সমতল ভূমি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মনপুরা দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই দ্বীপে না আসলে কেউ বুঝতেই পারবে না প্রকৃতি কতোটা স্বর্গীয় সৌন্দর্য নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে। সমতল ভূমি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে নদীপথে যাতায়াত ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, ফলে দ্বীপ ভ্রমনের সাথে সাথে নদীপথে ভ্রমনের অবিজ্ঞতাও অর্জন করা যাবে।
বাংলাদেশের চলচিত্র জগতে মনপুরা দ্বীপ নিয়ে ‘মনপুরা’ সিনেমা নির্মিত হওয়ার পর থেকেই এই দ্বীপের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করেছে। প্রতিবছর শীত ঋতুতে অসংখ্য পর্যটক মনপুরা দ্বীপে আসেন প্রকৃতির সাথে একান্ত নিবিড় ভাবে ছুটির দিনগুলো কাটাতে। আজকের আয়োজনে থাকছে মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ভ্রমণ গাইড।
মনপুরা দ্বীপের অবস্থান
মনপুরা দ্বীপ বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ভোলা জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও দ্বীপটি ভোলা জেলার ভূখন্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। মনপুরা দ্বীপের আয়তন ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর অববাহিকায় দ্বীপটি গড়ে উঠেছে। দ্বীপটির দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত এবং বাকি তিন দিকে মেঘনা নদীর অবস্থান। চারদিকে অথৈ পানির মাঝখানে রূপকথার দেশের মতো বিদ্যমান আছে মনপুরা দ্বীপটি।
মনপুরা দ্বীপে যা যা উপভোগ করবেন
মনপুরা দ্বীপে উপভোগ করার জন্য একটা নয় বরং অনেকগুলো আকর্ষণীয় বিষয়ে আছে। মপুরা দ্বীপ থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্য যে কাউকে মন্ত্রমুগ্ধ করবে। সকালে মনে হবে বিশাল জলরাশির বুক চিরে লাল সূর্য উদিত হচ্ছে এবং সন্ধ্যায় আবার সূর্যটি পানির নিচে মিলিয়ে যাচ্ছে।
দ্বীপের এক পাশে সমুদ্রসৈকত থাকায় সমুদ্রের তীরে ঘুরে বেড়ানো ও গোসলের সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চায় না।
আরও আছে হরিণের অভয়ারণ্য। এখানে অসংখ্য হরিণ প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠছে এবং বিচরণ করছে। জোয়ারের সময় যখন পানি বেড়ে যায়,তখন হরিণের পাল লোকালয়ের দিকে চলে আসে। মহাসড়কের ওপর দিয়ে যখন হরিণের পাল ছুটে যায় তখন কখনও কখনও ৫ মিনিটেরও বেশি সময় গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। রাস্তার মাঝখানে বিশাল এক বহর হরিন দেখার সৌভাগ্য কেবলমাত্র মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণের ফলেই সম্ভব।
মনপুরা দ্বীপের আরও একটি আকর্ষণীয় উপভোগ্য বিষয় হলো মেঘনা নদীর ভেতরে অবস্থিত ল্যান্ডিং স্টেশন। ল্যান্ডিং স্টেশনটি মেঘনা নদীর ৫০০ মিটার ভেতরে অবস্থিত। রাতের বেলা ল্যান্ডিং স্টেশনে বসে থাকলে মনে হবে আপনি মেঘনা নদীর একেবারে ভেতরে বসে আছেন। চারদিকে শুধু পানি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। নদী ও সাগরের তীব্র স্রোতে একটু পর পরই স্টেশনটি কেঁপে ওঠে। কম্পনের এই অনুভূতি আলাদা এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। শুধু পর্যটকেরাই নয় মনপুরা দ্বীপের স্থানীয় লোকজনও বিকেল বেলা ল্যান্ডিং স্টেশনে সময় কাটাতে আসে।
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরও একটি নিদর্শন হলো মনপুরা দ্বীপে অবস্থিত চৌধুরী প্রজেক্ট। এটা মূলত একটি মাছের ঘের। অনেক গুলো পুকুর ও লেকের সমন্বয়ে এই চৌধুরী প্রজেক্ট গঠিত। নদী ও লেকের পাশে সারি সারি নারকেল গাছ আর অপর পাশে বয়ে চলা মেঘনা নদী সব মিলিয়ে চমৎকার এক পরিবেশ। পুরো একটা বিকেল মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাটিয়ে দেয়া যায় এই চৌধুরী প্রজেক্টের মধ্যে।
মনপুরা দ্বীপ সাইকেলিং ও ক্যাম্পিং এর জন্য খুবই উপযুক্ত একটি জায়গা। কখনও গভীর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা রাস্তা আবার কখনও নদীর তীর ঘেসে নির্মিত রাস্তায় সাইলেক নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। ভাগ্য ভালো হলে সাইকেলিং করতে করতেই রাস্তার মাঝখানে দেখা মিলতে পারে হরিণের দলের। তখন সাইকেল থামিয়ে হরিণের দলকে রাস্তা পার হওয়ার সুযোগ দেয়াটাও এক অন্যরকম আনন্দ।
মনপুরা দ্বীপ যাওয়ার উপায়:
মনপুরা দ্বীপ সমতল ভূমি থেকে পুরপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এখনে যাওয়ার একমাত্র উপায় নদীপথ। লঞ্চ বা ট্রলারই হলো এই পর্যটন কেন্দ্রে পৌঁছানোর উপযুক্ত যানবাহন।
মনপুরা দ্বীপে দুই ভাবে যেতে পারবেন। প্রথমটি হলো সরাসরি ঢাকা থেকে লঞ্চ যোগে মনপুরা দ্বীপ আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো ঢাকা বা বরিশাল থেকে প্রথমে ভোলা হয়ে মনপুরা দ্বীপ পৌঁছানো।
ঢাকা থেকে সরাসরি মনপুরা দ্বীপ যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে চলে যেতে হবে ঢাকার সদরঘাটে। সদরঘাট থেকে এমভি ফারহান-৩ এবং এমভি ফারহান ৪ নামক এই দুটি লঞ্চ প্রতিদিন হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছাড়ে। এই লঞ্চে চেপে সরাসরি মনপুরা দ্বীপে চলে যেতে পারবেন। লঞ্চ দুটি প্রতিদিন বিকাল ৫ টায় ঢাকা সদরঘাট থেকে রওয়ানা করে এবং সকাল ৭ টা থেকে ৭ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে মনপুরা দ্বীপে পৌঁছে যায়।
লঞ্চ থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য কিন্তু অসাধারণ, তাই এই সুযোগটি একদমই হাতছাড়া করবেন না। এই দুটো লঞ্চে ডেকের যাত্রীদের জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৩৫০ টাকা।
মনপুরা থেকে ফেরত আসার সময় আপনাকে চলে যেতে হবে মনপুরা রামনেওয়াজ লঞ্চঘাটে। এখান থেকে দুপুর ২ টায় ঢাকার উদ্যেশ্যে লঞ্চ যাত্রা শুরু করে। লঞ্চ ভাড়া উভয় ক্ষেত্রে একই থাকবে।
ভোলা হয়ে মনপুরা দ্বীপে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা সদরঘাট অথবা বরিশাল লঞ্চ ঘাট থেকে প্রথমে ভোলার লঞ্চে চেপে ভোলা সদরে চলে যেতে হবে। তারপর চলে যাবেন ভোলার তজুমদ্দিন ঘাটে। তজুমদ্দিন ঘাট থেকে মনপুরা দ্বীপে যাওয়ার সি-ট্রাক পাবেন। সি-ট্রাকটি প্রতিদিন দুপুর ৩ টায় তজুমদ্দিন ঘাট থেকে মনপুরার উদ্যেশ্যে রওয়ানা করে আবার মনপুরা থেকে সকাল ১০ টায় তজুমদ্দিন ঘাটের উদ্যেশ্যে ফিরতি রওয়ানা করে।
ভোলার চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট থেকে দুটো লঞ্চ পাওয়া যায়, যেগুলো নিয়মিত ভোলা টু মনপুরা জনতা বাজার ঘাটে চলাচল করে। তবে এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই পথটিকে ডেঞ্জার পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়। ফলে এই আট মাস এই রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকে।
মনপুরা দ্বীপে থাকার ব্যবস্থা
মনপুরা দ্বীপে রাত্রি যাপনের জন্য পাবেন অনেক আবাসিক হোটেল। ভালো মানের হোটেল থেকে একদম সস্তা মনের হোটেলও পেয়ে যাবেন। তাছাড়া আছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডাকবাংলো। তাই মনপুরা দ্বীপ ভ্রমনের ক্ষেত্রে রাত্রিযাপন নিয়ে কোনো ধরনের ঝামেলায় পড়তে হবে না।
এখানে আছে তিনটি ডাক বাংলো। একটি সরকারি ডাক বাংলো, প্রেসক্লাব বাংলো, এবং কারিতাস বাংলো। নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এসব বাংলোতে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। এক রাতের জন্য খরচ হতে পারে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এছাড়াও আরও অন্যান্য বাংলো পাবেন, যেখানে পূর্ব অনুমতি ছাড়াই থাকার ব্যবস্থা হবে।
মনপুরা দ্বীপের কয়েকটি ডাকবাংলো এবং হোটেলের নাম ও মোবাইল নম্বর :
১. প্রেসক্লাব গেস্ট হাউজ
মোবাইল: ০১৯১৩-৯২৭৭০৬
২. জেলা পরিষদ ডাক বাংলো
মোবাইল: ০১৯৩৪-১৭৫৩৬৯
৩. পানি উন্নয়ন বোর্ড ডাক বাংলো
মোবাইল: ০১৯২৩-৩৭৬৩৬৫
৪. হোটেল দ্বীপ
মোবাইল: ০১৭১৩-৯৬৫১০৬
৫. হোটেল আইল্যান্ড
মোবাইলঃ ০১৭১১-৭০১২৮৬
৬. কারিতাস হোটেল
মোবাইল: ০১৯২৩-২৭৬৩৬৫
মনপুরা দ্বীপে খাওয়ার ব্যবস্থা
মনপুরা দ্বীপের খাওয়াদাওয়া, সেও যেন এক আকর্ষনের বিষয়। মনপুরা দ্বীপের বিখ্যাত কিছু খাবার আছে যা অবশ্যই চেখে আসা দরকার। এখানে বেশ কিছু সাধারণ মানের হোটেল থেকে শুরু করে ভালো মানের হোটেলও পাবেন। এসব হোটেলে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ, ভর্তা ও হাঁসের মাংস খুবই সুস্বাদু। শীতের সময় মনপুরা ভ্রমন করলে হাঁসের মাংস খেয়ে আসতে ভুলবেন না যেন। তাছাড়া মহিষের কাঁচা দুধের দই ভোলা সহ মনপুরা দ্বীপের খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। আরও খেতে পারেন মেঘনা নদীর তাজা ইলিশ মাছ।এখানকার ইলিশ, কোরাল, বোয়াল ও গলদা চিংড়ি বেশ সুস্বাদু এবং তাজা।
সতর্কতা
নদী ভ্রমনের সময় অবশ্যই সাথে লাইফ জ্যাকেট রাখবেন।
হোটেল ত্যাগ করার সময় যাবতীয় জিনিসপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে নিবেন।
সাইকেলিং করার জন্য সাইকেল ভাড়া নিলে সব ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখে চালানো শুরু করবেন।
যে কোনো বিষয়ে দরদাম করে টাকা পেমেন্ট করবেন।