বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মহানগরী রাজশাহী। রাজশাহীকে বাংলাদেশের সব থেকে সুন্দর নগর বলা হয়,কেননা এই জেলা বাংলাদেশের মধ্যে সবথেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জেলা।বিভিন্ন দিক থেকেই সারা দেশব্যাপী রাজশাহী অঞ্চলের নাম বিখ্যাত হয়ে আছে।এর মধ্যে রাজশাহীর খাবার দাবারও উল্লেখযোগ্য। খাওয়া পাগল বাঙালি খুঁজতে থাকে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে কোন অঞ্চলের খাবার সব থেকে বেশি বিখ্যাত।বাংলাদেশের মানুষ জানে একই খাবারকে কিভাবে আলাদা আলাদা স্বাদে পরিনত করে একটু ভিন্নতা আনা যায়।সেজন্যই তো একই খাবার অঞ্চল ভেদে একেক স্বাদের হয়।রাজশাহী জেলার আছে বেশকিছু জনপ্রিয় খাবার যা কি না রাজশাহীর ঐতিহ্যকে ধারণ করে রাখছে।বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মানুষই মোটামুটি রাজশাহী জেলার সাথে পরিচিত এই অঞ্চলের বিশেষ কিছু খাবারের জন্য।
চলুন জেনে নেয়া যাক রাজশাহী জেলার বিখ্যাত খাবারগুলো সম্পর্কে।
১. কালাই রুটি
রাজশাহীর খাবারের কথা ভাবলেই সবার প্রথমে যে নামটি মনে আসে তা হলো কালাই রুটি।কালাই রুটি রাজশাহীর সবথেকে জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী খাবার।মূলত খেটে খাওয়া মানুষের প্রিয় খাবার ছিল এই রুটি।কারন এই রুটির আকৃতি অন্যান্য সাধারণ রুটির থেকে বড় ও হজম হতেও অনেক বেশি সময় লাগে। একবার খেলে কয়েক ঘন্টায়ও আর খিদে লাগে না বলে খেটে খাওয়া মানুষের প্রিয় খাবার ছিল এই কালাই রুটি।এই খাবারটি তৈরি করতে খরচও তুলনামূলক কম।চালের গুড়ো ও কলাইয়ের ডালের আটা মিশিয়ে তৈরি করা হয় কালাই রুটি।আপনি যদি এই রুটি খেতে অভ্যস্ত না হয়ে থাকেন তাহলে একসাথে একটা রুটি খেয়ে ওঠা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।
তবে বর্তমানে শুধু কৃষক, শ্রমিকদের মধ্যেই এই রুটি খাওয়ার প্রচলন সীমাবদ্ধ নয়।বেশকিছু হোটেল ও রেস্টুরেন্টে কালাই রুটি বিক্রি হয় এবং এর ক্রেতা সমাগমও অনেক বেশি।
বেগুন ভর্তা,মরিচের চাটনি,হাঁসের মাংস,গরুর মাংস ইত্যাদি দিয়ে এই রুটি খাওয়া হয়।
২. কালা ভুনা
রাজশাহীর মানুষের মাংসের রেসিপিগুলোর মধ্যে সবথেকে পছন্দের তালিকায় আছে কালাভুনা। যদিও এই কালাভুনা বিভিন্ন অঞ্চলেরই বিখ্যাত খাবার কিন্তু অঞ্চলভেদে এর রান্নার স্বাদ একেক রকম।
ঘরোয়া ভাবে রান্না করা ছাড়াও রাজশাহীর বিখ্যাত সব হোটেল গুলোতেও সব থেকে আকর্ষণীয় আইটেম থাকে কালাভুনা।
কালা ভুনা গুরুর মাংস বা খাসির মাংস দুটো দিয়েই রান্না করা যায়।কিন্তু গরুর মাংশের কালাভুনা খওয়ার প্রচলনই সব থেকে বেশি।অনেক বেশি পরিমানে মশলা ব্যবহার করা হয় বলে মাংসের রংটা কালচে বর্ন ধারণ করে বলে এই মাংসের নাম হয়েছে কালাভুনা।৫/৬ ঘন্টা চুলার ওপর রেখে রান্না করা হয় রাজশাহীর বিখ্যাত ও জনপ্রিয় খাবার কালাভুনা।
৩.বিখ্যাত রাজশাহীর আম
রাজশাহীর আমের কথা শোনেনি এমন মানুষ বর্তমানে নেই বললেই চলে। পুরো বাংলাদেশের মধ্যে রাজশাহী অঞ্চল অঞ্চল আমের জন্য বিখ্যাত। শুধু দেশেই নয় বিদেশেও এই আম অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।রাজশাহীতে বানিজ্যিক ভাবে আম চাষ হয় এবং তা সারা বাংলাদেশ সহ বিদেশেও বিক্রি করা হয়।
অন্যান্য অঞ্চলের থেকে রাজশাহীর আমের স্বাদ ও গন্ধ হয় সবথেকে ভালো।তাইতো হাজার হাজার আমের মধ্যেও সবার কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে রাজশাহীর আম।তাইতো আম রাজশাহী অঞ্চলের সবথেকে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবার তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে আছে।
রাজশাহীর আমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রজাতি হলোঃ হিমসাগর, ল্যাংরা,আম্রপালি, ফজলি ইত্যাদি।
৪.খেজুর গুড়
রাজশাহীর আমের মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় খাবার হলো খেজুর গুড়।রাজশাহীর খেজুর গুড় সারা বাংলাদেশের মধ্যে বিখ্যাত। এই গুড়ের মতো ঘ্রানযুক্ত গুড় বাংলাদেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না।রাজশাহী আসলে আপনি ১০০% চিনি মুক্ত খাটি খেজুর গুড়ের স্বাদ নিতে পারবেন।
রাজশাহীর পুঠিয়া,বাঘা,চরঘাট সহ আরও বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বানিজ্যিক ভাবে খেজুর গাছ চাষ করা হয় খেজুরের রস সংগ্রহ করার জন্য। এই রস জ্বাল করে তৈরি করা হয় গুড়।ঝোলা গুড়,পাটালি গুড় বেশ জনপ্রিয়।
৫. পোড়া বেগুন ভর্তা
রাজশাহীর খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার পোড়া বেগুন ভর্তা। মূলত কালাই রুটি খাওয়ার সুবাদে এই অঞ্চলে বেগুন ভর্তার জনপ্রিয়তা এতো বেশি।বেগুন ভর্তা ছাড়া তো কালাই রুটি খাওয়ার কথা কল্পনাই করা যায় না।যে সে বেগুন ভর্তা হলে কিন্তু চলবে না, পোড়া বেগুন ভর্তাই হওয়া চাই।
আস্ত বেগুনে তেল মেখে তা পোড়া দিতে হয় চুলার ভেতরে।রান্না শেষে মাটির চুলায় যে উত্তপ্ত কয়লা থাকে তার মধ্যে পোড়া হয় বেগুন।এই কয়লার তাপেই বেগুনের চামড়াটা পুড়ে যায় ও ভেতরের অংশটা সিদ্ধ হয়ে যায়।তারপর চুলা থেকে তুলে ছাল ছাড়িয়ে পেয়াজ, শুকনো মরিচ ও সরিষার তেল দিয়ে চটকে তৈরি করা হয় পোড়া বেগুন ভর্তা।
সব অঞ্চলেই বেগুন ভর্তা খাওয়ার প্রচলন থাকলেও রাজশাহীর মতো অথেনটিক স্বাদ ও জনপ্রিয়তা আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
৬. ডুমুর
হ্যাঁ, ডুমুর।শুনতে অবাক হলেও রাজশাহীর লোকজনের কাছে ডুমুর খুবই উপাদেয় একটি সবজি।আমরা কম বেশি সবাই ডুমুর চিনি। ঝোপঝাড়ে,বনে জঙ্গলে অবহেলায় পরে থাকে ডুমুর ফল। কিন্তু রাজশাহীর মানুষ এই অবহেলিত ফলটিকে তাদের নিজস্ব কৌশলে রান্না করে খাওয়ার উপযোগী করে তুলেছে। যদিও বেশ কয়েকটি অঞ্চলেই বর্তমানে ডুমুর খাওয়ার প্রচলন আছে কিন্তু রাজশাহীর মানুষের মতো রান্নার স্বাদ আর কোথাও পাবেন না।
ডুমুরের ভাজি,ডুমুরের তকরারি থেকে শুরু করে নানা পদ্ধতিতে খাওয়া হয় ডুমুর।রাজশাহীর স্থানীয় ভাষায় ডুমুরকে বলে জগই।
৭. পুঁই মুহুড়ী
রাজশাহীর আঞ্চলিক লোকজনের কাছে খুবই পছন্দের আরেকটি খাবার পুঁই মুহুড়ী।না না এটা কিন্তু পুঁই শাক দিয়ে তৈরি কোনো খাবার নয়।পুই মুহুড়ি তৈরি করা হয় পুই গাছের কচি কছি বিচি দিয়ে।ছোট বেলায় হয়তো অনেকেই পুই বিচি দিয়ে খেলেছেন, যেটা ভাঙলে একদম লাল রং বের হয়।এই বিচি যখন নতুন ডগা নিয়ে বের হওয়া শুরু করে তখন ডগাগুলো ভেঙে রান্না বা ভাজি করা হয়। পুই বিচির বিশেষ এই রান্না ” পুই মুহুড়ী ” রাজশাহীর মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার।
৭. লেবুর পিনিক
রাজশাহীর বিখ্যাত খাবার গুলোর মধ্যে অনন্য স্বাদের কারনে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছে সাজ্জাদ ভাইয়ের লেবুর পিনিক।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজ্জাদ ভাইয়ের লেবুর পিনিক খায়নি এমন স্টুডেন্ট পুরো ভার্সিটিতে নেই বললেই চলে।শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরাই নয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গেলে মোটামুটি কেউই এই লেবুর পিনিক টেস্ট না করে আসে না।সবসময়ই ভিড় লেগে থাকে এই দোকানে।
লেবুকে গোল গোল করে কেটে তার উপরে দেয়া হয় বিভিন্ন ধরনের মসলা।মসলা টা সাজ্জাদ ভাইয়ের একদমই সিক্রেট। এই মসলাটাই লেবুর পিনিকে যদুর ছোয়া নিয়ে আসে।একবার খেলে বার বার খেতে ইচ্ছে করে বিখ্যাত এই লেবুর পিনিক।
সাজ্জাদ ভাইয়ের জনপ্রিয় লেবুর পিনিকের স্বাদ নিতে চাইলে আপনাকে আসতে হবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মমতাজ উদ্দিন আহমদ কলা ভবনের সামনে।
৮. বাটার মোড়ের জিলাপি
রাজশাহী একটি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন হলো বাটার মোড়ের জিলাপি।রাজশাহীর মিষ্টির ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে এই দোকানটি।তিন প্রজন্ম ধরে একই স্বাদের জিলাপি বিক্রি করছেন তারা।রাজশাহী আসলে আপনার অবশ্যই বাটার মোড়ের জিলাপি টেস্ট করা উচিত।রাজশাহী বেশিরভাগ পরিবার এই বিখ্যাত জিলাপি ছাড়া ইফতারের কথা ভাবতেই পারে না।
সাধারণত প্রতিদিন এই দোকানটিতে ৮০ থেকে ৯০ কেজি জিলাপি বিক্রি হয়।কিন্তু রমজান মাসে প্রতিদিন এই বিক্রির পরিমান দাঁড়ায় ২০০ কেজিরও বেশি।রোজার সময় আসরের পর থেকে ক্রেতাদের এতো ভিড় হয় যে তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে জিলাপি কিনতে হয়।কারিগররা রীতিমতো হিমসিম খায় ক্রেতার চাপ সামলাতে।
বিখ্যাত এই জিলাপির দোকানটি রাজশাহীর বাটার মোরে অবস্থিত।জায়গার নাম অনুসারেই লেকমুখে দোকানের নাম প্রচলিত হয়ে গেছে “বাটার মোড়ের জিলাপি “
আমাদের শস্য শ্যমলা বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের খাবারই আলাদা আলাদা স্বাদের হয়ে থাকে। স্বাদের তুলনা করতে গেলে কোনোটার থেকে কেউ কম হবে না।প্রতিটি জেলাই তার নিজস্ব রান্নার স্টাইলের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে।