নদীমাতৃক বরিশাল বিভাগের একটি দ্বীপ অঞ্চল ভোলা জেলা। নদীর সাথে এই জেলার মানুষের জীবন যেন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। যেমন পাওয়া যায় প্রচুর পরিমানে মাছ, তমনই উর্বর জমিতে ফলে চাল, ডাল, নারকেল, সুপারি সহ নানা ধরনের ফসল।
এসব কৃষি উপাদানকে নানা ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে এই অঞ্চলের লোকজন তৈরি করে নানা ধরনের সুস্বাদু সব খাবার। নানা উৎসব অনুষ্ঠানে, পৌষ পার্বণে, বাড়িতে মেহমান আসলে তৈরি করা হয় নানা স্বাদের বৈচিত্র্যময় খাবার। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাবার তালিকায়ও আছে বিভিন্ন ব্যতিক্রমধর্মী খাবারের তালিকা, যা অন্যান্য অঞ্চলের খাদ্যাভাস থেকে একদমই ব্যতিক্রম ।
চলুন জেনে নেয়া যাক ভোলা জেলার অথেনটিক কিছু খাবার সম্পর্কে।
১. মহিষের দুধের টক দই
ভোলার একটি ব্রান্ড পণ্য বা খাবার মহিষের দুধের দই। এই জেলার প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসব বা অতিথি আপ্যায়নে দই থাকবেই থাকবে। মহিষের দুধ তুলনামূলক ঘন হয় বলে এই দুধ থেকে তৈরি দইএর আছে আলাদা স্বাদ ও বিশেষত্ব।
ঐতিহ্যবাহী এই দই তৈরি করার জন্য আছে বেশ অভিজ্ঞ ও পুরোনো কারিগর। মাটির হাঁড়ি যাকে আঞ্চলিক ভাষায় টালি বলে – এই টালিতে কাঁচা দুধ ঢেলে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা রেখে দিলেই দই জমে যায়৷
ভোলা জেলার ঘোষপট্টিতে সবথেকে ভালো মহিষের দুধের দই পাওয়া যায়। তাছাড়া অন্যান্য দোকানে বা বাজারেও মহিষের দুধের দই কম বেশি পাওয়া যায়।
টক দই এর সাথে চিনি মিশিয়ে খাওয়া হয় সাধারণত। তাছাড়া দই চিঁড়া , দই এর ঘোল , হাতে ভাজা মুড়ি দিয়ে দই এই অঞ্চলের মানুষের খুবই প্রিয় খাবার।
২. তাল বরক পিঠা
তালের পিঠা তো সবারই কম বেশি খাওয়া হয়েছে। কিন্তু তাল বরক একটু আলাদা স্বাদের আনকমন পিঠা। কলাপাতার কাটা অংশকে ভোলার মানুষ আঞ্চলিক ভাবে বরক বলে। এই কলা পাতার সাহায্যে তৈরি করা হয় বলে একে বলা হয় তাল বরক পিঠা।
তাল বরক পিঠার মূল উপকরণ চালের গুড়ো,পাকা তালের কাথ, খেজুর গুড়, নারকেল কুচি ও কলাপাতার বরক। সব উপকরণ একসাথে একটু পাতলা গ্রেভি করে গুলিয়ে কলাপাতার ওপর লেপটে দেয়া হয়। তারপর কলাপাতা সহ সেই পিঠা ভাপে সিদ্ধ করা হয়। সিদ্ধ হলে অনেকটা শক্ত হয়ে রুটির মতো আকৃতি ধারণ করে। প্রতি কামরে কামরে পাওয়া যায় পাকা তালের মিষ্টি গন্ধ ও নারকেলের স্বাদ।
১দিন পরে ঠান্ডা ও বাসি পিঠা খেতে খুব ভালো লাগে।
৩. পুঁটি মাছের ভর্তা
নদী নালা খাল বিলে ভরপুর ভোলা জেলা । প্রতিটি বাড়ির আশ পাশ দিয়েই বয়ে গেছে কম বেশি ছোট বড় খাল। এই খালে জাল পাতলে ধরা প্ররে প্রচুর পরিমানে পুঁটি মাছ। ছোট ছোট পুটি মাছ কেটে বেছে কড়া করে তেলে ভেজে বয়াম ভরে রাখেন বাড়ির মহিলারা।
প্রতিদিন সকালে সেই মাছ বের করে পেয়াজ, মরিচ, ধনিয়া পাতা দিয়ে পাটায় বেটে ভর্তা করা হয় সেই ভেজে রাখা। ক্ষেতের মোটা চালের পান্তা ভাতের সাথে পুঁটি মাছ ভর্তা দিয়ে বাড়ির উঠোনে পরিবারের সবাই মিলে সকালের খাবার খাওয়া, সে যেন এক স্বর্গীয় সুখ । সাথে থাকে পেয়াজ আর কাঁচা মরিচ।
৪. নারকেল দিয়ে হাঁসের মাংস
ভৌগোলিক কারনে ভোলা জেলায় প্রচুর পরিমানে নারকেল গাছ জন্মায়। এসব গাছের ফলনও বেশ ভালো। তাই এই অঞ্চলের বেশির ভাগ রান্নাতেই ব্যবহার করা নারকেল বাটা। এই নারকেল দিয়ে রান্না করা হয় হাঁসের মাংস, যার স্বাদ একদমই ব্যতিক্রম।
সব ধরনের মসলার সাথে নারকেল বাটা ব্যবহার করা হয় বলে , এই রান্নায় চলে আসে অন্যরকম মন মাতানো সুঘ্রাণ এবং স্বাদও হয় রাজকীয় ।
সাধারণত চালের রুটির সাথে এই মাংস খাওয়া হয়। তাছাড়া ভাত পোলাও, খিচুড়ির সাথেও বেশ জমে যায় নারকেল দিয়ে হাঁসের মাংস।
৫. রসের নাশতা
শীতকালে ভোলা জেলার ঘরে ঘরে ধুম পরে যায় খেজুরের রস খাওয়ার। কেউ খায় কাঁচা রস আবার এই রস দিয়ে তৈরি করা হয় নানা স্বাদের পিঠা পুলি ও মিষ্টান্ন । এই খেজুরের রসের খুবই জনপ্রিয় একটি পদ ‘রসের নাশতা’।এই খাবার তৈরির মূল উপকরণ খেজুরের রস বলেই এর নাম হয়েছে রসের নাশতা।
রসের নাশতা মূলত একটি ডেজার্ট আইটেম। গাছ থেকে তাজা রসের হাড়ি পেড়ে সেই রসকে ভালোভাবে জ্বাল করা হয়। তারপর এর মধ্যে দিয়ে দেয়া হয় ক্ষেতের ধানের ছোট পোলাওয়ের সুগন্ধি চাল ও নারকেল। নারকেল, সুগন্ধী চাল ও রসের অসাধারণ গন্ধে পুরো বাড়ি মৌ মৌ করতে থাকে। ছোট বড় সবাই মিলে বড় থালায় করে হাত দিয়ে চেটেপুটে খেয়ে একেবারে সাবার । রসের নাশতা সাধারণত খুব ভোরে উঠোনে মাটির চুলো জ্বালিয়ে রান্না করা হয়।
৬. চাপা মোয়া
গ্রাম মানেই সপ্তাহে দুটো প্রধান হাট। হাটে বসে হরেক রকমের দোকান। এসব দোকানগুলোর মধ্যে ছোটদের সবথেকে বেশি আকর্ষণ থাকে খাবারের দোকানের ওপর। এই সাপ্তাহিক হাটে পাওয়া যায় চাপা মোয়া। বাড়ির কেউ হাটে যাবে আর দুহাত ভরে মোয়া নিয়ে আসবে না এ আবার কখনও হয় নাকি।
ক্ষেতের ধানের মোটা চাল দিয়ে ভাজা হয় মুড়ি। গাছের একদম তাজা রস জ্বাল করে তৈরি করা হয় খেজুরের গুড়। চাপা মোয়া তৈরির মূল উপকরণই এই হাতে ভাজা মুড়ি আর খেজুর গুড়। খেজুর গুড় জ্বাল করে আঠালো ভাব হয়ে গেলে তার ভেতরে মুড়ির দিয়ে পাক দেয়া হয়। তারপর গরম গরম থাকতেই হাতে নিয়ে মাঝারি গোল আকৃতির মোয়া তৈরি করা হয়। ঠান্ডা হলে জমে গিয়ে বেশ মুচমুচে ও সুস্বাদু হয়। মুখে দিলেই কুরমুর আওয়াজ আর মিষ্টি স্বাদ।বিশেষ করে ছোটদের খুব প্রিয় খাবার এই চাপা মোয়া।
৭. মাষকলাই শাক
নদী বিধৌত অঞ্চল হওয়ার ভোলা জেলায় ডালের ফলন বেশ ভালো হয়। এই জেলায় শীত ঋতুতে মাষকলাই ডালের চাষ হয় সব ক্ষেতে। বীজ থেকে যখন নতুন চারা গজায় তখন এর ডগা গুলো থাকে বেশ নরম। কচি কচি এই ডগা তুলো একদম পাতলা পাতলা করে কেটে ভাজি খাওয়া হয়। আঞ্চলিক ভাষায় এই খাবারের নাম ‘কলই শাক’।
ভোলা সহ বরিশাল বিভাগের প্রতিটি জেলার মানুষের কাছেই কলই শাক খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। গাছে ফুল আসার আগ পর্যন্ত বাড়ির মহিলারা দল বেধে বিকেল বেলা কলই শাক তুলতে ক্ষেতে যায়। সেই শাক কাটাও চাট্টিখানি কথা নয়। কাটতে হবে একদম মিহি করে, যেন একটা শাকের পাতাও আস্ত না থাকে। মিহি করে এই শাক কাটাকে ভোলার অঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘কলইর শাক পলা ‘।
মাষকলাই শাক ভাজি গরম ভাতের সাথে খেতে দারুণ মজা।
৮. পটলের খোসা ভর্তা
ভোলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের খুব জনপ্রিয় একটি খাবার পটলের খোসা ভর্তা। পটলের খোসা আমরা সাধারণত ফেলে দেই, কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষ পটল কাটলে খোসা ফেলে না দিয়ে তৈরি করে দারুণ স্বাদের এক খাবার। পটলের খোসা ভর্তা দিয়ে আপনি অনায়াসে এক /দুই প্লেজ ভাত তৃপ্তি সহকারে খেতে পারবেন।
পটলের ছোলা সিদ্ধ করে তার সাথে পেয়াজ, মরিচ, রসুন একসাথে তেলে ভেজে শিল পাটায় বেটে তৈরি করা হয় দারুণ স্বাদের এই ভর্তা। সাথে যদি দেয়া যায় দু চারটে তেলে ভাজা চিংড়ি মাছ তাহলে তো কোনো কথাই নেই। অনেকেই ছোট চিংড়ি মাছ কাটার পরে যে মাথার অংশ থাকে, তাই দিয়েই ভর্তা করে নেয়।
আমরা ভোজন রসিক বাঙালি জাতি, তাই আমাদের দেশের প্রতিটি জেলারই আছে আলাদা কিছু খাদ্যাভ্যাস। নানা বৈচিত্র্যময় খাদ্যের তালিকায় ভরপুর বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতি।তাই বাঙালির সংস্কৃতির এক বড় সম্পদ এই দেশের খাদ্য বৈচিত্র্য