মিশরের দর্শনীয় স্থানের তালিকা এবং ইতিহাস, ভাষা, আয়তন, ধর্ম, অর্থনীতি

পিরামিডের দেশ মিশর আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত একটি আরব রাষ্ট্র। মিশর মূলত আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে এবং এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এটি একটি আন্তঃমহাদেশীয় ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্র। সরকারিভাবে দেশটির নাম মিশর আরব প্রজাতন্ত্র। বিশ্বের প্রসিদ্ধ ইতিহাসের মধ্যে মিশরের ইতিহাস সবথেকে বেশি প্রাচীন ও সমৃদ্ধশীল।

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে এই অঞ্চলে। তবে আধুনিক মিশর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৬ সালে এবং আধুনিক মিশরেরর রাজধানীর নাম কায়রো। মিশরের মোট আয়তন ১০,০২,৪৫০ বর্গ কিলোমিটার বা ৩,৮৭,০৫০ বর্গ মাইল। আয়তনের দিক থেকে দেশটি বিশ্বের ৩০ তম বৃহত্তম দেশ। ২০০৯ সালের আনুমানিক হিসেব মতে মিশরের জনসংখ্যা ৭৭,৪২০,০০০।

সারা বিশ্বে মিশর জনসংখ্যার দিক থেকে ১৩তম সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র। উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র মিশর। সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর জন্য মিশর পুরো বিশ্বে বেশ সুপরিচিত।

মিশরের ভৌগোলিক অবস্থান

মিশরের ভৌগোলিক অবস্থান মূলত দুটি প্রধান অঞ্চলের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি হলো উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া। মিশরের প্রায় বেশিরভাগ অঞ্চলই মরুভূমি অঞ্চল।দেশটির মোট জমির শুধুমাত্র ৩৫,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় চাষাবাদ হয় এবং মানুষের স্থায়ী বসতি নির্মিত।

মানে মোট ভূখন্ডের শতকরা ৩.৫ ভাগ অঞ্চল ব্যবহারযোগ্য। মিশরের পশ্চিমে সীমান্তে লিবিয়া, উত্তর-পূর্ব দিকে গাজা উপত্যকা এবং দক্ষিণ দিকে সুদানের সীমান্ত অবস্থিত। দেশটির উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে মিশরের দীর্ঘতম সরলরেখার দূরত্ব ১,০২৪ কিলোমিটার বা ৬৩৬ মাইল এবং পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে দূরত্ব ১,২৪০ কিলোমিটার ৭৭০ মাইল।

ভূপ্রকৃতিগত দিক থেকে বিবেচনা করলে মিশরের ভূখন্ডকে প্রধান তিনতি অঞ্চলে ভাগ করা যায়।যাথা: নীল উপত্যকা এবং নীল ব-দ্বীপ, পশ্চিম মরুভূমি যা নীল নদী থেকে লিবিয়ার সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত, পূর্ব মরুভূমি যা নীল উপত্যকা থেকে লোহিত সাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সিনাই উপদ্বীপ। এদিক থেকে মিশরের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বেশ বৈচিত্র্যতা লক্ষ করা যায়।

মিশরের ইতিহাস

মিশরের ইতিহাস বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ইতিহাস হিসেবে এখনও বিবেচিত হয়।মিশরে প্রথম মানব বসতি স্থাপন করা হয় প্রায় ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং এই বসতি গড়ে উঠেছিল নীল নদের উপত্যকায়। মিশরে প্রথম রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং দেশটির প্রথম রাজবংশের নাম ফারাও। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে মেসিডেনীয়ান শাসক আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট মিশর দখল করেন এবং হেলেনীয় টলেমাইক রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দ থেকে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিশরে রোমান সাম্রাজ্যের শাসন চলমান ছিল। এর পরবর্তীতে মুসলিম শাসকদের হাতে রোমনদের পতন ঘটে এবং মিশরে মুসলিম শাসনামল শুরু হয়। ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রা.-র যুগে সেনাপতি হযরত আমর ইবনুল আস রা. এর মিশর জয় করেন। এরপর থেকে মিশরে ইসলামিক শাসনের ধারা অব্যাহত থাকে ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।

ইসলামি শাসনামলের মধ্যে ছিল খেলাফতে রাশেদা, উমাইয়া খেলাফত, আব্বাসী খেলাফত, ফাতেমী খেলাফত, আউয়ুবী সালতানাত, মামলুক সালতানাত এবং উসমানী শাসন। এর পরে মিশর একটি নামমাত্র স্বায়ত্তশাসিত ট্রিবিউটারি রাজ্যে পরিণত হয এবং এর নাম দেওয়া হয়েছিল মিশরীয় খেদিভেত।

১৮৮২ সালে মিশর ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে এবং পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯১৯ সনে সংঘটিত মিশরীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোহাম্মদ আলী রাজবংশের হাতে ‘মিশর-রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত মিশরে ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত রাখার চুক্তি হয়। তবে ১৯৫৩ সালে আধুনিক গণপ্রজাতন্ত্রী মিশর প্রতিষ্ঠা হয় এবং ব্রিটিশরা সম্পূর্ণরূপে মিশর ছেড়ে যায় ১৯৫৬ সালে। ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তির পর থেকেই মিশর সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হয় এবং নিজস্ব শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত হতে থাকে।

মিশরের জাতীয় পতাকা

মিশরের জাতীয় পতাকা তিনটি আনুভূমিক ডোরা এবং মাঝখানে সোনার ইগলের চিত্র খচিত। ধারাবাহিক ভাবে তিনটি রঙের সমন্বয়ে পতাকাটির জমিন গঠন করা হয়েছে, যাথা: লাল, সাদা এবং কালো। সাদা ডেরার মাঝখানে সোনালি রঙের ঈগলের চিহ্ন অঙ্কিত আছে।

পতাকাটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ৩:২। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই মিশরের বর্তমান পতাকাটির সর্বশেষ নকশা প্রনয়ণ করা হয়। পতাকার লাল রং উপনিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিশরীয়দের রক্তের প্রতীককে বহন করে। সাদা রং মিশরীয়দের হৃদয়ের বিশুদ্ধতার চিহ্নকে তুলে ধরে। এবং সাদার নিচে কালো রঙটি অন্ধকারকে জয় করার পদ্ধতির প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়।

মিশরের প্রচলিত ভাষা

মিশরের জাতীয় ভাষা আরবি এবং দেশটির প্রায় সিংহভাগ লোকই আরবি ভাষায় কথা বলে। সরকারি দপ্তর, অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব জায়গাতেই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আরবি ভাষার কথ্য ও লিখিত রূপ একচেটিয়া ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন আলাদা আলাদা আরবি আঞ্চলিক কথ্য ভাষার ব্যবহার করে আসছে। শুদ্ধ আরবি ভাষা শুধুমাত্র সাহিত্য ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপেই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

মিশরের শিক্ষিত সমাজের বেশিরভাগ লোকজন আরবির পাশাপাশি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় পারদর্শী হয়। তাছাড়া বিভিন্ন আঞ্চলিক ছোটখাটো ভাষা এবং বিদেশী ভাষাভাষীর লোকজনও এই দেশে বসবাস করে। যেমন মিশরের পূর্ব মরুভূমির দক্ষিণ অংশের কিছুসংখ্যক লোক একটি আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা ব্যবহার করে যা টো বেদাউই নামে পরিচিত।

অন্যদিকে পশ্চিম মরুভূমির সিওয়া মরুদ্যানে এমন কিছু গোষ্ঠী রয়েছে যাদের ভাষা আফ্রো-এশিয়াটিক পরিবারের সাথে কিছুটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। আবার নুবিয়ানরা পূর্ব সুদানিক ভাষায় কথা বলে। এরকম ছোটখাটো ভাষার সংমিশ্রণের ফলে মিশরের ভাষাগত সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে বেশ বৈচিত্র্যময়।

মিশরের নাগরিকদের ধর্ম বিশ্বাস

ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মীয় রীতিনীতি এবং ধর্মীয় অনুভূতি মিশরীয় সমাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে৷ মিশরের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশই মুসলমান ধর্মের অনুসারী। দেশটির মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ লোক ইসমাল ধর্ম অনুসরণ করে ।

মুসলমানদের মধ্যে বেশিরভাগই সুন্নি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। বাকি শতকরা ১০ ভাগের ৯ ভাগ লোক কপটিক অর্থোডক্স খ্রিস্টান হিসাবে পরিচিত এবং অবশিষ্ট ১ ভাগ জনগন খ্রিস্টান ধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়ের অনুসারী। একই ভূখন্ডে অবস্থিত আলাদা আলাদা সম্প্রদায়ের লোকজন বেশ শান্তিপূর্ণ ভাবে মিশরে বসবাস রয়েছে।

মিশরের অর্থনীতি

মিশরের অর্থনীতি তুলনামূলক ভাবে বেশ সমৃদ্ধশীল অর্থনীতি। নাইজেরিয়ার পরে আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক কাঠামো রয়েছে মিশরের। দেশটি ২০২২ সালে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বব্যাপী র‍্যাঙ্কিংয়ে ৪১ তম অবস্থানে ছিল। মিশরের অর্থনীতি অনেকটাই শিল্প খাতের ওপর নির্ভরশীল।

মিশরের উল্লেখযোগ্য শিল্প গুলো হলো: পর্যটন, টেক্সটাইল উৎপাদন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, হাইড্রোকার্বন, রাসায়নিক পণ্য, ওষুধ, নির্মাণ শিল্প, সিমেন্ট ও ধাতু উৎপাদন ইত্যাদি। মিশরের অর্থনীতিতে কৃষিখাতেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মিশরে উৎপাদিত অন্যতম কৃষিপণ্য গুলো হলো: তুলা, চাল, গম, ভুট্টা, আখ, বিট, পেঁয়াজ, তামাক এবং মটরশুটি ইত্যাদি। এছাড়াও পরিবহন, শিক্ষা ও সেবাখাতও দেশটির অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মিশরের অর্থনীতি মূলত অভ্যন্তরীন উৎপাদনের উপর গুরুত্বারোপ করে। তবুও বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে মিশরের ব্যবসায়ীক সম্পর্ক রয়েছে। মিশর এর প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, স্বর্ন সহ বেশ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ। দেশটি কয়েকটি দেশ থেকে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে। আমদানির ক্ষেত্রে মিশরের সাথে সম্পর্কযুক্ত দেশ হলো: ইতালি, জার্মানি, সৌদি আরব, ভারত এবং তুরস্ক।

মিশরের আবহাওয়া ও জলবায়ু

মিশরের জলবায়ু সাধারণত শুষ্ক, গরম এবং মরুভূমি দ্বারা প্রভাবিত। অঞ্চলভেদে দেশটিতে বৈচিত্র্যময় জলবায়ু লক্ষ করা যায়। দেশটিতে গ্রাষ্ম ও শীত এই দুইটি ঋতুর প্রভাব লক্ষ করা যায়।তবে উপকূলীয় অঞ্চলে খুব অল্প পরিমাণে বৃষ্টিপাত হতেও দেখা যায়। উপকূলীয় অঞ্চলে শীতকালে গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত শীতকাল স্থায়ী হয়। মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকালের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে দেশটির অভ্যন্তরীণ মরু অঞ্চলের তাপমাত্রা নাটকীয়ভাবে ওঠানামা করতে থাকে। অভ্যন্তরীণ মরুভূমি অঞ্চলে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে, যেখানে রাতে 7 ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে দিনে 43 ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে।

শীতকালে, মরুভূমিতে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায় এবং দিনের বেলায় তা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ​​পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। গ্রীষ্মের সময়ে দিনের বেলা তাপমাত্রা ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার রেকর্ড আছে। মিশর প্রায়ই গরম বাতাসের ঝড়ের সম্মুখীন হয়, যা “খামসিন” নামে পরিচিত।

এই ঝড়ের সময় উপকূলীয় বালি লোকালয়ে উড়ে আসে এবং সেই সাথে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। কখনও কখনও এই দুর্যোগ ৬ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই খামসিন ঝড় সাধারণত মার্চ এবং মে মাসের মধ্যে ঘটতে দেখা যায়। মিশরে সবথেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয় আলেকজান্দ্রিয়া শহরে।এই শহরে বছরে আনুমানিক ২০০ মিমি বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে কায়রো শহরে প্রতি বছর ১০ মিমি এর একটু বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।

মিশরের সংস্কৃতি

মিশরের সংস্কৃতি বেশ প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। মিশরের আধুনিক সংস্কৃতির মূল শেকড়ও প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতির সাথে একতাবদ্ধ। মিশরের নাগরিকরা মূলত শান্তিপ্রিয় এবং একে অপরের সাথে গভীর মেলবন্ধন তৈরি করে বসবাস করে। তবে মিশরের সংস্কৃতিতে অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব নেই বললেই চলে।

মিশরে বসবাসরত মোট জনসংখ্যার ৯৯.৬ ভাগই মিশরীয় জাতি তাই দেশটির সংস্কৃতি সব অঞ্চলেই একই ধাচের। মিশরীয়দের চরিত্রে ও সমাজিক মূল্যবোধে সম্মান বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিশরীয়রা তাদের সামনের ব্যক্তিটির ব্যক্তিত্ব, পেশাক আশাক, আচার আচরন ও বয়স বিবেচনা করে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন। পারিবারিক ভাবেও পরিবারের প্রধানকে বিশেষ সম্মান দেয়া হয়।

শিক্ষার দিক থেকে মিশর খুবই এগিয়ে আছে। অভিভাবকগন তাদের আয়ের বড় একটি অংশ তাদের সন্তানদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় করেন। আর এ কারনেই বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মিশরের নাগরীকরা নিজেদের অনেক বেশি দক্ষ্য করে তুলতে পেরেছে।

মিশরের পুরুষেরা সাধারনত জুব্বাহ, পাগড়ি বা গুত্রা এবং গালাবিয়া নামক একধরনের পোশাক পরিধান করেন। এবং মহিলারা প্রধানত শীথ নামক এক ধরনের বিশেষ পোশাক পরেন যা থোব নামেও পরিচিত। মিশরীয় নারীদের পোশাকের তালিকায় জনপ্রিয় হলে হিজাব বা হেডস্কার্ফ।

মিশরের উৎসব গুলোর মধ্যে ইসলাম ধর্মের অনুষ্ঠান গুলো সবথেকে বেশি জনপ্রিয়। যেমন: ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা এবং পবিত্র মাহে রমজান।

মিশরের নাগরিকদের খাদ্যাভ্যাস

মিশরের খাদ্যতালিকায় তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলোই সবথেকে বেশি প্রাধান্য পায়। তবে বর্তমানে স্ট্রিট ফুডের সহজলভ্যতা বেশ ভালো হওয়ায় বিদেশী খাবারের ওপরেও তাদের চাহিদা বেড়েছে। মিশরের অথেনটিক খাবার তৈরিতে সাধারণত মুরগির মাংস, লেবু, সবজি, চাল, বিভিন্ন ধরনের ডাল, প্রাকৃতিক ফল ও মসলার ব্যবহার করা হয়।ভেড়া ও গুরুর মাংস খাওয়ার প্রচলনও রয়েছে, তবে উচ্চমূল্য এবং সহজলভ্যতার অভাবে মাংসের বদলে নিরামিষ খাবারই বেশি প্রচলিত।

উপকূলীয় অঞ্চল গুলোতে মাছ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। মিশরের জনপ্রিয় বেশ কিছু খাবার হলো: মলোখিয়া, ফাত্তাহ, ফ্যালাফেল, কোশারী, মেসাকাহ, মোম্বার, ফেসিখ ইত্যাদি। মিশরের জাতীয় পানীয় হলো চা। মিশরের জনপ্রিয় মিষ্টির মধ্যে রয়েছে বাকলাওয়া, বাসবৌসা এবং কুনাফা।মিশরীয়রের ডেজার্ট জাতীয় খাবারের সাধারণ উপাদানের মধ্যে রয়েছে খেজুর, মধু, বাদাম ইত্যাদি।

মিশরের দর্শনীয় স্থান

প্রাচীন ফারাওদের আবাসস্থল মিশর যা পিরামিডের দেশ নামেও পরিচিত। বিশ্বের আশ্চর্য সব স্থাপত্য কর্মের মধ্যে মিশরের পিরামিড একটি। এছাড়াও উপভোগ করার জন্য আছে বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন, বিলাসবহুল শহরের জৌলুশ, মন ভোলানো সমুদ্র সৈকত, মরুভূমির বালুকাময় প্রান্তরসহ বিভিন্ন রিসোর্ট, পার্ক ও জাদুঘর। একজন পর্যটককে সন্তুষ্ট করতে প্রায় সব ধরনের পর্যটন কেন্দ্রই আছে এই দেশে। মিশরের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান সমূহ হলো-

১. পিরামিড

প্রাচীন বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে গিজার পিরামিড অন্যতম। প্রাচীন ফারাওদের শেষ চিহ্ন হিসেবে এখনও বিদ্যমান আছে বিশ্ব বিখ্যাত পিরামিড। মূলত আশ্চর্যজনক এই পিরামিডের জন্যই মিশর পৃথিবীর বুকে এতো বেশি সুপরিচিত । পর্যটকদের মিশর ভ্রমনের প্রথম ও প্রধান আকর্ষণই থকে গিজার পিরামিড।

২. লুক্সর শহর

মিশরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী লুক্সর। এই শহরে ফারাও রাজাদের অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন যুক্ত বাড়িঘর, প্রাসাদ রয়েছে। আছে ফারাও রাজার উপত্যকা এবং সাধারণ মানের বেশ কিছু ছোটখাটো ঘরবাড়ি । বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন একসাথে পরিদর্শন করতে চাইলে চলে যেতে হবে লুক্সর শহরে।

৩. নীল নদ

মিশরকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলে প্রথমেই নীল নদের উদাহরনটি আগে চলে আসে। ক্রুজ বোট নিয়ে নীল নদের পানিতে ভাসিতে ভাসতে তীরের বিখ্যাত সব স্থাপত্যশৈলী দেখার অভিজ্ঞতা সবারই ভালো লাগবে। বিশেষ করে লুক্সর শহরের প্রাচীন পুরাকীর্তি সমূহের সৌন্দর্য নীল নদ থেকেই সবথেকে বেশি উপভোগ্য।

৪. আসওয়ান শহর

মিশরের সবথেকে শান্ত ও মনোরম পরিবেশের শহর আসওয়ান। বোট ভাড়া করে শহরটির এলিফ্যান্টাইন দ্বীপে গিয়ে উপভোগ করতে পারবেন নুবিয়ান গ্রামের মনোরম পরিবেশ।উটে চড়ে আসওয়ানের পূর্ব তীরে সেন্ট সিমিওনের মরুভূমিতে চলে যেতে পারবেন। এছাড়া শহরের মধ্যে অবস্থিত হেটেল ও রেস্তোরাঁ গুলোতে আরামদায়ক সময় কাটাতে পারবেন৷

৫. লোহিত সাগর

ডাইভিং এর জন্য অসাধারণ স্পট লোহিত সাগর। এর তলদেশের সামুদ্রিক শৈবালের প্রাচীর যে কোনো ডুবুরিকে মুগ্ধ করতে সক্ষম। আরও দেখতে পারবেন কোরাল, রঙিন রিফ মাছ, হাঙ্গর, ডলফিন, কচ্ছপ, রশ্মি এবং এমনকি ডুগং পর্যন্ত। ডাইভ সাইটগুলির মধ্যে ডাইভিংয়ের জন্য নিকটতম স্পট মার্সা আলমের রিসোর্টটি ঘুরে দেখতে পারেন।

৬. ইসলামিক কায়রো

এই অঞ্চলটিতে অসংখ্য প্রাচীন ও নতুন ধাচের মসজিদ, মাদ্রাসা দেখতে পাবেন।বিখ্যাত খান এল-খালিলির গোলকধাঁধা এই শহরেই অবস্থিত। আরও আছে বেশ কিছু শপিং মল এবং লাইব্রেরি। ইসলামি করায়রোতে দেখার মতো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মসজিদ হলো : আল-আজহার মসজিদ এবং জমকালো সুলতান হাসান মসজিদ।

৭. দক্ষিণ সিনাইয়ের সমুদ্র সৈকত

sinai, egypt

সিনাই সমুদ্র সৈকতের বালুকাময় প্রান্তর এবং আশেপাশের রিসোর্ট গুলোর জন্য দক্ষিণ সিনাইয়ের সমুদ্র সৈকত ভ্রমন বেশ আনন্দদায়ক।সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল পানি এবং রিসোর্ট গুলোর চমৎকার সৌন্দর্য উপভোগ না করলে মিশর ভ্রমনই বৃথা।

৮. সাক্কারা

গীজার পিরামিড ছাড়াও মিশরে অসংখ্য ছোট বড় পিরামিড আকৃতির প্রাচীন সমাধি রয়েছে। সাক্কারা অঞ্চলের ওল্ড কিংডম স্টেপ পিরামিড এদিক থেকে বেশ জনপ্রিয়।

৯. হোয়াইট ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্ক

এটি মিশরের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত সাদা বালুর মরুভূমি। এখানে আসল চকের চূড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি ক্যাম্পিং এর দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন।

নীল নদ ও পিরামিড এর দেশ মিশর বিশ্বের একটি সুপরিচিত স্বাধীন রাষ্ট্র। সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত, অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশটি নিজেকে উল্লেখ্যযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

Scroll to Top