আমি একজন কলেজ ছাত্র। আমার বাসা খুলনা ।আমাদের কলেজের বার্ষিক বনভোজন হয়ে থাকে প্রতিবছর। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিবছর চেষ্টা করা হয় নতুন কোন জায়গায় শিক্ষা সফর বা বনভোজনের উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য। এ বছর আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম খুলনার পাশের জেলা সাতক্ষীরার একটি দর্শনীয় স্থান “মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট” যেটাকে সবাই “মন্টু মিয়ার বাগানবাড়ি” হিসেবে চেনে সেখানে আমরা এবার যাব ।এই নামে বাগানটি বহুকাল ধরে পরিচিত । আমরাও অনেকদিন ধরে নামটি শুনে আসছিলাম। তাই এখানে যাওয়াটাই শ্রেয় হবে বলে মনে করলাম।
মন্টু মিয়ার বাগান বাড়ির পরিচয়
সাতক্ষীরা জেলায় ১২০ বিঘা জায়গা জুড়ে ১৯৮৯ সালে জনাব কে. এম খাইরুল মোজাফফর (মন্টু) এই মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট স্থাপন করেন । নিরিবিলি পরিবেশ এবং প্রশান্তিময় এই স্থানটি সারা বাংলাদেশের দর্শন প্রিয় মানুষদের মনকে সহজেই আকৃষ্ট করে ।মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্টে থাকার জন্য চারটি ভবনে রয়েছে মোট ৩০ টি কক্ষ। জাঁকজমকপূর্ণ এই ভবন গুলোতে যে কক্ষ রয়েছে সেগুলো তে রয়েছে আধুনিক জীবন যাপনের সমস্ত সুযোগ সুবিধা।
কিভাবে মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্টে যাওয়া যাবে
খুলনা থেকে সাতক্ষীরা যাওয়ার বাসে করে যাওয়া যাবে সাতক্ষীরা পর্যন্ত। খুলনা থেকে সাতক্ষীরা বাস ভাড়া ১৩০ টাকা ।সাতক্ষীরার নারিকেলতলা মোড়ে নামতে হবে ।সেখান থেকে ইজিবাইক রিজার্ভ করে নিয়ে যেতে হবে মন্টু মিয়ার বাগানবাড়ি ।এক্ষেত্রে ইজিবাইকে ভাড়া নিতে পারে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। কোন কোন চালক ভাড়া বেশি কম নিতেও পারে।
মন্টু মিয়ার বাগানবাড়ির ভেতরে যে যে সুযোগ সুবিধা রয়েছে
“মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট” এর ভেতরের জায়গাটি বেশ বড় । আমি আগে যেমনটি বললাম মোট ১২০ বিঘা জমির উপরে অবস্থান করছে বাগান বাড়িটি ।বর্তমানে এই বাগান বাড়ির জায়গা বাড়ানোর জন্য কাজ চলছে ।সাতক্ষীরার মূল শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে এই বাগান বাড়িটি অবস্থিত হওয়ায় খুবই নির্জন এবং নিরব একটি পরিবেশ বিরাজ করে সব সময়। এই জন্য শীতের মৌসুমে দর্শনার্থীদের আগমন বেড়ে যায়। বাগান বাড়িটির ভেতরে রয়েছে বেশ কিছু লেক।
লেকে রয়েছে প্যাডেল বোট এবং মাছ ধরার ব্যবস্থা। পর্যাপ্ত বোট রয়েছে এখানে ।একসাথে চার থেকে পাঁচ জনও এক একটি বোট নিয়ে উপভোগ করতে পারে ।একেকজনের জন্য ৩০ মিনিট করে সময় বরাদ্দ থাকে। এছাড়া এর ভেতরে আরও রয়েছে মিটিং ও কনফারেন্স রুম।
এখানে চাইলে আপনি মিটিং করতে পারবেন আপনজন নিয়ে অথবা ব্যবসার উদ্দেশ্যে। বাগানবাড়িটির ভেতরে আরো যা যা রয়েছে তা হল মাছের অ্যাকুরিয়াম, চিড়িয়াখানা ,থ্রিডি থিয়েটার, ভাস্কর্য, কিছু রাইড, চিল্ড্রেন পার্ক, খেলার মাঠ। মাঝে মাঝে আরো কিছু বিনোদনের ব্যবস্থাও যুক্ত করা হয় অস্থায়ী বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ।
চাইলে অতিথিরা এখানে রাকেট এবং টেনিসও খেলতে পারেন। অর্থাৎ ভেতরে খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। আরেকটি সুন্দর যে ব্যবস্থাটি আমার চোখে পড়েছে সেটা হল পুরুষ ও নারীদের জন্য পৃথক মসজিদের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে পুরুষ এবং মহিলা আলাদাভাবে নামাজ আদায় করতে পারবে। মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট এর চিড়িয়াখানাটিকে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি চিড়িয়াখানা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
এটা সাতক্ষীরা বাসীদের জন্য একটি গর্বের বিষয়। এই চিড়িয়াখানায় রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পশু পাখি এবং জীবজন্তু ।এদের মধ্যে কিছু রয়েছে দেশী এবং কিছু রয়েছে বিদেশে ।যে সকল প্রাণী রয়েছে এখানে তার মধ্যে অন্যতম হলো ভাল্লুক ,অজগর সাপ, চিত্রাহরিণ, ম্যাকাও পাখি ,বানর, উটপাখি ,শিমপাঞ্জি ,গুইসাপ ,সজারু এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
তাদের কিচিরমিচিরে পুরো বাগানটি সবসময় ভরা থাকে। খুবই আনন্দের ব্যাপার হলো পিকনিকের জন্য এখানে সর্বমোট 105টি টেকনিক স্পট রয়েছে । সংখ্যাটি সত্যিই অনেক বড়। একসাথে একশো পাঁচটি গ্রুপ এখানে পিকনিকের আয়োজন করতে পারবে।
এই রিসোর্ট এর রেস্টুরেন্টে রয়েছে সকল প্রকার দেশী এবং চাইনিজ খাবারের ব্যবস্থা। অনেক বিদেশিও এখানে ভ্রমনের উদ্দেশ্যে আসে ।তাদের জন্যই এই ব্যবস্থা করা। এখানে আগত দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে খুবই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং গাড়ি পার্কিং সুবিধা।
মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্টে আমার অভিজ্ঞতা
আমরা কলেজ থেকে বনভোজনের উদ্দেশ্যে এই মন্টু মিয়ার বাগান বাড়ি ঠিক করেছিলাম ।শুক্রবার সকালে আমরা আমাদের ঠিক করা বাসে করে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে খুলনার সোনাডাঙ্গা হতে রওনা দিলাম। খুলনা থেকে সাতক্ষীরা যাওয়ার রাস্তাটি খুবই মসৃণ এবং খাদ বিহীন ।
আমরা খুব আনন্দের সাথেই চলে গিয়েছিলাম ।তাই আমরা রাস্তায় কোথাও না থেমে সরাসরি মন্টু মিয়ার বাগানবাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম ।আমাদের বাস রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ একটি আলাদা জায়গা তৈরি করে রেখেছিল যেখানে অনেক বাস পার্কিং করার ছিল ।তারপর একে একে আমরা ভেতরে ঢুকলাম টিকিট কেটে ।প্রতিটা টিকিটের মূল্য ছিল ৫০ টাকা। ঢোকার জন্য সুন্দর একটি প্রবেশ পথ ছিল। আমরা ভিতরে ঢুকলাম ।দেখলাম,অনেকগুলা দোকান রয়েছে যেগুলো এখানে ভাড়া দেওয়া ।
সেখানে বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় জিনিস বিক্রি হচ্ছে। ঢুকেই আমাদের চোখে সুন্দর একটি লেক পরল ।খুবই ভালো লাগছিল দেখতে। আমাদের চলার পথের দুই পাশেই দুইটি লেক ছিল। কিছুদূর এগোতেই দেখতে পেলাম লম্বা একটি জিরাফের ভাস্কর্য। তার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কিছু ছবি তুলে নিলাম। পাশেই ছিল পুরুষদের একটি মসজিদ যেটি ছিল পানির উপরে ভাসমান মসজিদ।
বামে ছিল চিড়িয়াখানায় যাওয়ার রাস্তা ।আমরা চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম ।ঢুকেই আমরা বিভিন্ন প্রাণীর আচরণবিধি উপভোগ করতে লাগলাম। দেখলাম একটি খাঁচার সামনে সবাই জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখলাম সেটা একটি বান্দরের খাঁচা ।ভেতরে বেশ কয়েকটি বান্দর নিজেদের মধ্যে খেলা করছিল। আর জোরে জোরে চিৎকার করছিল ।আমরা কিছুক্ষন সেটি উপভোগ করলাম।একপাশে ছিল দুটি সাপ এর খাঁচা এবং তাদের খাবার দেওয়া হয়েছিল দুটি মুরগির বাচ্চা। চিত্রা হরিণ গুলো দেখতে খুব অসাধারণ ছিল ।দেখলাম একজন কেয়ারটেকার এসে হরিণগুলোর খাবার দিয়ে গেল।
চিড়িয়াখানার এক পাশে একটি খাচায় ছিল কিছু ভাল্লুক । অন্যান্য প্রাণীগুলোও আস্তে আস্তে দেখে ফেললাম। চিড়িয়াখানা থেকে বের হয়ে আমরা সামনে একটু হাঁটতেই দেখলাম একটি লেক আর সেই লেকের মাঝে একটি ছোট দ্বীপ ।সেই দ্বীপে যাওয়ার জন্য একটি ছোট রাস্তা আছে। সে সরু রাস্তা ধরেই আমরা দ্বীপে পৌঁছলাম। সেই দ্বীপে কিছু রাইড এর ব্যবস্থা আছে। ছোটদের জন্য ট্রেন, দোলনা এগুলোর ব্যবস্থা ছিল আর দ্বীপের চারদিকে ঘোরার জন্য কিছু প্যাডেল বোটের ব্যবস্থা ছিল ।
আমরা প্যাডেল বোটে টিকিট কেটে উঠলাম। ৩০ মিনিটের জন্য প্রতিটি প্যাডেল বোটের ভাড়া ছিল ৫০ টাকা ।তারপর আমরা দ্বীপের ভেতরে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দ্বীপ থেকে বের হয়ে মন্টু মিয়ার বাগান বাড়ির বাকি অংশটুকু ঘুরে ঘুরে দেখা শুরু করলাম ।আসলে ভেতরে অনেকটাই জায়গা ছিল আমরা আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করলাম ।শহরের কোলাহল যুক্ত জায়গা থেকে দূরে গিয়ে এরকম একটা নিরব স্থানে কিছু সময় কাটানোর ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই ছিল।
খুবই ভালো লাগছিল সময়গুলো উপভোগ করছিলাম। যে যার মত ছড়িয়ে গিয়েছিল নিজেদের মতো করে উপভোগ করছিল সময়গুলো। আমরা থ্রিডি থিয়েটারের ভেতরে গিয়ে থ্রিডি মুভি ইনজয় করলাম ।ভেতরে আমরা আমাদের দুপুরের লাঞ্চ করে নিলাম যেটি আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। প্রত্যেকের জন্য একটি করে বিরিয়ানির প্যাকেট। খাওয়া শেষে আমরা দেখতে পেলাম একদিকে একটি ম্যাজিক শো এর আয়োজন করা হয়েছে। আমরা সবাই একসাথে সেটা উপভোগ করলাম।
আস্তে আস্তে সময় গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল এবং আমাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেল তাই আমরা বিকালের দিকে বাগান বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম এবং বাসে উঠে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ।খুবই উপভোগযোগ্য দিন ছিল এবং আমরা সবাই খুবই আনন্দ করেছিলাম।