খাগড়াছড়ির রিছাং ঝর্না ভ্রমণ গাইড

পাহাড়, ঝর্ণা, গাছগাছালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সাজানো বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলা। খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের খুবই জনপ্রিয় একটি পর্যটন জেলা হিসেবে পরিচিত। কেননা এই জেলায় আছে বেশ কিছু জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, পাহাড়, ঝর্না, ঝিরি ইত্যাদি। খাগড়াছড়ি জেলার খুবই জনপ্রিয় একটি পাহাড়ি ঝর্ণা হলো ‘রিছাং ঝর্ণা’।

প্রতিবছর অনেক পর্যটক খাগড়াছড়ি জেলায় চলে আসে পাহাড়ি এই ঝর্ণার টানে। খাগড়াছড়ি জেলার মধ্যে এই ঝর্ণায় যাওয়ার পথটাও তুলনামূলক সহজ তাই যে কেউ চাইলেই এখানে ভ্রমণ করতে পারে। লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে একদম নির্জন পরিবেশে ঝর্ণার কলধ্বনি আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তাছাড়া পাহাড়ি পথে হেটে ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর। ঝর্ণার স্বচ্ছ পানিতে চাইলে শরীর জুরিয়ে নিতে পারবেন। আলাদা এজ প্রশান্তি আপনার মনকে ভরিয়ে তুলবে।

রিছাং ঝর্ণা সম্পর্কে তথ্য

চট্রগ্রাম বিভাগের খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার সাপমারা গ্রামে রিছাং ঝর্না অবস্থিত। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ঝর্ণাটি ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থািত। খাগড়াছড়ির বিখ্যাত আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। খাগড়াছড়ি -ঢাকা মহাসড়ক ধরে ১ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই রিছাং ঝর্নার দেখা মিলবে।

১০০ মিটার উঁচু থেকে আছড়ে পড়া পানি প্রথমে ঠেকছে উঁচু এক পাথরের বুকে,আবার সেই পানি গড়িয়ে পড়ছে সমতলে। এই দৃশ্য দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থেকে কাটিয়ে দেয়া যায় কয়েক ঘন্টা।এতো উঁচু থেকে আছড়ে পড়া ঝর্ণার পানির পতনের শব্দ প্রধান সড়ক থেকেই শুনতে পাওয়া যায়,যদিও প্রধান সড়ক থেকে রিছাং ঝর্না দুই কিলোমিটার ভেতরে।আর এই রাস্তাটুকু পায়ে হেটেই পাড়ি দিতে হবে। রিছাং ঝর্ণা স্থানীয় লোকদের কাছে সাপমারা রিছাং ঝর্ণা নামে পরিচিত এবং এর আরেকটি নাম ‘তেরাং তৈকালাই’।

রিছাং ঝর্ণা থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে আরও একটা ঝর্ণা আছে যেটা রিছাং ঝর্ণা দুই নামে পরিচিত। এর আরেকটি নাম ‘অপু ঝর্ণা’।৩০ মিটার উঁচু থেকে আছড়ে পড়া পানির কলকল শব্দে যে কেউ হাড়িয়ে যাবে প্রকৃতির রাজ্যে। এই ঝর্ণাটি একদমই লোকালয় থেকে দূরে হওয়ার প্রকৃতির নির্জনতা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করা যায়। রিছাং ঝর্ণা থেকে পায়ে হেটে অপু ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগবে৷ রিছাং ঝর্ণা থেকে অপু ঝর্ণায় যাওয়ার পথটা একটু দুর্গম তাই পর্যটকদের সুবিধার্থে যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে পাকা সিঁড়িপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এই পথে হেটে ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার সৌভাগ্যও কম কিসে। রিছাং ঝর্ণা দেখতে গেলে অবশ্যই অপু ঝর্ণা, আলুটিলা গুহা, আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে আসতে ভুলবেন না।

রিছাং ঝর্ণা কীভাবে যাবেন?

রিছাং ঝর্না যেহেতু খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত তাই প্রথমে খাগড়াছড়ি যাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নেয়া জরুরি। ঢাকা থেকে সরাসরি খাগড়াছড়ি যাওয়ার বাস পাবেন এবং অন্যান্য জেলা থেকে প্রথমে চট্টগ্রাম হয়ে তারপর বান্দরবান পৌঁছাতে পারবেন।

১. ঢাকা টু খাগড়াছড়ি যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি রুটে নিয়মিত সেন্টমার্টিন পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, শান্তি পরিবহন, হানিফ পরিবহন, এস আলম পরিবহন, ঈগল পরিবহন এর বাস চলাচল করে। এসব বাস ঢাকার সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ি,কল্যাণপুর, আসাদগেট, আরামবাগ থেকে দিনের বিভিন্ন সময়ে খাগড়াছড়ির উদ্যেশ্যে যাত্রা করে। ঢাকা টু খাগড়াছড়ি বাসের এসি টিকেট মূল্য সাধারণত ৮৫০ থেকে ১২০০ টাকা এবং নন এসি বাসের টিকেট মূল্য ৫২০ টাকা।
নিচে কয়েকটি বাস সার্ভিস এর যোগাযোগ মাধ্যম তুলে ধরা হলো।

সেন্টমার্টিন পরিবহন।
আরামবাগ : ০১৭৬২-৬৯১৩৪১

শ্যামলী পরিবহন।
আরামবাগ: ০২-৭১৯৪২৯১
কল্যাণপুর: ৯০০৩৩৩১
আসাদগেট: ৮১২৪৮৮১

শান্তি পরিবহন।
আরামবাগ: ০১১৯০৯৯৪০০৭

২. চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার উপায়

বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে খাগড়াছড়ি যেতে চাইলে প্রথমে আপনাকে চলে আসতে হবে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে বিআরটিসি এবং শান্তি পরিবহন এর বাস খাগড়াছড়ি রুটে চলাচল করে।
চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে ১ ঘন্টা পর পর এই দুটো পরিবহন এর বাস খাগড়াছড়ির উদ্যেশ্যে ছাড়ে। নন এসি বাস এর জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে সময় লাগবে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা।
তাছাড়া চট্টগ্রামের কদমতলী থেকে বিআরটিসি বাস সার্ভিস পাবেন যা চট্টগ্রাম টু খাগড়াছড়ি রুটে চলাচল করে। যোগাযোগ: ০১৬৮২-৩৮৫১২৪

খাগড়াছড়ি থেকে রিছাং ঝর্ণা পৌঁছানোর উপায়

ঢাকা – খাগড়াছড়ি মহাসড়কের পাশেই রিছাং ঝর্ণার অবস্থান বলে রিছাং ঝর্ণা যেতে খুব বেশি একটা সমস্যায় পড়তে হয় না। খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে এর দূরত্বও খুব একটা বেশি নয়। খাগড়াছড়ি থেকে সকাল সকাল রওয়ানা হলে বেশ সময় নিয়ে দুটো ঝর্ণা দেখতে পারবেন ও এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন এবং সেইসাথে ঘুরে দেখতে পারবেন আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র ও আলুটিলা গুহা। খাগড়াছড়ি থেকে পাবলিক বাস বা চান্দের গাড়িতে করে চলে যেতে হবে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে। সেখান থেকে রিছাং ঝর্ণার দূরত্ব ২ কিলোমিটার এর একটু বেশি। এই পথটা পায়ে হেটে অথবা মোটরসাইকেলে যেতে পারবেন।পায়ে হেঁট গেলে সময় লাগবে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট। মোটরসাইকেলে যাওয়ার পথে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। কিন্তু আসার সময় সেই একই পথের ভাড়া নিবে ১০০ টাকা।

সবথেকে ভালো হয় খাগড়াছড়ি থেকে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে আসলে। তাহলে বার বার গাড়ি পরিবর্তন না করে একেবারে ঝর্ণার কাছাকাছি চলে আসা যায়। তবে ঝর্ণার থেকে ৫০০ মিটার দূরেই গাড়ি ত্যাগ করতে হবে এবং বাকি পথ টুকু পায়ে হেটে না গিয়ে কোনো উপায় নেই।

কোথায় থাকবেন?

সারাদিনের ভ্রমণ শেষে রাত্রি যাপনের জন্য চলে যেতে হবে খাগড়াছড়ি জেলা শহরে। এখানে বেশ ভালো মানের কয়েকটি আবাসিক হোটেল পাবেন। তাছাড়া সস্তায় থাকার জন্যও পাবেন বোর্ডিং টাইপ কিছু হোটেল। খাগড়াছড়ি জেলার কয়েকটি হোটেলের তালিকা দেয়া হলো-

১. পর্যটন মোটেল

এই মোটেলটি চেঙ্গী নদীর পাড়ে অবস্থিত। এখানে থাকতে গেলে ডবল বেড এসি রুম এর ভাড়া পড়বে ২১০০ টাকা এবং ডবল বেড নন এসি রুমের ভাড়া পড়বে ১৩০০ টাকা।
যোগাযোগ: ০৩৭১৬-২০৮৪৮৬

২. হোটেল গাইরিং

এটি খাগড়াছড়ির মধ্যে উন্নতমানের বিলাসবহুল একটি হোটেল। এখানে সুযোগ সুবিধা, রুমের অবস্থান ও বেড হিসেবে রুম ভাড়া পড়বে ১০০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত।
যোগাযোগ: ০৩৭১-৬১০৪১
অথবা, ০১৮১৫-১৬৩১৭৩

৩. অরন্য বিলাস

খাগড়াছড়ির নারিকেল বাগান এলাকায় হোটেলটি অবস্থিত। ডবল বেড এসি রুম ভাড়া ২৫০০ টাকা। নন এসি রুম ভাড়া ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা।

৪. গিরি থেবার

এই আবাসিক হোটেলটি খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট এড়িয়ার মধ্যে পড়েছে। ভিআইপি এসি রুম ভাড়া ৩৫০০ টাকা। ডবল বেড এসি রুম ভাড়া ২০৫০ টাকা। সিঙ্গেল বেড এসি রুম ভাড়া ১২০০ টাকা।
যোগাযোগ: ০১৮৫৯-০২৫৬৯৪

৫. হোটেল ইকো ছড়ি ইন:

 ০৩৭১-৬২৬২৫
অথবা,৩৭৪৩২২৫

৬. হোটেল শৈল সুবর্ণ:

০৩৭১-৬১৪৩৬
অথবা, ০১১৯০-৭৭৬৮১২

৭. হোটেল জেরিন:

০৩৭১-৬১২২০

৮. হোটেল লাবিয়াত:

০৩৭১৬১৭৯৫

একদম কম খরচে থাকতে চাইলে শাপলা চত্বরের আশেপাশে অনেক বোর্ডিং টাইপ হোটেল পাবেন।এসব হোটেলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে এক রাত থাকার ব্যবস্থা পেয়ে যাবেন।

খাওয়ার ব্যবস্থা

ভ্রমণকালীন সময়ে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র থেকে হালকা খাবার খেতে পারবেন। যেমন চিপস, ড্রিংকস, বিস্কিট, চা ইত্যাদি। এবং ভ্রমণে বের হওয়ার সময় অবশ্যই ক্যারিং ব্যাগে শুকানো খাবার ও পানি নিয়ে নিতে হবে। কেননা পায়ে হাটা পথ ও প্রায় ২০০ সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে ঝর্ণার কাছে যেতে যেতে শরীর একদমই দূর্বল হয়ে পড়বে।

মূল খাবারের জন্য শাপলা চত্বর ও বাস স্যান্ড এলাকায় বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট পাবেন। তবে খাগড়াছড়ির পান্থাই ও খান্ময় রেস্তোরাঁর খাবার সবথেকে বেশি অথেনটিক ও সুস্বাদু। এই দুটো রেস্তোরাঁতে পাবেন পাহাড়ি আদিবাসীদের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার। বান্দরবান গেলে অবশ্যই এখান থেকে একবার খাবারের স্বাদ চেখে আসা উচিত।

মূল সড়ক থেকে বেশি দূরত্ব নয় বলে রিছাং ঝর্ণা সব ধরনের পর্যটকদের জন্যই খুব জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। সঠিক দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ট্যুর প্লান করলে রিছাং ঝর্ণা ভ্রমণ হতে পারে জীবনের সবথেকে সুন্দর ও মেমোরেবল ট্যুর।

Scroll to Top