খরচ সাধারণত ১০০ টাকার মতো লাগবে। এছাড়া আছে গ্রীন ভিউ হোটেলের বিল্ডিংয়েই গ্রীন চিলি রেস্টুরেন্ট এবং বিল্ডিংয়ের পাশে ভাই ভাই হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট, জামান গেস্ট হাউজ এর বাইরে জামান ফুড কর্ণার। সন্দীপের বিখ্যাত কিছু খাবার আছে যা একবার হলেও চেখে দেখা উচিত। যেমন: বিনয় শাহের মিষ্টি, মহিষের দই, খেজুরের রস, খেজুরের রসের শিরনি, নদীর তাজা মাছ ইত্যাদি।

সতর্কতা:
১)এই দ্বীপে ঘুরতে গেলে অবশ্যই স্থানীয়দের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করুন। অবশ্য সন্দীপের মানুষ খুবই আন্তরিক ও অতিথি পরায়ন।
২) দ্বীপের মধ্যে যাতায়াতের জন্য গাড়ি ভাড়া করার সময় দরদাম করে নিতে হবে। কেননা ট্যুরিস্ট দেখলে গাড়ি ভাড়া বেড়ে যায়।
৩) প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকুন।

Scroll to Top