এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাজার হলো বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগে অবস্থিত ভাসমান পেয়ারা বাজার। শত শত ডিঙি নৌকা বোঝাই করে পেয়ারার পসরা সাজিয়ে বিকিকিনি চলতে থাকে ভাসমান এই বাজারে। ছোট ছোট খালের বুকে ভেসে ভেসে বাজার ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র ভাসমান পেয়ারা বাজারে গেলেই উপভোগ করা সম্ভব। শুধু বাজারই নয় সেই সাথে আছে সুবিশাল পেয়ারা বাগান ঘুরে দেখার সুযোগ।
বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুর এই তিন জেলার সংযোগস্থলে ২৬ টি সীমান্তবর্তী গ্রামের সমন্বয়ে এই পেয়ারা বাগানের অবস্থান। ৩১ হাজার একর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পেয়ারা বাগানের গ্রাম গুলোর ভেতরের ছোট ছোট খালে নৌকা নিয়ে ঘুরে ঘুরে সমগ্র এলাকা ঘুরে দেখতে পারবেন।
এখান কার ২৬ টি গ্রামের ২০ হাজার পরিবার পেয়েরা, আমড়া, সুপারি লেবু সহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য চাষের সাথে জড়িত। সবুজ শ্যামল প্রকৃতির মাঝে একদমই ব্যতিক্রমী ভাসমান বাজারে ঘুরে বেড়ানোর মতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন বরিশালের ভাসমান পেয়ারা বাজার থেকে।
ভাসমান পেয়ারা বাজারের আকর্ষণ সমূহ
ভাসমান পেয়ারা বাজারের মূল আকর্ষণই হলো খালের মোহনায় অবস্থিত জমজমাট ভাসমান বাজার। গ্রামের পেয়ারা চাষীরা ছোট ছোট নৌকায় করে নিজের বাগানের পেয়ারা পেড়ে এনে জড়ো করে মাঝারি আকৃতির নৌকায়। সেই সব নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে খালের বিভিন্ন প্রান্তে।
মূল বাজারটি বসে ঝালকাঠি জেলার ভীমরুলি গ্রামে তিনটি খালের মোহনায়। গ্রামের নামানুসারে এই বাজারের নাম হয়েছে ভীমরুলি বাজার। বিক্রেতারা নৌকা ভর্তি করে পেয়ারা নিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াতে থাকে। আর সেই পেয়ারা কিনতে পাইকাররা আসে খালি নৌকা নিয়ে।
পাইকারি হিসেবে কম দামে পেয়ারা ক্রয় করে সেই পেয়ারা ছড়িয়ে দেয় ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, চাঁদপুর, স্বরূপকাঠি সহ বিভিন্ন অঞ্চলে। আর সবথেকে মজার বিষয় হলো এখানকার প্রতিটি নৌকাই দেখতে একই রকম ও একই আকৃতির। মনে হয় একজন কারিগর পুরো বাজারের সব নৌকা নিজ হাতে তৈরি করেছে। একসাথে সারিবাঁধা একই রকম শত শত নৌকা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
একটি ছোট নৌকা নিয়ে পুরো বাজারটি ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে চলে যেতে পারেন ছোট খাল বেয়ে বিভিন্ন গ্রামের ভেতর। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনায়ই পেয়ারা, আমড়া, সুপারি ও লেবু গাছের ঝোপঝাড়ে বেষ্টিত থাকে বারোমাস। সে যেন ছবির মতো গ্রাম। গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, বাচ্চাদের হুটোপুটি, খালের পাড়ের স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ সব কিছুই আপনার চোখ জুড়াবে।
চাইলে বাড়ির মালিকের অনুমতি নিয়ে তাদের বাগানে ঢুকে ঘুরেফিরে দেখতে পারেন। অনুমতি নিয়ে দু চারটা পেয়ারাও খেতে পারবেন আবার কম দামে পেয়ারা কিনতে পারবেন। আর নিজ হাতে গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে কিনে আনার ব্যাপারটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
বন্ধুবান্ধব একসাথে মিলে নেমে পড়তে পারেন খালের পানিতে। খালের পরিষ্কার শীতল পানিতে শরীর মন দুটোই প্রশান্তিতে ভরে উঠবে। আর সবথেকে মজার বিষয় হলো যখন ছোট খাল বেয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকবেন তখন দেখা যাবে খালের পাশের গাছগুলো পেয়ারার ভাড়ে একদম খালের দিকে ঝুকে পড়েছে, তখন চাইলে নৌকায় বসেই গাছ মালিকের অনুমতি চেয়ে দু চারটে পেয়ারা ছিড়ে চিবোতে পারবেন।
ভাসমান পেয়ারা বাজারের আসেপাশে ব্যক্তি মালিকানায় ছোট খাটো কয়েকটি রিসোর্ট তৈরি করা হয়েছে। এসব রিসোর্টেও কিছুটা সময় কাটিয়ে নেয়া যাবে। রিসোর্ট ভেদে প্রবেশ মূল্য ২০ থেকে ৩০ টাকার মতো লাগতে পারে।
ভ্রমন শেষে বরিশাল ত্যাগ করার আগে ঘুরে দেখতে পারেন বরিশালের গুঠিয়া মসজিদ, দূর্গাসাগর দিঘি, কীর্তনখোলা নদীর তীরের ত্রিশ গোডাউন বা মুক্তিযোদ্ধা পার্ক। মোটকথা সব মিলিয়ে আকর্ষণের কোনো শেষ নেই বললেই চলে।
ভাসমান পেয়ারা বাজার যাওয়ার উপায়
ভাসমান পেয়ারা বাজার যাওয়ার বেশ কিছু রুট থাকলেও প্রথমে বরিশাল হয়ে সেখান থেকে পেয়ারা বাগান যাওয়াই সবথেকে সহজ এবং এতে করে একসাথে অনেকগুলো স্পট ঘুরে দেখার সুযোগ হবে।
ঢাকা থেকে বরিশাল
ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার জন্য সড়কপথ, নদীপথ কিংবা আকাশপথ বেছে নিতে পারেন৷ তবে আপনি যদি এডভেঞ্চার প্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে নদীপথে যাওয়াই ভালো। তবে সড়কপথে গেলে পদ্মাসেতুর ওপর থেকে ভ্রমনের সুযোগ হবে।
নদীপথে যেতে চাইলে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে উপস্থিত থাকতে হবে ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। এখান থেকে রাত আটটায় বরিশালের উদ্যেশ্যে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল লঞ্চ ছেড়ে যায়। লঞ্চ গুলোও এক একটি দর্শনীয় স্থানে ভ্রমনের মতো অনুভূতি জোগাবে।
লঞ্চের ইন্টেরিয়র ও রাতের জ্যোৎস্না মাখা নদীতে ভ্রমণ আপনাকে মুগ্ধ করবে। সকাল ৬ টার মধ্যে পৌছে যাবেন বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালে।লঞ্চের ডেক ভাড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কেবিনের সুযোগ সুবিধা ও বেড সাইজ অনুযায়ী কেবিন ভাড়া এক হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
সড়কপথে বরিশাল না গিয়ে সরাসরি স্বরূপকাঠির বাসে উঠলে সবথেকে বেশি ভালো হয়। ঢাকার সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, আব্দুল্লাহপুর, নবীনগর, সাভার থেকে বরিশাল অথবা স্বরূপকাঠি গামী বাসে উঠতে হবে। ঢাকা বরিশাল রুটে সাকুরা, গ্রীন লাইন, বি এম এফ, সোনার বাংলা, হানিফ ইত্যাদি বাস নিয়মিত চলাচল করে। সুযোগ সুবিধা ও ক্লাস ভেদে বাস ভাড়া ৪০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে হবে। সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশাল পৌছুতে সময় লাগবে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা।
আকাশপথে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা টু বরিশাল প্লেনের ফ্লাইট ধরতে হবে। ঢাকা টু বরিশাল রুটে নভোএয়ার এয়ারলাইন্স, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে। সুযোগ সুবিধা অনুসারে ভাড়া তিন হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
বরিশাল থেকে ভাসমান পেয়ারা বাজার
বরিশাল লঞ্চ ঘাট থেকে চৌমাথা হয়ে বাসে চেপে অথবা মাহিন্দ্রা বা লেগুনা ভাড়া করে চলে যেতে হবে স্বরূপকাঠি। ঠিক একই ভাবে বরিশাল নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে এবং বরিশাল বিমানবন্দর থেকে মাহিন্দ্রা বা লেগুনা ভাড়া করে চলে যেতে পারবেন স্বরূপকাঠি লঞ্চ টার্মিনালে। এখান থেকে ইঞ্জিন নৌকা সারাদিনের জন্য ভাড়া করে চলে যেতে পারবেন ভাসমান পেয়ারা বাজার।
এক দিনের জন্য নৌকা ভাড়া এক হাজার থেকে পনেরোশত টাকা নিতে পারে। স্বরূপকাঠি থেকে যাত্রা শুরু করে একে একে আটঘর, কুড়িয়ানা, ভীমরুলি বাজার ঘুরে দেখতে পারবেন। সারাদিন ঘুরেফিরে বিকেলের দিকে বরিশাল ফিরে বরিশাল সদরের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। রাতের ফিরতি লঞ্চে আবার ঢাকায় ফেরত আসতে পারবেন। চাইলে একরাত বরিশাল কাটিয়ে পরের দিন বরিশাল শহর ঘুরে দ্বিতীয় দিন ঢাকায় ফিরে আসতে পারেন।
থাকার ব্যবস্থা
রাতে থাকার জন্য ভালো ব্যবস্থা চাইলে চলে আসতে হবে বরিশাল শহরে। নথুল্লাবাদা বাস স্টেশনের আসেপাশে, লঞ্চ টার্মিনালের আসেপাশে ও সদর রোডে বেশ কিছু ভালো ও সাধারণ মানের হোটেল পাবেন। ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে বেশ স্বাচ্ছন্দে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। আর ঐ দিনই ফিরে যেতে চাইলে লঞ্চই হতে পারে আপনার রাত্রিযাপনের সবথেকে ভালো অপশন।
কী খাবেন?
ভাসমান বাজারে সকাল সন্ধ্যা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে পারবেন। এছাড়া কুড়িয়ানা বাজারের ঋতুপর্ণা মিষ্টির দোকানের গরম গরম মিাষ্টি, ভীমরুলি বাজারের লাল ও সাদা মিষ্টি, বরিশালের বাজার রোডের বিখ্যাত হকের রসগোল্লা, বটতলা বাজারে শশীর মিষ্টি, নয়া বাজারের নিতাইয়ের স্পঞ্জ মিষ্টি, গুঠিয়ার সন্দেশ এই অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার। তাছাড়া হাতে সময় বেশি থাকলে বিবির পুকুর পাড়ের চটপটি, দই চিড়া, ঘোল মুড়ি খেয়ে আসতে পারেন।
নৌকা নিয়ে ভাসতে ভাসতে সওদা করা সে যেন এক স্বপ্নের ভূবন। অথৈ পানিতে ভেসে কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়ার মতো এডভেঞ্চার শুধু ভাসমান পেয়ারা বাগানেই সম্ভব। গ্রাম বাংলার চিরাচরিত রূপ ফুটে ওঠে এই গ্রামগুলির মধ্যে। যাওয়া আসার পথ টুকুও যেন এক এডভেঞ্চার। সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে ছুটির দিনগুলো কাটাতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন এশিয়ার বিখ্যাত ভাসমান পেয়ারা বাজার থেকে।