পাহাড়, ঘন গাছগাছালি আর সাদা পানির বিশাল জলরাশি নিয়ে নিজস্ব জৌলুশ প্রকাশ করতে বিদ্যমান সিলেটের সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা। এই ঝর্ণাটি স্থানীয়দের কাছে মায়াবী ঝর্ণা বা সেনগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা নামেও পরিচিত। আর পাঁচটা সাধারণ ঝর্ণার মতো নয় বলে এটি একটু বেশিই আকর্ষণ করে পর্যটকদের।সব ঝর্ণাই সাধারণত উঁচু পাহাড়ের পাথরের গা বেয়ে নিচে নেমে আসে, আর এদিক থেকেই বাকি সব ঝর্ণার চেয়ে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা একটু আলাদা।
তিনটি ধাপে এই ঝর্ণাটি নিচের দিকে নেমে এসেছে।এই মন মাতানো চমৎকার দৃশ্য দেখলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। ঝর্ণাটির সন্ধান মিলেছে সম্প্রতি, তাই সিলেটের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের থেকে এখানটাতে তুলনামূলক জনসমাগম কম থাকে। ফলে প্রকৃতির সাথে নিবিড় এক মেলবন্ধন তৈরি হয় এখানে ঘুরতে আসলে। সিলেটের জাফলং ঘুরতে গেলে অবশ্যই একবার ঘুরে আসা উচিত সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা থেকে।
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণার অবস্থান
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা বা মায়াবি ঝর্ণা সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট পউজেলায় অবস্থিত। ঝর্ণাটি মূলত সিলেটের জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে একদম কাছাকাছি অবস্থিত। জিরো পয়েন্ট থেকে পায়ে হেটে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণায় পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিট। তবে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণাটি ভারতীয় সীমান্তে পড়েছে। বিএসএফ এর অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশী নাগরিকেরাও এই ঝর্ণায় দেখতে যেতে পারবে৷
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা দেখতে কেন যাবেন?
স্থানীয় লোকজন কিন্তু এমনি এমনি সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণার নাম মায়াবিনী ঝর্ণা রাখেনি। সত্যিই ঝর্ণাটির একটি আলাদা আকর্ষণ শক্তি আছে, যার টানে দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সিলেটে ছুটে যায়। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা সাদা পানির স্রোত নেমে এসে নিচের দিকে পুকুরের মতো জলধারা সৃষ্টি করেছে৷ এই অংশটুকুর পানি এতোটাই স্বচ্ছ যে দেখলেই গা ভাসিয়ে দিতে মন চায়। ঝর্ণাটি পাহাড়ের গা বেয়ে সোজাসুজি না নেমে তিনটি ধাপে নিচের দিকে নেমে এসেছে৷
প্রাত্যকেটি ধাপেরই আলাদা আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। নিচে থেকেই পুরো ঝর্ণাটি দেখা যায়। কখনও ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ঝর্ণার জলধারা আবার কখনও খোলামেলা পিচ্ছিল পাথরের গা বেয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। একদম উপরের ধাপের পানি চলে গেছে দুই দিকে। এক দিকের পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচের অংশে আর বাকি পানি চলে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপরে থাকা গুহার মধ্যে। ঝর্ণার তৃতীয় ধাপের উপরে একটি বড় গুহা রয়েছে। এই গুহার শেষ প্রান্ত কোথায় গিয়ে ঠেকছে তা এখনও অজানা। ভেতরের অংশ বেশ পিচ্ছিল
এবং পানি প্রবাহ চলে বিধায় এর ভেতরে প্রবেশ করা যায় না। বাহির থেকে যতোটা সম্ভব দেখতে পারবেন। তবে পিচ্ছিল পাহাড়ের শরীর বেয়ে ঝর্ণার তৃতীয় ধাপে ওঠা বেশ বিপজ্জনক এবং কষ্টকর। অতিরিক্ত এডভেঞ্চার প্রেমীদের জন্যই এই পাহাড় বেয়ে ঝর্ণার শেষ ধাপে পৌঁছানো সম্ভব। যেহেতু পুরো ঝর্ণাটিই নিচ থেকে দেখা যায়,তাই শারিরীক ভাবে দুর্বল বা মনোবল কম এমন ব্যক্তিদের ওপরে ওঠার চেষ্টা না করাই ভালো।
তবে প্রশান্তির জলধারার পাশে বসে একটা দিন কাটয়ে দেয়া, এটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে যে কারো জীবনে। বাংলাদেশে অবস্থিত বেশিরভাগ ঝর্ণায় যাওয়ার পথ বেশ দুর্গম। কিন্তু সেই হিসেবে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণার যাত্রাপথ তুলনামূলক বেশ সহজ। তাইতো যে কেউ চাইলেই গিয়ে উপভোগ করতে পারবে চমৎকার একটি ঝর্ণার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা ভ্রমনের উপযুক্ত সময়
সাধারণত সব ঝর্ণারই জলধারা উত্তাল হয়ে ওঠে বর্ষা ঋতুতে। সেই হিসেবে বর্ষার সময় এখানে ঘুরতে আসলেই সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণার আসল রূপ আপনার সামনে ধরা পড়বে। পুরো বর্ষার সময় ধরেই এখানে পর্যটকদের আনাগোনা চলতে থাকে। শীতের সময় আস্তে আস্তে পানির স্রোতের প্রবাহ কমতে থাকে। তাই জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এখানে ঘুরতে গেলে সবথেকে চমৎকার দৃশ্যটি উপভোগ করতে পারবেন
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণায় যাওয়ার উপায়
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা ভ্রমন করতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে চলে যেতে হবে সিলেট সদরে। সেখান থেকে জাফলং হয়ে যেতে পারবেন সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা। ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার জন্য তিনটি উপায় রয়েছে। সড়কপথ, রেলপথ এবং আকাশপথে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে পারবেন।চট্টগ্রাম থেকেও সরাসরি সড়কপথে ও রেলপথে সিলেট পৌছাতে পারবেন।
ঢাকা থেকে সিলেট
১. সড়কপথে- সড়কপথে ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে সড়কপথে প্রতিদিন বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাস সিলেটের উদ্যেশ্যে ছেড়ে যায়। তার মধ্যে গ্রীণলাইন, সৌদিয়া,এস আলম, শ্যামলী, এনা পরিবহন,ইউনিক পরিবহন ও হানিফ পরিবহন উল্লেখযোগ্য। এই সব বাস ঢাকার সায়দাবাদ, ফকিরাপুল, গাবতলি ও মহাখালী থেকে দিনের বিভিন্ন সময়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সুযোগ সুবিধা ও কোম্পানি ভেদে ঢাকা টু সিলেট এর নন এসি বাস ভাড়া ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা এবং এসি বাস ভাড়া ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। সড়কপথে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে সময় লাগবে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা।
২. রেলপথে- ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে এবং বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে সরাসরি সিলেট যাওয়ার ট্রেন ধরতে পারবেন৷ ঢাকা টু সিলের রুটে নিয়মিত চলাচলকারী ট্রেন হলো: উপবন এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস ও কালনী এক্সপ্রেস। শ্রেণি অনুযায়ী ভাড়া পড়বে ৩২০ টাকা থেকে শুরু করে ১১০০ টাকা পর্যন্ত। ট্রেনে যেতে সময় লাগবে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা।
৩. আকাশপথে- ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিয়মিত ঢাকা টু সিলেট রুটের প্লেন চলাচল করে। নভো এয়ার, বিমান বাংলাদেশ এবং ইউএস বাংলা প্লেনের টিকেট সংগ্রহ করে খুব সহজেই সিলেট চলে যেতে পারবেন। ভাড়া পড়বে ৩৫০০ থেকে ১০,০০০ টাকা।
চট্টগ্রাম থেকে সিলেট-
১. সড়কপথে – চট্টগ্রাম থেকে গ্রীণলাইন, সৌদিয়া, এনা পরিবহন সহ অনেক বাস সার্ভিস সরাসরি সিলেট রুটে চলাচল করে। এসব বাসে এসি ও নন এসি সার্ভিস ভেদে ভাড়া পড়বে ৮০০ থেকে ২৪০০ টাকা।
২. রেলপথে – সিলেট থেকে উদয়ন ও পাহাড়িকা নামক এই ট্রেন দুটি সপ্তাহে ছয়দিন চট্টগ্রাম থেকে সিলেট রুটে চলাচল করে। শ্রেণি অনুযায়ী ট্রেনে ভাড়া পড়বে ৩৭৫ থেকে ১৩৪০ টাকা।
সিলেট থেকে জাফলং –
সিলেট থেকে জাফলং যেতে হলে প্রথমে লোকাল বাসে চেপে শিবগঞ্জ চলে যেতে হবে৷ জনপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। শিবগঞ্জ থেকে সিএনজি বা অটোরিকশা রিজার্ভ করে চলে যেতে পারবেন জাফলং জিরো পয়েন্ট। ভাড়া পড়বে ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা। তাছারা মাইক্রো ভাড়া করে আপ-ডাউন এর চুক্তিতে সারাদিন ঘুরতে পারবেন। এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ।
জাফলং থেকে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা
জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে নদী পাড় হয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট পায়ে হাঁটা পথ অতিক্রম করলেই দেখা মিলবে মায়াবিনী সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণার। তবে বর্ষার সময় নৌকা ঝর্ণার অনেকটা কাছে যেতে পারে। ফলে পায়ে হাঁটা রাস্তা অনেকটা কম পাড়ি দিতে হয়। বর্ষার সময় জনপ্রতি নৌকা ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা আর শীতের সময় ভাড়া নেয় ১০ থেকে ২০ টাকা।
থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা :
জাফলং রাত কাটাতে চাইলে আপনাকে চলে যেতে হবে জাফলং এর মামার বাজার এলাকায়। এখানে বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল পাবেন। তার মধ্যে জাফলং ইন হোটেল, হোটেল প্যারিস ও জৈন্তিয়া হিল রিসোর্ট উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কিছু রেস্ট হাউজ আছে তবে এখানে থাকতে চাইলে অবশ্যই আগে থেকে অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে৷
তাছাড়া সিলেট শহরে এসেও থাকতে পারেন। সিলেটের দরগা গেট, আম্বরখানা, তালতলা ও লামাবাজার এলাকায় বেশ ভালো মানের আবাসিক হোটেল পাবেন। এসব হোটেলে সাধারণত ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
খাওয়া দাওয়ার জন্য জাফলংয়ে ভালো মানের কয়েকটি হোটেল আছে। তার মধ্যে জাফলং ভিউ রেস্টুরেন্ট ও সীমান্ত ভিউ রেস্টুরেন্ট বেশ জনপ্রিয়। সিলেট শহরে গিয়েও খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে নিতে পারবেন। তবে ভ্রমণের সময় সাথে অবশ্যই কিছু শুকনো খাবার ও পানি রাখবেন ।
