বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক শহর যশোর।যশোর খুলনা বিভাগের তৃতীয় বৃহত্তম শহর।ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটিতে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান।
যশোরের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান
ঐতিহাসিক নিদর্শন এর পাশাপাশি নির্মাণ করা হয়েছে ভ্রমন পিপাসুদের জন্য অসংখ্য পার্ক ও বিশেষ বিশেষ স্থাপনা।যশোরকে ফুলের রাজধানীও বলা হয়।কারণ বাংলাদেশের মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ ফুলের সরবরাহ করে এই অঞ্চলটি।
যশোর জেলার গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আমরা আজকে বিস্তারিত জানবো।
১. চাঁচড়া জমিদার বাড়ি
যশোর সদরে অবস্থিত চাঁচড়া জমিদার বাড়ি যশোর তথা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন। আনুমানিক ১৭০০ থেকে ১৮০০ শতকের দিকে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
অবসরে পরিবার পরিজন নিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা চলে আসে এই জমিদার বাড়িতে।
যদিও এই বাড়িটি এখন অনেকটা ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে কিন্তু স্থানীয়দের কাছে এখনও বেশ জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান এই চাঁচড়া জমিদার বাড়ি।বাড়িটিকে সংস্কার করে একটু পরিপাটি করলে তুলনামূলক আরও বেশি দর্শনার্থীদের ভিড় জমবে এই বিখ্যাত জমিদার বাড়িতে।
২. ফুলের রাজধানী গদখালি
যশোর সারা বাংলাদেশে ফুল সরবরাহের জন্য বিখ্যাত। যশোরের গদখালি বাজারে প্রতিদিন ৯০০ টি গ্রাম থেকে হাজার হাজার ফুল আসে।সেই ফুল সরবরাহ করা হয় পুরো বাংলাদেশে।
যশোর জেলার শিকড়গাছা ও শার্শা থানার মোট ৯০০ টি গ্রামে বানিজ্যিক ভাবে বিভিন্ন জাতের ফুলের চাষ হয়।
গ্রামগুলো মাঠে মাঠে আছে লাল হলুূদ ও অন্যান্য রঙের হরেক রকমের ফুল তার মধ্য দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। একবার ভাবুন তো ফুলের এই রাজ্যে ভ্যানে করে সারাদিন ঘুরতে কেমন লাগবে?
চারদিকে অসংখ্য ফুলের সৌন্দর্য, প্রজাপতির রাজ্য, ফুলের মৌ মৌ গন্ধ সে যেন এক অন্য রকম অনুভূতি।
যশোর বাস স্যান্ড থেকে গদখালি যাওয়ার বাস পাওয়া যায়।বাসে করে গদখালি নেমে ভ্যান ভাড়া করে ঘুরতে পারবেন ফুলে ফুলে সজ্জিত গ্রামের রাস্তাগুলোতে।
এক ঘন্টার জন্য ভ্যান ভাড়া ১০০ থেকে১৫০ টাকা হতে পারে।
৩. মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি ( মধুপল্লি)
বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি যশোর তথা বাংলাদেশের বিখ্যাত একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান।মধুসূদনের বাড়িটি যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত।এখানে শুধু স্থানীয় লোকজনই নয়, সারা বাংলাদেশ ও বিদেশ থেকেও হাজার হাজার দর্শনার্থী ভ্রমন করতে আসে বিখ্যাত এই বাড়িটিতে।
প্রাচীন জমিদার বাড়ির ধাচে গড়া এই বাড়িটিকে বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্রে রুপান্তর করা হয়েছে।
মধুপল্লিতে ঢুকতে হলে ১০ টাকা টিকেট মূল্য পরিশোধ করতে হবে। বিদেশি ট্যুরিস্ট দের জন্য এই টিকেট মূল্য ১০০ টাকা
এখানে গাড়ি পার্কিং এর জন্যও সুব্যবস্থা রয়েছে।
প্রতি রবিবার ও সরকারি ছুটির দিনগুলো মধুপল্লি পুরোপুরি বন্ধ থাকে। বাকি দিনগুলোতে সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে এই বাড়িটি।
মধুপল্লি যেতে চাইলে প্রথমে যশোর থেকে বাসে করে চলে যেতে হবে কেশবপুর। কেশবপুর নেমে সাগরদাঁড়ি যাওয়ার জন্য রিকশা পেয়ে যাবেন।রিকশায় সরাসরি পৌছে যাবেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি।
৪. যশোর পৌর পার্ক
যশোরের সবথেকে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পার্ক হলো যশোর পৌর পার্ক।১৮৬৪ সালে এই পার্কটি নির্মাণ করা হয়। প্রতিদনই অসংখ্য বিনোদনপ্রেমী দর্শনার্থী ঘুরতে আসে এই পার্কে।ছুটির দিনগুলোতে তো থাকে উপচে পরা ভীড়।
এই পার্কের মধ্যে আছে দুটো বড় বড় পুকুর এবং পুকুর দুটি একটি আরেকটির সাথে সংযুক্ত। এখানে এসে গোসল করতে পছন্দ করেন অনেকেই।আরও আছে বসার জন্য বেঞ্চ,নারিকেল বাগান ও সুসজ্জিত মাঠ।সবমিলিয়ে অসাধারণ একটি পরিবেশ পার্কের ভেতরে বিদ্যমান।
যশোর পৌর পার্কটি যশোরের একদম ঠিক প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত বলেই এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় অনেক বেশি।বিখ্যাত মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাবিদ্যালয়ের ঠিক পাশেই পার্কটি অবস্থিত।
৫. কালেক্টরেট পার্ক
যশোর কালেক্টরেট ভবনের পাশে ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত কালেক্টরেট পার্ক এখানকার স্থানীয় লোকজনের খুবই জনপ্রিয় একটি বিনোদন কেন্দ্র। পার্কটি সাজানো হয়েছে খুবই সুন্দর নকশায়।
এই পার্কে আসলে প্রাচীন স্থাপনার নিদর্শন হিসেবে কালেক্টরেট ভবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। আছে বিভিন্ন পশুপাখির ভাষ্কর্য, কৃত্রিম ঝর্না ,ফুলের বাগান।সবমিলিয়ে অসাধারণ পরিবেশ নিয়ে বিদ্যমান এই পার্কটি সবারই অবসরের প্রিয় জায়গা।
কালেক্টরেট পার্কটি একদম যশোর জেলা শহরে অবস্থিত হওয়ার যশোর শহরের যে কোনো জায়গা থেকে রিকশা করে সরাসরি চলে আসতে পারবেন কালেক্টরেট পার্কের সামনে।
৬. বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক
যশোরের উল্লেখযোগ্য পার্কগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি পার্ক হলো বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক।১৯৯৮ সালে জনপ্রিয় এই পার্কটি নির্মাণ করা হয়।যে কোনো বয়সের মানুষের জন্য খুবই উপভোগ্য একটি দর্শনী স্থান বিনোদিয়া পার্ক।
এখানে বাচ্চাদের খেলার জন্য আছে বিভিন্ন রাইড,মিনি চিড়িয়াখানা, বিভিন্ন ধরনের ভাষ্কর্য, বাগানসহ আকর্ষণীয় আরও অনেক কিছু। পিকনিকের জন্যও আছে সুব্যবস্থা। যেমনঃ ডাইনিং প্লেস, কিচেন,কার্পেট ইত্যাদি।
বিনোদিয়া পার্কের টিকেট মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা এবং ছোটদের জন্য ১০ টাকা।বিভিন্ন রাইডে উঠতে চাইলে টিকেট মূল্য ১০ টাকা থেকে ২০ টাকার মধ্যেই।
যশোর সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে যশোর ক্যান্টনমেন্ট এর শানতলা নামক স্থানে বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক অবস্থিত।যশোর থেকে রিকশা বা ইজি বাইকে করে প্রথমে চলে যেতে হবে পলবাড়ি মোড়ে।সেখান থেকে আবার ইজিবাইকে করে সরাসরি চলে যেতে পারবেন বিনোদিয়া পার্কের প্রবেশ গেটে।
৭. যশোর বোট ক্লাব
অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাতছানি দিয়ে ভ্রমণপিয়াসী মানুষকে ডাকে যশোর বোট ক্লাব।চারদিকে জঙ্গলে ভরা নিরব প্রাকৃতিক পরিবেশ।সুবিশাল লেক।লেকে ভেসে বেড়ানোর জন্য বড় বোট,ছোট ডিঙি। সুন্দর সুসজ্জিত উদ্যান।মিনি চিড়িয়াখানার বিভিন্ন পশুপাখি।সবমিলিয়ে সে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ হ্যাঁ, এটাই যশোর বোট ক্লাব।
যশোর এয়ারপোর্ট এর পেছনে জেলা শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে জনপ্রিয় এই বোট ক্লাবটি অবস্থিত।ক্যান্টনমেন্ট এলাকা হওয়ার সরাসরি এয়ারপোর্ট থেকে বোট ক্লাবে যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই।বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্কের বিপরীতে রাস্তায় পার হয়ে রেললাইন ক্রস করে গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয় বোট ক্লাবে। বিনোদিয়া পার্ক থেকে ইজি বাইকে করে সরাসরি পৌছে যেতে পারবেন বোট ক্লাবে।ভাড়া পড়বে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকার মধ্যে।
৮. ঝাঁপা ভাসমান সেতু
সেতু যদি হয় কোনো খুঁটি বা পিলার ছাড়া তবে কেমন হয়?
এমন সেতুর কথা কি কখনও কল্পনা করেছেন?
হ্যাঁ, বলছি যশোরের ঝাঁপা বাওরের ওপর নির্মান করা ভাসমান সেতুর কথা।এই সেতুটির কোনো পিলার বা খুটি নেই।পুরো সেতুটি ভেসে আছে প্রায় ৮৩৯ টি নীল রং-এর ভাসমান ড্রামের ওপর।
এটি বাংলাদেশের বিষ্ময়কর একটি স্থাপনা, যার দৈর্ঘ্য ১৩০০ ফুট।নীল রং-এর ভাসমান ড্রামের ওপর স্টিলের পাত ফেলে নির্মাণ করা হয়েছে সতুটি, যার পাশে নিরাপত্তার জন্য রেলিং দেয়া হয়েছে।সেতুটুতে উঠলে আপনার অন্যরকম এক রোমাঞ্চ অনুভূত হবে।প্রতিদিন অসংখ্য কৌতুহলী দর্শনীয় চলে আসে এই ভাসমান সেতুর টানে। তারই ধারাবাহিকতায় এখানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি পিকনিক স্পটও।
ভাসমান এই সতুতে ওঠার অনুমতি নেয়ার জন্য আপনাকে ৫ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
বিখ্যাত এই ভাসমান সেতুটি যশোর জেলার মনিরামপুরের ঝাঁপা হাওরের ওপর অবস্থিত।
৯. মীর্জা নগর জমিদার বাড়ি
যশোরের ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলোর মধ্যে মীর্জা নগর জমিদার বাড়ি খুবই জনপ্রিয় ও উল্লেখযোগ্য। এই বাড়িটি কবে নির্মাণ করা হয়েছে তার কোনো সঠিক তথ্য খুজে পাওয়া যায়নি। তবে মনে করা হয় মোঘল আমলে কোনো এক জমিদার এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিল।
বাড়িটির সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই বাড়ির গোসলখানা আরবিতে যাকে বলে হাম্মাম খানা।কারন তখনকার আমলে এই বাড়ির মতো আধুনিক গোসলখানার কথা কেউ কিন্তাও করেনি।তাছাড়া আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই বাড়ির কুয়া।
যশোর জেলার বেশবপুর উপজেলায় বিখ্যাত এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর যশোর শহরের প্রত্যকটা দর্শনীয় স্থান আপনার মনকে নাড়া দিতে সক্ষম। যশোরে ট্যুর প্লান করলে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য এই স্থানগুলোর কথা মাথায় রাখবেন।