ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ, ম্যালেরিয়া হলে করণীয় ও চিকিৎসা

পৃথিবীতে মশকীবাহিত সবচেয়ে প্রাচীনতম রোগগুলোর একটি হলো ম্যালেরিয়া। আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের মানুষ যেমন এই রোগের  মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে, সেই সাথে সেখানে এই রোগের কারণে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আবার ভারত, মায়ানমার ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ এই রোগের বেশ ভালোই ঝুঁকিতে আছে। কাজেই ম্যালেরিয়া যে একটি প্রাণঘাতী রোগ তা বলাই বাহুল্য। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিবছর প্রায় বিশ কোটিরও অধিক মানুষ ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে  সমগ্র বিশ্বে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ২০১৬ সালের ঘটনা। প্রতিবছরই এই প্রাণনাশী ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। 

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই ম্যালেরিয়া রোগ থেকে বাঁচতে এবং ম্যালেরিয়া হলে প্রয়োজনীয় সঠিক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করতে আর্টিকেলটি পড়া একান্ত প্রয়োজন। কেননা আর্টিকেল পড়া শেষে আপনি যেসব বিশয় জানবেন-

  • ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুর নাম কি
  • ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ
  • ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু কোথায় বাসা বাঁধে
  • ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকার
  • ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ
  • ম্যালেরিয়া হলে করণীয় ও চিকিৎসা

ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুর নাম কি? 

ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু প্লাজমোডিয়াম গণভুক্ত। ১৮৮০ খ্রীস্টাব্দে চার্লস ল্যাভেরন, যিনি একজন ফরাসি ডাক্তার, সর্বপ্রথম ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর লাল রক্ত কণিকা থেকে ম্যালেরিয়ার পরজীবী আবিষ্কার করেন। এরপর ১৮৯৭ সালে স্যার রোনাল্ড রস, যিনি তখন ভারতে কর্মরত ছিলেন একজন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ডাক্তার, আবিষ্কার করেন যে Anopheles গণভুক্ত মশকীরা হলো এ রোগের বাহক। যার ফলে রোগটির জীবাণু একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দোহে বিস্তার লাভ করে থাকে। 

এটি ছিলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, যার ফলে তিনি ১৯০২ সালে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। 

মূলত ম্যালেরিয়া রোগটি হলো একধরণের জ্বররোগ যা Anopheles মশকী দ্বারা এর প্রভাব বিস্তার করে। ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুটি প্রোটিস্টা রাজ্যের স্পোরোজোয়া শ্রেণির Plasmodium গণের অন্তর্ভুক্ত। 

ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ 

মূলত যখন কেউ ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয় তখন সাধারণ কিছু লক্ষণের মাধ্যামে আমরা তা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি।  ম্যালেরিয়া হলে যেসব লক্ষণাদি দেখা দেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো: 

নির্দিষ্ট সময় পরপর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা ম্যালেরিয়া রোগের প্রধান লক্ষণ। 

এই জ্বর সাধারণত ১০৪-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যাক্তির শীত অনুভূত হওয়া, কাঁপুনিসহ জ্বর আসা সাধারণ লক্ষণ। 

তবে ম্যালেরিয়া হলে শুরুর দিকে মাথাব্যাথা, পেশিতে ব্যাথা, বমিভাব, ক্ষুধামন্দা, অনিদ্রা, এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্যসহ নানা ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়। 

আক্রান্ত ব্যাক্তির জ্বর আসা যাওয়া করে একটা প্যাটার্ণে যেমন -নিয়মিত ও নির্দিষ্ট সময় পরপর, সেটা হতে পারে একদিন পরপর বা প্রতি ২ থেকে ৩ দিন পরপর।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায় ফলে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়ার সুযোগ থাকে।

মাত্রাতিরিক্ত ঘাম হওয়া, কাপুঁনি-খিঁচুনি, ক্লান্তি বা অবসাদ, তৃষ্ণা অনুভব করা, মাংসপেশি ও তলপেটে ব্যথা অনুভব হয়ে থাকে।

ম্যালেরিয়া হলে লোহিত রক্তকণিকা ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়। যার কারণে রোগীর দেহে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।

এই রোগের সবচেয়ে জটিলতম ধরন যা ‘ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া’ নামে পরিচিত, এটিতে আক্রান্ত রোগীর দেহে সাধারণ ম্যালেরিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।

রোগীর অবস্থা জটিল পর্যায়ে পৌঁছালে বা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্তান্ত হলে রোগীর দেহে- জন্ডিস, রক্তশূন্যতা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, কিডনি বিকল হওয়া, খিঁচুনি, রক্তে গ্লুকোজ হ্রাস ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়। 

উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব হলে জ্বর অবস্থা  ৬ মাস বা তার বেশি দিন ধরেও চলতে পারে। সেই সাথে শারীরিক জটিলতার দরুণ রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, এমন কি মৃত্যুও হতে পারে।

ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু কোথায় বাসা বাঁধে?

ম্যালেরিয়ার মতো রোগ যেটি কিনা স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশকী দ্বারা ছড়ায়,  এই রোগের জীবাণুর প্রধান বাসস্থান মশকীর দেহ। ম্যালেরিয়া জীবাণু হিসেবে পরিচিত এই প্লাজমোডিয়াম পরজীবীটির বাস মূলত মশকীর পৌষ্টিক নালি, লালাগ্রন্থিতে এবং মানুষসহ বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীর লোহিত কণিকা ও যকৃত কোষে। মশকীর কামড়ের মাধ্যমে এর লালার দ্বারা জীবাণুটি ছড়ায়। 

ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকার

বলা হয়ে থাকে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। কাজেই ম্যলেরিয়ার মতো মশকীবাহিত রোগ প্রতিরোধ করার মাধ্যমে এর থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। 

ম্যালেরিয়া রোগটির প্রতিকারের জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করা আবশ্যক তা নিয়ে এখন আমরা আলোচনা করবো:

১। মশকী নিধনই ম্যালেরিয়া প্রতিকারের প্রথম ও প্রধান উপায় বলা যায়। কিন্তু প্রকৃতি থেকে মশকশ্রেণিকে সমূলে উৎপাট করা সম্ভব নয় বৈকি। তবে এদের বিস্তার রোধ করার মাধ্যমে এর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।  সেক্ষেত্রে – মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। 

২। মশকীরা জমে থাকা ময়লা, পচা পানিতে ডিম পাড়ে। তাই আমাদের সবার উচিত নিজেদের বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখা, যেনো কোথাও পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা। পাশাপাশি যেকোনো পরিত্যক্ত ডোবা অথবা নালা পরিষ্কার রাখা, যেখানে সেখানে পানি জমতে না দেওয়া, বাসা-বাড়ির আশপাশের আগাছা, জঙ্গল, ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা ইত্যাদি। 

৩। পচা পানিতে ম্যালেরিয়া রোগবাহিত মশকীর ডিম ফুটে লার্ভা, পিউপা জন্ম হয়। তাই সেসব যায়গায় কীটনাশক ছিটিয়ে দিলে লার্ভা,পিউপা মারা যায় এবং পূর্নাঙ্গ মশায় রূপান্তরিত হতে পারে না। ফলে মশার বিস্তার রোধ করার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করা যায়।

৪। মশা তাড়ানোর আরেকটি উপায় হলো ফগিং মেশিনের মাধ্যমে সালফার ডাই-অক্সাইডের ধোয়া সৃষ্টি করা।  ইদানীং আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় এরূপ ধোঁয়ার মাধ্যমে মশা তাড়ানোর প্রক্রিয়া দেখা যায়, যার কার্যকারিতার তুলনায় বায়ু দূষণ ও শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। ফলে এটি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থাকে। 

ম্যালেরিয়া জ্বর হলে করণীয় ও চিকিৎসা

ম্যালেরিয়া হলে রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগেই তাকে যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে হবে। নতুবা জীবন সংশয় দেখা যাবে।  

দ্রুত রোগ শনাক্ত করে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব।  যদিও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি তথাপি  রোগটি সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা অসম্ভব নয়। 

ম্যালেরিয়া হলে যা করা উচিত –

১। ম্যালেরিয়া হলে খাবারের প্রতি অনীহা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে রোগীকে হালকা  ও তরল খাবার দেওয়া উচিত।

২। ডাবের পানি খেতে হবে। পানিশূন্যতা কমাতে বেশি করে স্যালাইন  খেতে হবে।

৩। আক্রান্ত ব্যাক্তিকে মশার কামড় থেকে দূরে রাখতে হবে। 

রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে হবে।  

৪। অনেকেই ক্লোরোকুইন, কুইনাইন জাতীয় ওষুধ খাওয়া পরামর্শ দিয়ে থাকে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন না করাই ভালো।

৫। ম্যালেরিয়ার যেহেতু বিভিন্ন ধরণ রয়েছে এবং মানুষের বয়স, লিঙ্গভেদে ও শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ডাক্তার বুঝতে পারবেন তার জন্য সঠিক চিকিৎসা কোনটা। কাজেই ম্যালেরিয়া হলে দেরী না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই জরুরি। 

৬। সবশেষে, ম্যালেরিয়ার মতো মশকীবাহিত রোগগুলো সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা নির্মূল ও সঠিক জ্ঞান বিস্তারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে। মিডিয়া কভারেজের পাশাপাশি ব্যাক্তিগত উদ্যোগেও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই সংক্রান্ত কর্মশালার আয়োজন করাও ম্যলেরিয়ার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির একটি বড় মাধ্যম হতে পারে।

আসুন আমরা সবাই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সোচ্চার হই। 

Scroll to Top