চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। এই জেলায় রয়েছে বিভিন্ন পাহাড়ি উপজাতিদের বসবাস। উপজাতি সংস্কৃতি ও বাঙালির সংস্কৃতির অনন্য সংমিশ্রণের প্রভাব পড়েছে এই জেলার খাদ্যাভ্যাসের ওপর। রাঙামাটি জেলার খাবারে আছে আলাদা এক বৈশিষ্ট্য, যার কারণে এই জেলায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের এখানকার খাবার খুব বেশি আকৃষ্ট করে। পাহাড়ি ঢালে জন্মানো বিভিন্ন কৃষি পণ্য ব্যবহার করে অথেনটিক স্টাইলে রান্না করা প্রতিটি খাবারই এই জেলার ঐতিহ্যকে বহন করে আসছে।
চলুন জেনে নেয়া যাক রাঙামাটি জেলার কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার সম্পর্কে।
১. মুরগির গুঁতাইয়া
রাঙামাটি অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার মুরগির গুঁতাইয়া। সাধারণত মুরগির মাংস মসলা দিয়ে রান্না করা হয় এবং এই মুরগির তরকারিকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় মুরগির গুঁতাইয়া। মসলা দিয়ে ঘেঁটে ঘুঁটে তৈরি করা হয় বলেই এর নামকরণ করা হয়েছে মুরগির গুঁতাইয়া।
রাঙামাটি ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে এই খাবারটি খুব বেশি স্পেশাল। সাধারণ মুরগির তরকারির মতো হলেও পাহাড়িদের অথেনটিক স্টাইলে রান্নার ফলে এই খাবারের আলাদা একটা স্বাদ পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘পিবির ভাত ঘর’ নামক খুবই সাধারণ একটা হোটেলে এই খাবারটির বেশ চাহিদা রয়েছে। পর্যটকেরা এই হোটেলে খেতে গেলে ‘মুরগির গুঁতাইয়া’ খাবারটি টেস্ট না করে আসেন না।
২. বাঁশের কোড়ল
রাঙামাটি জেলার সবথেকে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবার বাঁশের কোড়ল। রাঙামাটির সব ধরনের কাঁচাবাজারে আর কিছু না পাওয়া গেলেও বাঁশের কোড়ল থাকবেই। রাঙামাটি জেলার মানুষের কাছে বাঁশের কোড়ল নরমাল একটি সবজি হিসেবেই সমাদৃত। অতি সাধারণ পাহাড়ি গৃহস্থ বাড়ি থেকে শুরু করে রাঙামাটির নামকরা সব হোটেল গুলোতে নিয়মিত এই খাবারটি রান্না করা হয়। রাঙামাটি ঘুরতে গিয়ে বাঁশের কোড়ল খায়নি এমন লোক হয়তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
কচি বাঁশের কান্ডকে মূলত বাঁশ কোড়ল বলা হয়। কচি বাঁশ কেটে সেটাকে ছুলে ভেতরের নরম অংশ বের করে ফেলা হয়। তারপর সেই কোড়ল নিজের ইচ্ছে মতো কেটে বিভিন্ন মসলা দিয়ে রান্না করা হয়। তবে একদম মিহি করে কাটলে খেতে ভালো হয়। কেউ চিংড়ি দিয়ে রান্না করে, আবার কেউ মাংসের সাথে, কেউবা খেতে পছন্দ করে শুধু নিরামিষ। যেভাবেই রান্না করা হোক না কেন বাঁশের কোড়ল কিন্তু সবার কাছেই বেশ উপাদেয় একটি খাবার।
৩. এঁচোড় নিরামিষ
রাঙামাটির পাহাড়ি উপজাতি সহ সাধারণ মানুষের প্রিয় খাবার এঁচোড় নিরামিষ। কাঁচা কাঁঠালের তরকারিকে সাধারণত এঁচোড় বলা হয়। এঁচোড় কেউ রান্না করে মাংস দিয়ে কেউবা চিংড়ি দিয়ে আবার কেউ নিরামিষ। রাঙামাটি জেলায় নিরামিষ এঁচোড় রান্নার প্রচলন সবথেকে বেশি।
কাঁঠাল পরিপক্ক হওয়ার আগেই গাছ থেকে কেটে বাজারে নিয়ে যাওয়া হয় বিক্রির জন্য। রাঙামাটি জেলায় এই খাবারটি এতো বেশি প্রচলিত যে, এখানকার সব বাজারেই সিজনের সময় কাঁচা কাঁঠাল বিক্রি করা হয়।
কাঁচা কাঁঠাল কেটে ভাপিয়ে সিদ্ধ করে নেয়া হয়। সেদ্ধ কাঁঠালের পানি ঝড়িয়ে সব ধরনের মসলা কষিয়ে দিয়ে দেয়া হয় ভাপিয়ে রাখা কাঁচা কাঁঠাল। কেউ কেউ আবার সাথে আলুও দিয়ে থাকে৷ অনেক সময় নিয়ে সিদ্ধ করে রান্না করা হয় নিরামিষ এঁচোড়।
গরম ভাতের সাথে এঁচোড় নিরামিষ মাংসের স্বাদকেও হার মানায়।
৪. হাঙর শুটকি
রাঙামাটি সহ বাংলাদেশের বেশ কিছু উপকূলীয় ও পার্বত্য জেলায় হাঙর শুটকি বেশ জনপ্রিয়। সমুদ্র থেকে ধরা হাঙর মাছকে কেটে প্রসেসিং করে বাঁশের সাথে বেধে শুকোতে দেয়া হয়। মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করে বাজারজাত করা হয় বাংলাদেশ সহ বিদেশেও। রাঙামাটি জেলার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পাহাড়ি উপজাতি – সবার কাছেই হাঙর শুটকি খুব প্রিয় একটি খাবার। রাঙামাটি বেড়াতে আসলে সবাই-ই কম বেশি এই শুটকি কিনে নিয়ে যায়। এখানকার হোটেল গুলোতে স্পেশাল পদের মধ্যে হাঙর শুটকি অন্যতম।
হাঙর শুটকি সাধারণত ভুনা করে খাওয়া হয়। প্রথমে সিদ্ধ করে পানি ফেলে ভালোভাবে ধুয়ে বিভিন্ন মসলা দিয়ে ভুনা করা হয় এই শুটকি। গরম ভাতের সাথে হাঙর শুটকি ভুনার স্বাদ একদমই অসাধারণ।
৫. গুটি বেগুন
রাঙামাটি জেলার পাহাড়ি মাটিতে জন্মানো সাধারণ একটি সবজি গুটি বেগুন।জায়গা ভেদে ঐই সবজিকে তিত বেগুন, টিপ বেগুন বা বিটি বেগুনও বলে। পাহাড়িদের খুব প্রিয় খাবার এই গুটি বেগুন। গুটি বেগুন একদমই ছোট আকৃতির এবং দেখতে কিছুটা ডুমুরের মতো। কাটলে ভেতরটা দেখতে হয় বেগুনের মতো।
গুটি বেগুন সাধারণত ভর্তা করে খাওয়া হয়। কেউ কেউ ভাজি করে বা রান্না করে খেতেও পছন্দ করে। তবে গুটি বেগুন ভর্তাটাই সবথেকে বেশি জনপ্রিয়।
গুটি বেগুন পুড়ে বা ভেজে তার সাথে পেয়াজ ও মরিচ দিয়ে চটকে ভর্তা করা হয়। কেউ আবার শিল পাটায় বেটেও ভর্তা করে থাকে। সাধারণত গরম ভাতের সাথে গুটি বেগুন ভর্তা খাওয়া হয়।
৬. বিন্নি চালের ভাত
পাহাড়ি অঞ্চলে জুম চাষের মাধ্যমে বিন্নি চাল উৎপাদন করা হয়। রাঙামাটি অঞ্চলের পাহাড়ি খাঁজে খাঁজে উপজাতিরা জুম চাষ করে বিন্নি ধান উৎপাদন করে। সাধারণ চালের মতো এই চাল সিদ্ধ ধান থেকে তৈরি করা হয় না ফলে এর পুষ্টিগুণের কোনো তারতম্য ঘটে না। রাঙামাটি জেলায় উৎপাদিত বিন্নি চাল সাধারণত লাল ও কালো রঙের হয়।
এই বিন্নি চাল দিয়ে রান্না করা ভাতও হয় লাল অথবা কালো রঙের। দেখতে খুব বেশি আকর্ষণীয় না হলেও খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনই পুষ্টিগুনে ভরাপুর। রাঙামাটি জেলার মানুষের নিত্য দিনের খাবার তালিকায় থাকে বিন্নি চালের ভাত। এখন শুধু পাহাড়ি অঞ্চলেই নয়, বিন্নি চালের ভাত জনপ্রিয়তা পেয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই।
৭. বিন্নি চালের ভাপা পিঠা
নবান্ন উৎসবে রাঙামাটি জেলার ঘরে ঘরে ধুম পড়ে যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা পুলি তৈরি করার। বিন্নি চালের পিঠা পায়েস এই জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার। সব ধরনের পিঠার মধ্যে বিন্নি চালের ভাপা পিঠা খুব বেশি জনপ্রিয়। কালো বিন্নি চাল গুড়ো করে পিঠা তৈরি করা হয় বলে পিঠার রং হয় কালো। কালো বা লাল বিন্নি চালের গুড়ো, গুড় ও নারকেল দিয়ে ভাপে সিদ্ধ করে তৈরি করা হয় বিন্নি চালের ভাপা পিঠা। নবান্ন উৎসব সহ যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে বিন্নি চালের ভাপা পিঠা রাঙামাটি অঞ্চলকে আরও বেশি মাতিয়ে রাখে।
৮. সবজি সিদ্ধ
পাহাড়ি আদিবাসীদের নিত্য দিনের প্রচলিত একটি খাবার সবজি সিদ্ধ। সব ধরনের সবজি শুধু লবন দিয়ে সিদ্ধ করে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়। সবজির সাথে থাকে অথেনটিক রেসিপিতে তৈরি মরিচ ভর্তা। মরিচ ভর্তাটাই মূলত এই খাবারের স্বাদ আনে। সব ধরনের সবজি কোনো তেল ছাড়া সিদ্ধ করা হয় বলে এই খাবারের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। বর্তমানে শুধু পাহাড়ি আদিবাসীরাই নয় বরং সব অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছেই এই খাবারটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
৯. মুরগির ভর্তা
মুরগির মাংস সাধারণত রান্না করে খাওয়ার প্রচলনই সব থেকে বেশি। কিন্তু রাঙামাটি জেলার একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী খাবার মুরগির ভর্তা। মুরগির মাংস সিদ্ধ করে পেয়াজ মরিচ দিয়ে চটকে তৈরি করা হয় মুরগির মাংসের ভর্তা। পাহাড়িদের কাছে মুরগির মাংসের ভর্তা খুবই বিশেষ একটি সুস্বাদু খাবার। রাঙামাটির বিভিন্ন হোটেলে এই ভর্তা পাওয়া যায়, ফলে পর্যটকদের কাছেও মুরগি মাংসের ভর্তা খুব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
১০. মিষ্টি তেতুল
তেতুল সাধারণ টক স্বাদের হলেও রাঙামাটি জেলার পাহাড়ি জমিতে জন্মানো তেতুল হয় মিষ্টি স্বাদের। কিছু কিছু তেতুল পুরোপুরি মিষ্টি হয় আবার কোনোটা হয় হালকা টক মিষ্টি। পাহাড়ি মাটিতে জন্মানো তেতুল পুরোপুরি টক হয়না, ফলে আঞ্চলিক মানুষের পাশাপাশি বাংলাদেশের সব জেলার মানুষের কাছে এটি খুব প্রিয়। রাঙামাটি ঘুরতে গেলে কমবেশি প্রত্যকেই মিষ্টি তেতুল কিনে নিয়ে আসে। বানিজ্যিক ভাবে এখন মিষ্টি তেতুলের বিপণন হচ্ছে পুরো বাংলাদেশে।
রাঙামাটি জেলার আরও কিছু জনপ্রিয় খাবার হলো :
১. তাবা তোন
২. পাজন
৩. পাহাড়ি কলা
৪. সিদল দিয়ে সবজি সিদ্ধ
৫. নাপ্পি
৬. মাশরুম
৭. এঁচোড় নিরামিষ
৮. আনারস
৯. বাঁশে বসানো দই
১০. কাকড়া
১১. ছুড়ি শুটকি
১২. কুইচে মাছ (ইত্যাদি)