মহেশখালী ভ্রমণ গাইড এবং দর্শনীয় স্থানের তালিকা

চট্টগ্রামের কক্সবাজার জেলা সদর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মহেশখালী উপজেলা চট্টগ্রাম বিভাগের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন এলাকা। এটি একটি দ্বীপ উপজেলা যেখানে একটি কিংবা দুইটি নয় বরং অনেকগুলো পর্যটন কেন্দ্র একসাথে রয়েছে ঘুরে দেখার জন্য।

সমুদ্র সৈকত, পাহাড়ি এলাকা,আধুনিক প্রতিষ্ঠানসহ ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান সবই একসাথে দেখার সৌভাগ্য হবে মহেশখালী ভ্রমনের মাধ্যমে। মহেশখালী বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বিশাল সম্ভার নিয়ে পর্যটকদের হাতছানি দিতে থাকে।

মহেশখালী উপজেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

দ্বীপ এলাকা হলেও বদরখালী ব্রীজ নির্মাণের সুবাদে উপজেলাটি মূল ভূখন্ডের সাথে সড়কপথে মিলিত হয়েছে। প্রতি বছর দেশি বিদেশি পর্যটকের আনাগোনায় মুখরিত থাকে মহেশখালী দ্বীপটি। আজকের আয়োজনের মাধ্যমে মহেশখালী উপজেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান সমূহের সাথে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি জানতে পারবেন মহেশখালী যাওয়ার উপায় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ তথ্য।

১. মাতার বাড়ী সমুদ্র সৈকত

মহেশখালী উপজেলার মাতার বাড়ী নাম স্থানে অবস্থিত সমুদ্র সৈকত একদমই নিরিবিলি পরিবেশে মনোরম প্রকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য উপযুক্ত একটি পর্যটন কেন্দ্র। অন্যান্য সমুদ্র সৈকতের সাথে এর মূল পার্থক্য হলো জনসমাগমের বিষয়টি। এখানে জনসমাগম একদমই কম বলে চমৎকার নিরব একটি পরিবেশে সমুদ্রের মন ভোলানো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। সেই সাথে দেখতে পারবেন সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য।

২. মাতার বাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র

মাতার বাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র মূলত বাংলাদেশের একটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় অবস্থিত। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের যান্ত্রিক পদ্ধতি দেখার পাশাপাশি এখানে চমৎকার একটি প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন। বিশেষ করে সন্ধ্যার সূর্যাস্তের দৃশ্য আপনাকে শিহরিত করবেই।

৩. লিডারশীপ ইউনিভার্সিটি কলেজ

মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটা পৌরসভায় অবস্থিত লিডারশীপ ইউনিভার্সিটি কলেজ একটি অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ। কলেজের মূল ভবন থেকে শুরু করে এর সামনের লেন, বাগান, মাঠের চারদিকে বসার ছোট ছোট বেঞ্চ সবমিলিয়ে অসাধারণ এক পরিবেশ। আরও আছে বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য কিছু রাইডস সহ একটি কিডস জোন। মহেশখালী ভ্রমণে গেলে লিডারশীপ ইউনিভার্সিটি কলেজের সৌন্দর্য উপভোগ করে আাসা উচিত।

৪. আদিনাথ ও গোরকঘাটা জেটি

মহেশখালী উপজেলার মূল দুই প্রবেশদ্বার আদিনাথ ও গোরকঘাটা জেটি। এই জেটি থেকে স্পিডবোট ও ইঞ্জিন বোটের মাধ্যমে সরাসরি কক্সবাজার জেলা সদরে যাতায়াত করা যায়। পেছনে আদিনাথ পাহাড় সামনে বিজাল জলরাশির এক অনবদ্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন এই জেটিতে বসে। রাতের জ্যোৎস্না মাখা জলরাশি এক মায়ার ভূবন তৈরি করে এখানে। সোলার প্যানেলের আলোয় জেটির সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে। ২০০৬ সালে আদিনাথ জেটি এবং ১৯৮৬ সালে গোরকঘাটা জেটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

৫. লবন মাঠ

গোড়কঘাটা নদী থেকে খাল কেটে সমুদ্রের লবনাক্ত পানি লবন মাঠের কাছে এনে জমিয়ে রেখে লবন চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে লবন উৎপাদন করা হয়। আর পুরো প্রক্রিয়াটি দেখতে হলে চলে যেতে হবে মেহেশখালীর লবন মাঠে। যেদিকে চোখ যায় শুধু স্তুপ করে রাখা লবনের সমারোহ আর অন্যদিকে চলতে থাকে লবন চাষিদের কাজ। এটি একটি লবন উৎপাদন কারখানা হিসেবে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও সমাদৃত।

৬. শুটকি মহাল

মহেশখালী উপজেলার আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান হলো শুটকি মহাল যেখানে বিশাল পরিমাণ জায়গা নিয়ে স্তরে স্তরে মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করা হয়। পুরো একটি বালুচর জুড়ে দেখা যায় শুধু শুকোতে দেয়া মাছের বহর। এমন একটি পরিবেশে উপস্থিত হয়ে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না।জানতে পারবেন শুটকি তৈরির অজানা তথ্য, পরিচিত হতে পারবেন জানা অজানা বিভিন্ন প্রকারের শুটকির সাথে আর নিজের জন্যও কম দামে কিনে নিতে পারবেন অথেকটিক শুটকি।

৭. গোরকঘাটা জমিদারবাড়ী

মহেশখালী উপজেলার অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন গোরকঘাটা জমিদারবাড়ী। প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর এক অনবদ্য উদাহরন এই জমিদার বাড়িটি। মহেশখালী ভ্রমনে পছন্দের তালিকার শীর্ষে এই স্পটটি প্রাধান্য পায়।

৮. সোনাদিয়া দ্বীপ ও সমুদ্র সৈকত

মহেশখালী জেলার সবথেকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র সোনাদিয়া দ্বীপ। তিন দিক থেকে বেষ্টিত সমুদ্র সৈকত, পরিষ্কার বালুচর, সামুদ্রিক পাখি, জীববৈচিত্র্য ও শুটকি মহালের জন্য এই দ্বীপটি বিখ্যাত। মাত্র ৯ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে বিদ্যমান এই দ্বীপে একান্ত নিজস্ব ভাবে নিরিবিলি পরিবেশে কিছুটা সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা সত্যিই রোমাঞ্চকর।

৯. ধলঘাটা হাঁসের চর

মহেশখালী উপজেলার একদম দক্ষিণ দিকে প্রাকৃতিক ভাবে জেগে উঠা বিশাল একটি দ্বীপ ধলঘাটা হাঁসের চর। অতীতে এই চরে অসংখ্য অতিথি পাখি ও বুনো হাসের বিচরণ ছিল বলে এর নাম হয়েছে হাঁসের চর। সুন্দর পরিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকত, অসংখ্য ঝাউ গাছ আর প্যারাবনে বেষ্টিত এই দ্বীপটিতে রয়েছে অনেক জীববৈচিত্র্য যার মধ্যে লাল কাঁকড়া উল্লেখযোগ্য।

১০. মৈনাক পাহাড়

মহেশখালী দ্বীপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ মৈনাক পাহাড়। সবুজে ঘেরা পাহাড়ে ট্রেকিং করতে করতে পেছন ফিরে তাকালে দেখা মিলবে সুবিশাল সমুদ্র সৈকত ও জলরাশি। পাহাড়ের খাদে খাদে দাড়িয়ে থেকে পুরো দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন সেই সাথে কানে ভেসে আসবে শো শো বাতাসের শব্দ ও সমুদ্রে গর্জন। সব মিলিয়ে এ যেন এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

মহেশখালী দ্বীপে যাওয়ার উপায়

মহেশখালী যেহেতু কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা তাই মহেশখালী দ্বীপে যেতে হলে প্রথমে আপনাকে কক্সবাজার জেলা শহরে আসতে হবে।
ঢাকা থেকে বা অন্যান্য জেলা থেকে সড়কপথে সরাসরি কক্সবাজার আসতে পারবেন। ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে কক্সবাজার পৌছানো যায়।


ঢাকার বিভিন্ন বাস স্টেশন থেকে সৌদিয়া, এস আলম, গ্রিন লাইন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী, সোহাগ, সেন্টমার্টিন হুন্দাই সহ বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিস ঢাকা টু কক্সবাজার রুটে চলাচল করে। এসব বাসের ভাড়া তাদের সার্ভিস অনুযায়ী ৯০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করে।


বাংলাদেশ বিমান, নভোএয়ার, ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস নিয়মিত ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। বিমান ভাড়া সুযোগ সুবিধা ও ক্লাস ভেদে ৪৫৯৯ টাকা থেকে ১২০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

কক্সবাজার থেকে নদীপথে বা সড়কপথে বদরখালী ব্রীজ হয়ে মহেশখালী যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে নদীপথে যাওয়া সহজ এবং কম সময়ে পৌছানো যায়। কক্সবাজারের যে কোনো স্থান থেকে ৬ নং ঘাটে মহেশখালী জেটিতে পৌছে সেখান থেকে ট্রলার বা স্পিডবোট ভাড়া করে সরাসরি মহেশখালী পৌছাতে পারবেন। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা।


সড়কপথে যেতে চাইলে প্রথমে কক্সবাজার থেকে চকরিয়া পৌছে সেখান থেকে বদরখালী ব্রীজ হয়ে মহেশখালী যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে সময় লাগবে দেড় ঘন্টার মতো। যাত্রা পথে মহেশখালী জেটি দেখতে পারবেন। তবে নদীপথে এডভেঞ্চার মিস করতে না চাইলে মহেশখালী জেটি হয়ে নদীপথে যাওয়াই ভালো।

দ্বীপের বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখার জন্য রিকশা, ইজিবাইক বা অটো ভাড়া করে বিভিন্ন স্পটে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে স্থানভেদে ভাড়া ৭০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা :

মহেশখালীতে থাকা জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল পাবেন এবং হালকা খাবার দাবারের জন্য ছোটখাটো দোকান বা খাওয়ার হোটেল পাবোন। তবে কক্সবাজার থেকে যেহেতু দূরত্ব খুব বেশি নয় তাই দিনে দিনে ঘোরাফেরা শেষ করে কক্সবাজার ফিরে আসাই ভালো।

সমুদ্র, পাহাড় ও ক্ষুদ্র শিল্পে সমৃদ্ধ দ্বীপ মহেশখালী যা বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য একটি পর্যটন এলাকা। কক্সবাজার ভ্রমনে গেলে একটু হাতে বেশি সময় নিয়ে মহেশখালী দ্বীপ ভ্রমণ করে আসলে এক দারুণ এডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। অল্প সময়ে কম খরচে একই সাথে এতোগুলা পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করাটা বোকামি বললে ভুল হবে না। প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের জন্য মহেশখালী একটি উপযুক্ত পর্যটন এলাকা।

Scroll to Top