মিনি কক্সবাজার, চাঁদপুর | যাওয়ার উপায়, খরচ, দর্শনীয় স্থান

কক্সবাজার না গিয়েও কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়ার মতো অনুভূতির কথা কয়েকবছর আগে কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু এখন সত্যিই আপনি কক্সবাজার না গিয়েও কক্সবাজার এর ফিল নিতে পারবেন। ২০১৮ সালে চাঁদপুরের মেঘনার চর সোস্যাল মিডিয়ায় বেশ ঝড় তোলে।

এরপর থেকে এটি মিনি কক্সবাজার হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। বালুকাময় নদীর তীর ও খরস্রোতা নদীর ঢেউয়ের কারনে জায়গাটিকে কক্সবাজারে সাথে তুলনা করা হয়েছে। সময় ও অর্থের অভাবে যারা এখনও পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যেতে পারেননি তারা চলে যেতে পারেন চাঁদপুরের মিনি কক্সবাজারে।

নদী, নৌকা, বালুচর সব মিলিয়ে এক অসাধারণ পরিবেশ। যদিও এখানে তেমন কোনো পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি কিন্তু স্বপ্ন ট্যুরিজম নামক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কিছু বেঞ্চ ও রঙিন ছাতা স্থাপন করা হয়েছে।

যার ফলে এটি অনেকটাই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতো দেখতে মনে হয়। তাছাড়া বর্তমানে নামাজের জন্য একটি মসজিদ স্থাপন করা হয়েছে। আছে একটি দোকান ও শৌচাগার। তাই আপনি নিশ্চিন্তে হাতে একদিন সময় নিয়ে খুবই অল্প সময়ে মিনি কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসতে পারেন।

মিনি কক্সবাজার কোথায় অবস্থিত?

চাঁদপুর জেলার রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে মিনি কক্সবাজার অবস্থিত। চাঁদপুর জেলা শহর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান। পদ্মা নদী, মেঘনা নদী ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় প্রকৃতির আপন নিয়মে এই চরটি জেগে উঠেছে। স্থানীয় ভাবে এটি পদ্মার চর, মেঘনার চর, বালু চর ইত্যাদি নামে পরিচিত। চরের দক্ষিণ দিকে চাঁদপুর জেলা শহরের পুরো ভিউ পাওয়া যায় আর উত্তরে শরিয়তপুরের কিছুটা অংশ দেখা যায়।

মিনি কক্সবাজার ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

ভরা শীত মৌসুম মিনি কক্সবাজার ভ্রমণের উপযুক্ত সময়৷ তবে গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত এখানে লোকসমাগম ঘটে। কিন্তু বর্ষায় নদীর পানি বেশ উত্তাল থাকে এবং চরের অধিকাংশ জায়গা পানির নিচে চলে যায়। তাই বর্ষার সময় মিনি কক্সবাজার ভ্রমণ করা যায় না।

এছাড়াও যে কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্ভাবনা থাকলে ঐ সময়টাতে মিনি কক্সবাজার ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়। আর দিনের যে কোনো সময় না গিয়ে হয়তো খুব ভোরে আর না হলে বিকেলের দিকে মিনি কক্সবাজার যাওয়া উচিত। কেননা দুপুরের প্রখর রোদে ঘুরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবেন না।

কীভাবে যাবেন মিনি কক্সবাজার

প্রথমেই আপনাকে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে চাঁদপুর জেলা শহরে পৌঁছাতে হবে। ঢাকার সায়দাবাদ থেকে প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত চাঁদপুরের উদ্যেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। পদ্মা এক্সক্লুসিভ পরিবহন প্রতি ৩০ মিনিট পর পর চাঁদপুরের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে।

জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা।
তাছাড়া ঢাকার সদরঘাট ও নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ ঘাট থেকে নিয়মিত চাঁদপুরের উদ্যেশ্যে লঞ্চ ছেড়ে যায়। নিয়মিত বিরতি দিয়ে এই লঞ্চগুলো সারাদিন ব্যাপী এই রুটে চলাচল করে। তাই চাইলে নৌপথে কম সময়ে ও কম খরচে চাঁদপুর চলে যেতে পারেন।

চাঁদপুর পৌঁছে ১০ থেকে ১৫ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে ‘বড় স্টেশন’। এখান থেকে নৌকা, ট্রলার বা স্পিডবোট ভাড়া করে সরাসরি চলে যাবেন মিনি কক্সবাজার। সাধারণ দিনে আপ ডাউন মিলিয়ে জনপ্রতি ট্রলার ভাড়া ভাড়া ৫০ টাকা। এবং বিশেষ কোনো ছুটির দিনে ভাড়া ১০০ টাকা। যাওয়ার সময়ই মাঝি পুরো ভাড়া রেখে দেয়। তাই আসার সময় যে কোনো একটি ট্রলারে চেপে চলে আসলেই হবে। তখন আর ভাড়া দিতে হবে না।

মিনি কক্সবাজার এর আকর্ষণ সমূহ

বড় স্টেশন থেকে ট্রলারে আসার সময়-ই আপনি ভ্রমনের প্রথম রোমাঞ্চ অনুভব করতে পারবেন। উত্তাল নদীর বুকে ছোট একটি নৌকা দুলদুল করে সামনের দিকে আগাচ্ছে। নৌকাটা কখনও এপাশে কাত হচ্ছে আবার কখনও অন্যপাশে কাত হচ্ছে। এটা আসলেই একটি দারুণ এডভেঞ্চার।

তাই মিনি কক্সবাজার পৌঁছানোর আগেই নৌকা ভ্রমনের একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা হবে আপনার। আবার ফিরে যাওয়ার সময়েও এই একই রোমাঞ্চকর মুহুর্ত অনুভব করার সুযোগ হবে।

তিন নদীর মোহনায় অবস্থিত বলে মেঘনার চর এর যে দিকে চোখ যায় দেখবেন শুধু পানি আর পানি। আর চরের কিনারা গুলো একদম স্বচ্ছ বালুতে আচ্ছাদিত বিধায় একে সমুদ্র সৈকতের মতোই দেখা যায়। বালুচরে খালি পায়ে হাঁটার সময় নদীর স্রোত এসে আছড়ে পড়বে আপনার পায়ে।

তবে এই স্রোতের পুরোটুকুতেই থাকবে পরিষ্কার মিঠা পানি। কখনও কখনও কচুরিপানা ছুটে চলে আসবে আপনার পায়ের কাছে। চাইলে দলবল নিয়ে নদীর পানিতে হুটোপুটি করতে পারবেন। চরের একদিকে উত্তাল পদ্মার ঢেউ ছুটে আসছে আর বিপরীত দিকে মেঘনা নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালুচরে।

এই ঢেউয়ের মাঝে গা ভাসিয়ে দিতে না পারলে তো আসল মজাই পাবেন না। চাইলে সাতার কাটতে পারবেন নদীর তীরে৷ আর নদীর পানি সমুদ্রের মতো লবনাক্ত ও বালু মিশ্রিত নয় বলে এখানে গোসল করেও দারুণ মজা পাবেন।
চরের পাশে নদীর ধার ঘেসে বসানো হয়েছে কয়েকটি বেঞ্চ আর ওপরে দেয়া আছে রঙিন ছাতা৷

এই বেঞ্চে শুয়ে বা বসে নদীর সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। পা ঝুলিয়ে বসলে নদীর ঢেউ এসে লাগবে আপনার পায়ে। দেখতে পাবেন দূরে ডিঙি নৌকা নিয়ে মাছ ধরছে জেলেরা। আবার কখনও চোখে পড়বে কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে নদীর বুক চিরে।

একদম অলস একটি বিকেল কাটিয়ে দিতে পারবেন নদীর ধারের বেঞ্চে বসে বসে। মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য এরচেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে? বেঞ্চের পাশেই দেখতে পাবেন ডাবের কাদি নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতা। চাইলে ডাব খেতে খেতে আরও কিছুটা অবসর সময় কাটাতে পারবেন।

মিনি কক্সবাজার এর আরেকটি আকর্ষণ হলো সূর্যাস্তের দৃশ্য। নদীর বুকে সূর্য ডুবে যাচ্ছে আর চারদিকে আধার ঘনিয়ে আসছে। ঠিক এই সময়ে আপনি দাড়িয়ে আছেন পদ্মা মেঘনার মিলনস্থলে। বিষয়টা কল্পনা করে দেখুন কতোটা মনোমুগ্ধকর লাগছে। সূর্যাস্তের এই অসাধারণ দৃশ্য না দেখে মিনি কক্সবাজার থেকে চলে আসা একদমই ঠিক হবে না।

চরের মধ্যে কেথাও কোথা ঝাউগাছ দেখতে পাবেন। বালুকাময় চরে হাঁটতে হাঁটতে ছবি তোলার মতো চমৎকার একটি জায়গা হবে এই ঝাউবন। তাই এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে যেতে মন তো চাইবেই। বেঞ্চের ওপর বসে ছবি তুললেও হয়তো অনেকের ভ্রম হবে যে আপনি বোধহয় কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসলেন৷

নদীর পানিতে হুটোপুটি শেষ করে পুরো চর ঘুরে আসার পরেও হয়তো আপনাদের হাতে কিছুটা সময় থাকতে পারে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে একটি ডিঙি নৌকা ভাড়া করে নদীর বুকে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াতে পারেন৷ নৌকা নিয়ে চরের চাদিকে ঘুরতে ঘুরতে নতুন ভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।

মোটকথা প্রকৃতির মাঝে একটা দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাটানোর জন্য মিনি কক্সবাজার আদর্শ একটি পর্যটন কেন্দ্র। তাই কম খরচে পরিবার-পরিজন নিয়ে অল্প সময়ে ঘুরে আসতে চাইলে অবশ্যই একবার মিনি কক্সবাজার যেতে পারেন। এতে করে আপনারও সময় এবং অর্থের সাশ্রয় হলো আর কক্সবাজার ভ্রমণের একটি চমৎকার অনুভূতি-ও নেওয়া হলো।

থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা

ঢাকা থেকে কম সময়ে ঘুরে আসা যায় বলে থাকার প্রয়োজন হয় না বললেই চলে। তবুও কেউ থাকতে চাইলে চাঁদপুর জেলা শহরে গিয়ে থাকতে হবে। সেখানে মাঝারি থেকে সাধারণ মানের বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল পাবেন৷ আর খাওয়ার জন্যও আপনাকে চাঁদপুর জেলা শহরে পৌঁছাতে হবে।

এখানে ভালো মানের অনেক খাবার হোটেল পাবেন। চাঁদপুর গেলে পদ্মার ইলিশ না খেয়ে কিন্তু ফিরবেন না৷ চরে বসে খেতে চাইলে সাথে হালকা কিছু খাবার রাখতে পারেন। আর চরে অবস্থিত দোকান থেকেও টুকটাক কিছু কিনে নিতে পারবেন।

মিনি কক্সবাজার ভ্রমণে সতর্কতা
১. সাতার না জানলে গোসলের সময় নদীর বেশি গভীরে যাবেন না।
২. ট্রলার চলাকালীন সময়ে ট্রলারের পাশে গিয়ে বসবেন না।
৩. ট্রলারে ওঠার সময় সাবধানে মই ব্যবহার করে উঠবেন।
৪. বেশি সময় থাকার পরিকল্পনা করলে সাথে শুকনো খাবার, মিনারেল ওয়াটার, সানগ্লাস, হ্যাট নিয়ে আসবেন।
আপনার মিনি কক্সবাজার ভ্রমণ সুন্দর ও সুপরিকল্পিত হোক। ধন্যবাদ।

Scroll to Top