পশ্চিম সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ শহর মদিনা। মদিনা প্রদেশের রাজধানী মদিনা শহর মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে দ্বিতীয় পবিত্রতম শহর। মক্কার পরেই পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র জায়গা হিসেবে মদিনা শহরকে সম্মানিত করা হয়েছে। সংক্ষেপে মদিনা বলা হলেও মদিনা শহরের প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘আল মদিনা আল মুনাওয়ারাহ’ যার বাংলা অর্থ আলোর শহর।
মদিয়া শহরের মোট আয়তন ৪৪৫.৫ কিলোমিটার বা ২২৭ বর্গমাইল। প্রাণের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজা মোবারক মদিনা শহরে অবস্থিত। প্রতিদিন হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলিম মদিনা শহরে আসে নবীজীর পাক রওজা মোবারক পরিদর্শন করতে। এই শহরের বেশিরভাগ জায়গাতেই আমাদের নবীর স্মৃতিচিহ্ন পড়ে আছে।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) মক্কা ছেড়ে পবিত্র মদিনা শহরে হিজরত করেছিলেন। ইসলামের বেশ প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী তিনটি মসজিদ – মসজিদে নববী, কুবা মসজিদ ও মসজিদ আল কিবলাতাইন মদিনা শহরে অবস্থিত।মক্কায় হজ্জ করতে যাওয়া হাজীগন মদিনায় আসেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভ্রমণ করতে। মদিনা শহরের দর্শনীয় স্থান সমূহ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
১. মসজিদে নববী
মদিনা শহরের যে স্থানে সবথেকে বেশি হাজীদের সমাগম ঘটে তার মধ্যে মসজিদে নববী প্রথম স্থানে রয়েছে। পৃথিবীতে মসজিদুল হারাম এর পরেই মসজিদে নববীর অবস্থান। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এই মসজিদটি নির্মান করেছেন এবং নিজে এর নির্মান কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। নবীজীর মদিনায় হিজরতের পর এই মসজিদটি নির্মান করা হয়েছিল। মুহাম্মদ (স.) এর কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যেই সকল হাজীরা মসজিদে নববীতে এসে উপস্থিত হয়। মসজিদের সবুজ গম্বুজ বিশিষ্ট কক্ষে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.), হযরত উমর (রা.) এবং হযরত আবু বকর (রা.) এর রওজা মোবারক অবস্থিত। সবুজ গম্বুজ বিশিষ্ট এই কক্ষটি আয়িশা (রা.) এর ঘর ছিল। মুসুল্লিরা সাধারনত হজ্জের শুরুতে বা শেষে মসজিদে নববী-তে এসে অবস্থান করেন।
২. জান্নাতুল বাকি
মদিনা শহরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক কবর স্থান জান্নাতুল বাকি। এই কবরস্থান এর আরবি নাম মাকবারাতুল বাকি বা বাকিউল গারকাদ। এখানে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) এর স্ত্রী, কন্যা আত্নীয় স্বজন সহ অনেক সাহাবীদের কবর রয়েছে। জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে অন্তত দশ হাজার সাহাবায়ে কেরামদের কবর রয়েছে। মসজিদে নববীর দক্ষিণ পূর্ব দিকে জান্নাতুল বাকি অবস্থিত। তাই হাজীগন মসজিদে নববী অবস্থানকালে জান্নাতুল বাকি তে গিয়ে ইসলামের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কবর জিয়ারত করে আসেন। আগে জান্নাতুল বাকির প্রতিটি কবরের ওপর বিশেষ স্থাপনা ছিল। কিন্তু সৌদ বংশ ক্ষমতাতে আসার পরে এই স্থাপনা গুলো ভেঙে ফেলা হয়।
৩. মসজিদে কুবা
ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ হলো মাসজিদে কুবা। মদিনার কুবা নামক গ্রামে এই মসজিদটি অবস্থিত। সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে মসজিদে কুবার অবস্থান চতুর্থ। মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববী এবং জেরুজালেমের মসজিদে আকসার পরেই মসজিদে কুবার অবস্থান। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) এর মদিনা হিজরতের পর এই মসজিদটি নির্মান করা হয়। মসজিদটির ভীত প্রস্তুত হয়েছিল মহানবি (স.) এর হাত ধরেই। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) বেশ কিছুদিন এখানে অবস্থান করেছিলেন। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) এর স্মৃতি বিজড়িত এই মসজিদ দেখতে অনেক মুসুল্লি কুবা গ্রামে চলে যান।
৪. মসজিদ আল কিবলাতাইন
ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্য পূর্ণ মসজিদ হলো মসজিদ আল কিবলাতাইন৷ মদিনায় অবস্থিত এই মসজিদটির সাথে জড়িয়ে আছে কুরআনের বিশেষ কিছু আয়াত নাজিলের ইতিহাস। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এই মসজিদে যখন জামাআতের সাথে নামাজ আদায় করতে থাকেন তখন কিবলা পরিবর্তন করার জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আয়াত নাজিল হয়।
আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তখনই জেরুজালেম এর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে মক্কার দিকে কিবলা করা হয়। এজন্যই মসজিদটির নামকরণ হয়েছে মসজিদ আল কিবলাতাইন। মসজিদটির ১ টি গম্বুজ ও ১ টি মিনার আছে। এই মসজিদে একসাথে দুই হাজার মুসুল্লি জামাআতে সালাত আদায় করতে পারবে। মক্কায় হজ্জ করতে আসা হাজীগন মসজিদে নববী পরিদর্শনের সময় মসজিদ আল কিবলাতাইন পরিদর্শন করতে ভুল করেন না।
৫. উহুদ পাহাড়
ইসলামের ইতিহাসের তাৎপর্যময় উহুদের যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল যে পাহাড়ের ওপর সেই পাহাড়ই মূলত উহুদ পাহাড় নামে পরিচিত। মক্কার কুরাইশ বংশের এবং মদিনাবাসীর মধ্যে এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে প্রায় ৭০ জন সাহাবায়ে কেরাম শহিদ হয়েছিলেন। তাদের সকলের কবর এই উহুদের ময়দানেই অবস্থিত।
হাজীগন উহুদের যুদ্ধে শহিদ হওয়া সাহাবায়ে কেরামদের কবর জিয়ারত করতে উহুদ পাহাড়ে আসেন। উহুদ পাহাড়ের উচ্চতা উচ্চতা ১,০৭৭ মিটার বা ৩,৫৩৩ ফুট। উহুদ পাহাড়ের পেছনের দিকে আরেকটি ছোট পাহাড় আছে যার নাম লোকমুখে রুমার পাহাড় বলেই পরিচিত এর আসল নাম জাবালে রুমাত। উহুদ পাহাড় পরিদর্শন করতে আসলে রুমার পাহাড়ে ঘুরে আসতেও কেউ ভোলে না।
৬.আল গামামাহ মসজিদ
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এর স্মৃতি বিজড়িত মদিনার প্রাচীন ঐতিহ্য সম্বলিত মসজিদ হলো আল গামামাহ মসজিদ। খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজের রাজত্বকালে ৮৬ থেকে ৯৩ হিজরি মধ্যে মসজিদটি নির্মান করা হয়েছিল। মুহাম্মদ (স.) ৬৩১ সালে এই মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করেছিলেন৷ পূর্বে এই মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ ছিল, তবে এখন মসজিদটিকে পুনরায় সকল মুসুল্লিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। মদিনার প্রাচীন নিদর্শন সমূহের মধ্যে আল গামামাহ মসজিদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
৭. বাদশা ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স
পৃথিবীর সবথেকে জনপ্রিয় কোনআন প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান বাদশা ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স যা সৌদি আরবের মদিনা শহরে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর কমপক্ষে প্রায় ১ মিলিয়ন কপি কুরআন প্রিন্ট করে। আরবি ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় কুরআন মুদ্রন করা হয় এই প্রিন্টিং কমপ্লেক্সে।
তাছাড়াও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এর জীবনী, বিভিন্ন তাফসির, হাদিস ও ইসলামিক বই মুদ্রন করা হয় এখানে। কখনও মদিনা শহরে যাওয়ার সৌভাগ্য হলে অবশ্যই এই প্রিন্টিং কমপ্লেক্স থেকে ঘুরে আসা উচিত। একসাথে হাজার হাজার কুরআন ছাপা হওয়ার দৃশ্য নিজ চোখে দেখা- এই সৌভাগ্য কজনের আছে।
৮. কাহফে খুজায়া
কাহফে খুজায়া একটি বিশেষ গুহা, যা প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর একটি দুঃখময় ঘটনার সাক্ষী। কাহফে খুজায়া গুহাটি মদিনা শহরে অবস্থিত। খন্দকের যুদ্ধের সময় মহানবী (স.) এই গুহার ভেতরে আহত অবস্থায় এসে বিশ্রাম করেছিলেন। নবী প্রেমী মুসল্লিগন মদিনায় আসলে কাহফে খুজায়া গুহাটি নিজ চোখে দেখতে যান।
৯. মসজিদে জুমা
মদিনা শহরের মসজিদে কুবা থেকে ৯০০ মিটার উত্তরে এবং মসজিদে নববীর ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে মসজিদে জুমা অবস্থিত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) মদিনা শহরে এসে প্রথম এখানে জুমুআার সালাত আদায় করেছিলেন পরবর্তীতে এখানে মসজিদটি নির্মান করা হয়। হাজীদের মূল আকর্ষণের একটি বিশেষ মসজিদ হলো মসজিদে জুমা। মদিনার মুনাফিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এই মসজিদটার পাশে আরেকটি মসজিদ স্থাপন করেছিল যা ‘মসজিদে জিরার’ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশে এই মসজিদটি ভেঙে ফেলা হয় যার ধ্বংসস্তূপ এখনও সেখানেই রয়েছে।
১০. ওয়াদি জ্বিন
ওয়াদি জ্বিন বিশেষ এক অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন উপত্যকা। মদিনা শহর থেকে ৩০/৪০ কিলোমিটার উত্তরে এই উপত্যকাটি অবস্থিত। এই উপত্যকার এক বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। সাধারণত কোনো ঢালু জায়গায় পানি ঢাললে তা স্বভাবতই ঢালের দিকেই নামবে। কিন্তু ওয়াদি জ্বিন উপত্যকায় পানি ঢেলে দিলে তা ঢালের দিকে না গড়িয়ে উঁচু দিকে গড়িয়ে পড়ে। এই অসম্ভব বিষয়টিকে নিজ চোখে দেখার জন্য অসংখ্য দর্শনার্থী ওয়াদি জ্বিন উপত্যকায় ভীড় জমায়।
মদিনা শহরের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান :
১. খন্দক
২. বিলাল মসজিদ
৩. সালমান ফার্সির কথিত বাগান
৪. কেন্দ্রীয় খেজুর মার্কেট
৫. ইজাবা মসজিদ
৬. আবু বকর মসজিদ
৭. সাত মসজিদ নিয়ে গঠিত কমপ্লেক্স (ইত্যাদি)