বাংলাদেশের প্রতিটি জেলারই নিজস্ব কিছু অথেনটিক ও ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে। এসব খাবার প্রত্যেকটা জেলার আলাদা আলাদা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বহন করে আসছে। যশোর জেলাও কিন্তু এদিক থেকে কম যায় না। এই জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ অতুলনীয়। আর এই জেলার বেশিরভাগ খাবারই উদ্ভব হয়েছে গ্রামের গৃহবধূদের হাত ধরে এবং তাদের মাধ্যমেই যশোর জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো এখনও টিকে আছে দেশীয় সংস্কৃতিতে।চলুন জেনে নেয়া যাক যশোর জেলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবার সম্পর্কে।
১. দুধ কদু
যশোর জেলার সাধারণ মানুষের খুবই জনপ্রিয় একটি মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার দুধ কদু। দুধ কদু মূলত দুধ ও লাউ দিয়ে তৈরি এক ধরনের ডেজার্ট আইটেম। লাউকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় কদু। সেই কদু আর দুধ দিয়ে রান্না করা হয় বলে এই খাবারের নাম হয়েছে দুধ কদু।
লাউকে তো সব অঞ্চলের মানুষ সবজি হিসেবেই খেয়ে থাকে। কিন্তু যশোর জেলার মানুষ শুধু সবজি রান্নাতেই সীমাবদ্ধ না রেখে লাউ রান্নায় নতুনত্ব এনেছে ‘দুধ কদু’ খাবারটির মাধ্যমে।
হাড়িতে দুধ জ্বাল করে ঘন করে নেয়া হয় প্রথমে। অন্যদিকে লাউকে খুব মিহি করে কেটে পানি ঝড়িয়ে নেয়া হয়। কড়াইয়ে ঘি দিয়ে লাউ ভেজে তার মধ্যে দুধ, চিনি, বাদাম, কিসমিস দিয়ে রান্না করা হয় বেশ কিছুক্ষণ। ঘন হয়ে গেলে নামিয়ে পরিবেশন করা হয় মজাদার দুধ কদু। যশোর অঞ্চলে জামাই আপ্যায়নে এই খাবারটি প্রাধান্য পায়।
২. হ্যালা
যশোরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে ‘হ্যালা’। হ্যালা এক ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার। বড়িতে দোয়া পড়ালে হুজুরের জন্য বিশেষ পদ হিসেবে রান্না করা হয় এই খাবারটি। হুজুর সহ অংশগ্রহণ করতে আসা প্রত্যেককেই খাওয়ার শুরুতে হ্যালা পরিবেশন করা হয়। হ্যালা সাধারণত রুটি দিয়ে খাওয়া হয়।
হ্যালা রান্না করা হয় আতপ চালের গুড়ো৷ খেজুরের গুড়, নারকেল, গরম মসলা, তেজপাতা ও লবন দিয়ে। সবগুলো উপকরণ হাড়িতে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ জ্বাল করা হয় পানি দিয়ে। জ্বাল করতে করতে আঠা আঠা হলে নামিয়ে পরিবেশন করা হয় মজাদার হ্যালা।
৩. সরুই পিঠা
যশোরের সাধারণ মানুষের কাছে খুবই প্রিয় খাবার সরুই পিঠা। যে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সরুই পিঠা প্রাধান্য পায় সবার আগে। যশোরের ঘরে ঘরে সরুই পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। রোজায় ইফতারে স্পেশাল আইটেম হিসেবে থাকে সরুই পিঠা। ইফতারিতে ক্ষেতের ধান দিয়ে ভাজা খই এর সাথে সরুই পিঠা পরিবেশন করা হয়।
পিঠার আকৃতি কিছুটা সরু হয় বলে এই পিঠার নামকরণ করা হয়েছে সরুই পিঠা।
চালের গুড়ো সিদ্ধ করে রুটির মতো কাই করে নেয়া হয় প্রথমে। সেই কাই চিকন চিকন করে নিয়ে ছোট ছোট আকৃতিতে সরু করে কাটা হয়। তারপর সেই পিঠা রান্না করা হয় খেজুরের গুড়, তেজপাতা ও পরিমান মতো লবন মেশানো শিরায়। যশোর জেলার সবার কাছেই সরুই পিঠা বেশ পছন্দের খাবার।
৪. রসের ক্ষীর
গাছ থেকে রস পেড়ে সুগন্ধি রস দিয়ে ক্ষীর রান্নার প্রচলন সব অঞ্চলেই কম বেশি আছে। যশোর জেলায়ও তার ব্যতিক্রম নয়। শীতের মৌসুমে যশোরের প্রতিটি ঘরে ঘরে রসের ক্ষীর তৈরির উৎসব লেগে যায়। গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়ে বাচ্চা বৃদ্ধ সব একত্রিত হয়ে উৎসব মূখর পরিবেশে রান্না করে ক্ষীর।
হাড়িতে রস জ্বাল করে তার মধ্যে দিয়ে দেয়া হয় সুগন্ধি চাল, তেজপাতা, নারকেল কোঁড়া। জ্বাল দিতে দিতে চাল ফুটে উঠলে একটু ঝোল ঝোল রেখে নামিয়ে ফেলা হয় চুলা থেকে। বাড়ির উঠোনে বসে পরিবারের সবাই একসাথে রসের ক্ষীর খাওয়া, এ যেন শীতের আমেজকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
৫. ছাক্কা
যশোর জেলার সামাজিক অনুষ্ঠানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ খাবার আইটেম ছাক্কা। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে কুলখানি – সব কিছুতেই ছাক্কা হলো প্রধান খাবার। অতিথিদের সবার প্রথমে ছাক্কা পরিবেশন করে তারপর মাছ, মাংস বা অন্যান্য সব আইটেমে পরিবেশন করা হয়।
ছাক্কা একটু শক্ত টাইপের হয়। ছাক্কা রান্না করা হয় খাসির চর্বি আর মুগডাল অথবা ছোলার ডাল দিয়ে। কড়াইয়ে সব মসলা কষিয়ে ডাল দিয়ে কিছুক্ষণ রান্না করা হয়। শেষের দিকে মোটা করে কেটে রাখা চর্বি দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ জ্বাল করা হয়। জ্বাল দিতে দিতে শক্ত হয়ে গেলে পরিবেশন করা হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ছাক্কা।
৬. ডিমের খাট্টা
ডিমের খাট্টা মূলত ডিম ও আমড়া দিয়ে রান্না করা হয়। বাড়িতে মেহমান আসলে আর কিছু রান্না হোক বা না হোক ডিমের খাট্টা রান্না করা হবেই। ডিমের খাট্টাকে অনেকে ডিম আমড়ার খাট্টাও বলে থাকে। পেটপুরে খাওয়ার পর শেষ পাতে ডিমের খাট্টা যেন খাওয়া দাওয়ার পরিপূর্ণতা নিয়ে আসে।
আমড়া ছুলে আস্ত আমড়া কেচে টক বের করে সিদ্ধ করা হয়। সাথে ডিমও সিদ্ধ করে রাখা হয়। করাইয়ে হলুদ মরিচ বাদে অন্যান্য মসলা দিয়ে কষিয়ে নারকেল দুধ, ডিম ও আমড়া একসাথে দিয়ে রান্না করা হয়। শেষ সময়ে হলাকা চিনি ও ভেজে রাখা পেয়াজ, রসুন ও জিরা বাটা দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নামিয়ে ফেলা হয়।
ডিমের খাট্টা যশোর জেলার মানুষের কাছে খুবই স্পেশাল একটি খাবার।
৭. চুইঝাল খাসির মাংস
যশোর ও খুলনা জেলায় চুইঝাল এর উৎপাদন অনেক ভালো হয়। তাই গরু কিংবা খাসির মাংসে চুইঝাল থাকবেই। চুইঝাল মাংসের স্বাদকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়। চুইঝাল দিয়ে খাসির মাংসের স্বাদ সবথেকে বেশি। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে এই পদটি থাকা চাই ই চাই। চুইঝাল এর আছে নিজস্ব একটি ঘ্রাণ যা তরকারিতে আনে আলাদা বৈচিত্র্য, এটা খেতে অনেকটা ঝাল স্বাদের হলেও এই ঝাল বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না।
চুইঝাল চিকন করে কেটে খাসির মাংসের সাথে রান্না করা হয়। সব মসলা দিয়ে খাসির মাংস কষিয়ে বেশ কিছুক্ষণ রান্না করে তার মধ্যে দিয়ে দেয়া হয় চুইঝাল। রান্না করতে করতে তরকারির রং কিছুটা কালচে বর্ন ধারণ করলে নামিয়ে ফেলা হয়। সম্পূর্ন রান্নায় একটুও পানি ব্যবহার করা হয় না। গরম ভাত, পোলাও, খিচুড়ির সাথে কষা চুইঝাল খাসির মাংসের স্বাদ একেবারে অমৃত।
৮. ছিটে রুটি
‘ছিটে রুটি আর কুকড়োর গোসত’ এ যেন যশোর জেলার মানুষের সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে আবহমান কাল ধরে। যশোরের মানুষ মুরগিকে বলে কুকড়ো, সেই মুরগির মাংস লাল করে ঝোল ঝোল রান্না করা হয়। মুরগির ঝোল দিয়ে খাওয়া হয় ছিটে রুটি।
আতপ চালের গুড়ো গোলা করে হাতের সাহায্যে বিশেষ কায়দায় কড়াইয়ে দিয়ে ভাজা হয় ছিটে রুটি। হাত দিয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ভাজা হয় বলে এই পিঠার নাম হয়েছে ছিটে রুটি। ছিটে রুটি ভাজার মাধ্য দিয়ে যশোর জেলার গৃহবধূদের গুনের পরিচয় ফুটে ওঠে। একদম পাতলা রুটি কিন্তু নরম তুলতুলে। বিশেষ কায়দা অবলম্বন না করতে পারলে এই রুটি নরম করা অসম্ভব।
বাড়িতে মেহমান আসলে বা নতুন জামাই আসলে গৃহস্থ বাড়ির মহিলারা মহা আয়োজন করে ছিটে রুটি বানাতে বসে পড়ে৷ মাটির চুলার একপাশে ভাজা হতে থাকে ছিটে রুটি অন্য পাশে রান্না করা হয় কুকরোর মাংসের লাল ঝোল।
শীতের সকালে গরম গরম মাংসের ঝোল দিয়ে সদ্য ভেজে ওঠানো ছিটে রুটি খাওয়ার মজাই অন্যরকম।
যশোর জেলার আরও বেশি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো :
১. হকদানা
২. কাঁঠাল বিচি দিয়ে কুকড়োর মাংস
৩. নারকেল দুধে ঘাটকোল
৪. ঘাটকোল-কাঁঠালের বিচি কষা
৫. দুধ কদু
৬. কাচি পোড়া পিঠা
৭. কুমড়া বড়ি
৮. খেজুরের গুড়
৯. ওলকচু দিয়ে মুরগির মাংস
১০. নারকেল দুধে ইলিশ মাছ (ইত্যাদি)