চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রয়েছে নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি। এই জেলার সাধারণ বাড়ির গৃহিনীদের হাতের ছোয়ায় এখানকার রান্নায় এসেছে নানা বৈচিত্র্যতা। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষ মিষ্টান্নের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল। এই জেলায় আছে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান, যেসব দোকানে তৈরি করা হয় হরেক রকমের সুস্বাদু মিষ্টি। সব মিলিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় হদিস মিলবে অসাধারণ স্বাদের বিভিন্ন সব খাবারের।চলুন জেনে নেয়া যাক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার গুলো সম্পর্কে।
১. ছানামুখী
ছানা দিয়ে তৈরি কিছুটা শক্ত ও মিষ্টি স্বাদের মুখরোচক খাবার ছানামুখী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় সবগুলো মিষ্টির দোকানেই বিখ্যাত এই মিষ্টি পাওয়া যায়। যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে বা খুশির সংবাদ শুনলে এই জেলায় ছানামুখী খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মূলত ছানামুখী মিষ্টির জন্যই পুরো বাংলাদেশে বিখ্যাত।
এক কেজি ছানামুখী মিষ্টি তৈরির জন্য লাগে ৮ লিটার দুধ ও এক কেজি চিনি। দুধ থেকে ছানা বের করে ভালো করে পানি ঝড়িয়ে ফ্রিজে রাখা হয় একদিনের জন্য। ছানা শক্ত হয়ে গেলে চিনির সিরায় জ্বাল করা হয়। ফলে চিনির কোটিং হয়ে বাইরের অংশটা শক্ত হয়ে যায় ও ভেতরে থাকে কিছুটা রসালো। এক কেজি ছানামুখী মিষ্টির দাম সাধারণত ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা হয়ে থাকে।
২. ছানার পোলাও
নাম ছানার পোলাও হলেও, আসলে কিন্তু এটি পোলাও না। ছানার পোলাও মিষ্টান্ন জাতীয় এক ধরনের খাবার যা ছানা, ময়দা, চিনি ও গরম মসলা দিয়ে তৈরি করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় প্রতিটি দোকানেই ছানার পোলাও নামক মিষ্টান্ন পাওয়া যায়।
কড়াইয়ে খুবই পাতলা করে চিনির সিরা তৈরি করা হয়। অন্যদিকে ছানার সাথে ময়দা মেখে পাতলা ডো তৈরি করে মেশিনের সাহায্যে ঝুড়ির মতো পাতলা ও চিকন আকৃতির মিষ্টি ভেজে নেয়া হয়। তেল ঝরিয়ে ঝুরঝুরে মিষ্টিগুলো ডুবিয়ে দেয়া হয় চিনির সিরার মধ্যে। কিছুক্ষণ পরে সিরা থেকে তুলে সব সিরা ঝরিয়ে ঝরঝরে করে নেয়া হয়। সুস্বাদু ছানার পোলাওয়ের ওপর ছোট ছোট গুটি মিষ্টি দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়।
৩. রাজভোগ মিষ্টি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি গুলোর মধ্যে রাজভোগ মিষ্টি বেশ জনপ্রিয় ও সুস্বাদু। এই জেলার প্রায় সব মিষ্টির দোকানে রাজভোগ মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি করা হয়।
রাজভোগ মিষ্টি তৈরিতে বাদাম ব্যবহার করা হয় এবং এটিই এই মিষ্টির বিশেষত্ব। কাঠবাদাম, পেস্তা বাদাম, কাজু বাদাম ও এলাচ একসঙ্গে পিষে গুঁড়ো করে নেয়া হয় প্রথমে।

ছানা মথে তার সাথে ময়দা, সুজি ও বাদাম গুঁড়ো একসাথে মেখে মন্ড বানিয়ে নেয়া হয়। সেই মন্ড হাতে নিয়ে ছোট ছোট গোলাকৃতির মিষ্টি তৈরি করে চিনির সিরায় ডুবিয়ে জ্বাল করে তৈরি করা হয় দারুণ মজার রাজভোগ মিষ্টি। নামেও যেমন রাজকীয় ভাব তেমনই এই মিষ্টি স্বাদের দিক থেকেও রাজকীয়।
৪. রুটির তোজ
চালের রুটি সব জেলাতেই কম বেশি খাওয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়ও চালের রুটি বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এই জেলায় চালের রুটি একটু ভিন্ন স্টাইলে খাওয়া হয়। পুরোপুরি সাধারণ চালের রুটির মতো রুটি বানিয়ে নেয়া হয় প্রথমে। তারপর ভাজা রুটিকে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় কিছুক্ষণের জন্য।
রুটি ভাজা তাওয়ায় কলা পাতা দিয়ে ভেজা রুটি উঠিয়ে পাতার উপরে দেয়া হয়। উপর থেকে আরেকটা কলাপাতা দিয়ে মচমচে করে আবার সেই রুটি ভাজা হয়। চালের রুটি ভিজিয়ে আবার কলাপাতায় দিয়ে তৈরি করা এই খাবারকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘রুটির তোজ’। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ সাধারণ রুটির থেকে রুটির তোজ খেতে বেশি পছন্দ করে।
৫. মাংস পুরি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খুবই সুস্বাদু ও মুখরোচক পিঠা মাংস পুরি। বিভিন্ন জেলায় এই পিঠা মাংসের পিঠা, সমুচা পিঠা, সংসয় পিঠা ইত্যাদি নামে পরিচিত। শীতের সময় বা কুরবানির ঈদের ছুটিতে বাড়ির মহিলারা এই পিঠা বানায়৷
মাংসের পিঠা বানানোর মূল উপকরণ চালের গুড়ো ও মাংস। গরু, মুরগি কিংবা খাসির মাংস দিয়ে মাংস পুরি বানানো হয়। তবে সাধারণত গরুর মাংস দিয়ে পিঠা বানানোর প্রচলনই সবথেকে বেশি।
মাংসের কিমা করে সব মসলা দিয়ে ভুনা করা হয়। অন্যদিকে চালের গুড়ো সিদ্ধ করে ছোট ছোট রুটির মতো বেলে তার মধ্যে মাংসের কিমা দিয়ে ভাজ করে পাশ গুলো মুড়ে দেয়া হয় ডিজাইন করে। দেখতে পুরোপুরি নারকেল পুলি পিঠার মতো। তৈরি করা পিঠা গুলো তেলে ভেজে গরম গরম পরিবেশন করা হয়।ভেতরে পুরোটা মাংসের পুর দেয়া থাকে বলে খেতেও হয় অসাধারণ।
৬. হান্দেশ পিঠা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় পিঠা হলো ‘হান্দেশ পিঠা’। অঞ্চল ভেদে এই পিঠাকে নকশি পিঠা, ফুল পিঠা বা খেজুর কাটা পিঠা বলা হয়। হান্দেশ পিঠার ডিজাইন এতোটাই অপূর্ব যে খাওয়ার থেকেও দেখতে বেশি ভালো লাগে। নতুন জামাই আপ্যায়নে, বেয়াই বাড়িতে উপহার হিসেবে পাঠাতে এই পিঠার জুরি মেলা ভার। গৃহস্থ বাড়ির মহিলাদের নৈপুণ্য ও গুনের পরিচয় ফুটে ওঠে এই পিঠার মাধ্যমে।
চালের গুড়ো সেদ্ধ করে ভালোভাবে মথে ছোট ছোট গোলাকৃতির কাই তৈরি করে নেয়া হয়। খেজুর কাটা দিয়ে কেটে কেটে সেই কাইয়ের উপর ফুটিয়ে তোলা হয় বাহারি নকশা। নকশা কাটা পিঠা তেলে ভাজলে হয় একদম মুচমুচে। ভাজা পিঠা খালি খাওয়া হয় আবার গুড়ের পাক দিয়েও খাওয়া যায়। দেখতে যেমন সুন্দর খেতেও তেমনই সুস্বাদু ‘হান্দেশ পিঠা’।
৭. করলার তরকারি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার প্রিয় একটি খাবার করলার তরকারি। অতিরিক্ত তিতা স্বাদের কারনে করলা সাধারণত পাতলা করে কেটে ভাজি খাওয়ার প্রচলনই সবথেকে বেশি। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষ অন্যান্য সবজির মতো কেটে আলু দিয়ে করলা রান্না করে খায়। নিজস্ব অথেনটিক রেসিপিতে রান্না করা তরকারিতে তিতা স্বাদ তুলনামূলক অনেক কম হয়। কেউ কেউ রান্না করে মাছ দিয়ে কেউবা শুধু আলু দিয়ে নিরামিষ। গরম ভাতের সাথে করলার তরকারি খেতেও যেমন মজার তেমনই স্বাস্থ্যের জন্যও বেশ উপকারী।
৮. শুটকি ভর্তা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষের খুবই প্রিয় খাবার শুটকি ভর্তা। বিভিন্ন ধরনের শুটকি লাল মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খাওয়া হয়। গরম ভাত, খিচুড়ি বা ক্ষুদের ভাতের সাথে শুটকি ভর্তা হলে আর কিছুর দরকারই হয় না। শুটকি ভেজে তার সাথে পেয়াজ, মরিচ, রসুন ভাজা দিয়ে পাটায় বেটে তৈরি করা হয় সুস্বাদু শুটকি ভর্তা। ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বাংলাদেশের অনেক জেলাতেই শুটকি ভর্তা বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার।
৯. আলুর দম
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ট্রেডিশনাল একটি খাবার আলুর দম। লুচি, পরোটা, রুটি কিংবা গরম ভাতের সাথে আলুর দম মাংসের স্বাদকেও হার মানায়।
আলুর দম তৈরির প্রধান উপকরণ আলু। আলু নিজের ইচ্ছে মতো সাইজ করে কটে একটু ভাপিয়ে নিয়ে সব ধরনের মাংসের মসলা দিয়ে রান্না করা হয় আলুর দম। সকালের নাশতায় বা বিকেলের হালকা খাবার হিসেবে আলুর দমের সাথে রুটি, লুচি বা পরোটা খাওয়ার প্রচলন এই জেলায় খুব বেশি।
১০. গাঁগড়া
গাঁগড়া এক ধরনের বুনো সবজি, যা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষের কাছে বেশ প্রিয় খাবার। গাঁগড়া মূলত চাষ করা হয় না, এটি ক্ষেতে-খামারে, আনাচে-কানাচে এমনিই হয়ে থাকে। মাঠ থেকে তুলে এনে গাছের কান্ড টুকু শুধু খাওয়া হয়। পাতা ফেলে দিয়ে কান্ডের আাশ ছাড়িয়ে মাছের সাথে রান্না করা হয় গাঁগড়া। এটি একটু ঝাঁঝালো স্বাদের খুবই সুস্বাদু সবজি।
বিভিন্ন ট্রাডিশনাল খাবার ও মিষ্টান্নের জন্য বিখ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষ আতিথেয়তার দিক থেকেও বেশ এগিয়ে। বাড়িতে মেহমান আসলে বাড়ির মহিলারা খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেন অতিথি আপ্যায়নের জন্য।