অনেকদিন হলো সুন্দরবনে যাওয়া হয় না। ম্যানগ্রোভের স্বাদ নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। তাই ম্যানগ্রোভ এর ভূত মাথা থেকে নামাতেই অনেকটা হঠাৎ করেই দলবল নিয়ে এক বৃহস্পতিবার রাতে উঠে পড়লাম বাগেরহাটের বাসে।
খ্যাতির বিড়ম্বনার মত অতি উন্নয়ন এরও এক মধুর বিড়ম্বনা আছে। পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের দক্ষিণের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই সহজ হয়ে গিয়েছে যে সায়দাবাদ থেকে রাত বারোটার বাস আমাদেরকে নামিয়ে দিল যখন বাগেরহাট তখন কেবল রাত ৩ টা পার। যদিও যাব আমরা ভিন্ন পথে সুন্দরবন কিন্তু তবুও বাগেরহাট না ঘরেই সুন্দরবন যেতে ঠিক মন সায় দিচ্ছিল না। ফজরের আজানের পর ভোরের আলো পড়তেই আমরা পথ ধরলাম বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদের দিকে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের বাগেরহাট এর প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে খুলনা- বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তরে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত। ২০ টাকা টিকিট এই ঢুকতে পারা যায় মসজিদ কমপ্লেক্সে। মসজিদের গায়ে কোন শিলালিপি অঙ্কিত নেই। তাই এটি কে কিংবা কোন সময় নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে মসজিদটির স্থাপত্য শৈলী দেখলে এটি যে খান জাহান ই নির্মাণ করেছিলেন সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকে না। ধারণা করা হয় তিনি ১৫ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদটি বহু বছর ধরে ও অনেক অর্থ খরচে নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদের পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মধ্যে একটি।
মসজিদটি উত্তর দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভেতরে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা আর পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভেতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া ।এর দেয়ালগুলো প্রায় সাড়ে আট ফুট। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন এ মসজিদটিকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়।
ষাট গম্বুজ মসজিদটি বাগেরহাট শহরকে বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহরের মধ্যে স্থান করার সুযোগ করে দিয়েছে। মসজিদের পূর্ব দিকের দেয়ালে ১১ টি বিরাট আকারের খেলানযুক্ত দরজা রয়েছে। এরমধ্যে মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর তুলনায় বেশ বড়।

উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে সাতটি করে দরজা। আর মসজিদের চার কোনে চারটে মিনার ও আছে। এগুলোর নকশা গোলাকার ও উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এদের কার্নিশ এর কাছে বলয় আকার ব্যান্ড ও সুরাই গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনার গুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশের চেয়ে বেশি। সামনের দুটি মিনারে প্যাচানো সিঁড়ি আছে।
এখান থেকে নাকি আযান দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল একসময়। কিন্তু তা এখন বিলুপ্ত। এর প্রচলন বর্তমানে নেই। এদের একটির নাম রওশন কোঠা অপরটির আন্ধার কোঠা। মসজিদের ভেতরে ৬০ টি স্তম্ভ বা পিলার রয়েছে যেগুলো উত্তর থেকে দক্ষিনে ছয় সারিতে অবস্থিত এবং প্রত্যেক সারিতে দশটি করে স্তম্ভ রয়েছে। প্রতিটি স্তম্ভ পাথর কেটে বানানো কিন্তু শুধু পাঁচটি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই ৬০ টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেওয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ।
অবাক করার বিষয় হলো মসজিদের নাম ষাট গম্বুজ মসজিদ হলেও এখানে গম্বুজ কিন্তু ৬০ টি নয় বরং মসজিদটিতে গম্বুজের সংখ্যা ৭৭ টি মতান্তরে ৮১ টি। ৭৭ টি গম্বুজের মধ্যে ৭০ টির উপরিভাগ গোলাকার। পূর্ব দেওয়ালের মাঝের দরজা ও পশ্চিম দেওয়ালের মাঝে মেহরাবের মাঝের সাডরির সাত গম্বুজ দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চলার মত।
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। এখানে কৃত্রিমভাবে কোন এসি লাগানো নেই কিন্তু মসজিদের ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যে গরমের দিনে বাইরে থেকে বাতাস ভেতরে প্রবেশ করে এবং নামাজীরা এখানে প্রশান্তি অনুভব করেন। মসজিদটি ঘুরে দেখার পরে আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম।
পরবর্তী গন্তব্য সিংগাইর মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদের প্রায় ৩০০ গজ দক্ষিণ পূর্ব দিকে এই সিংগাইর মসজিদটি অবস্থিত। এই মসজিদে একটিমাত্র গম্বুজ বিদ্যমান। খানজাহান আলীর নিজস্ব স্থাপত্য শৈলী অনুযায়ী গম্বুজ টি পুরো দেওয়ালের ওপর দন্ডায়মান এবং এর শীর্ষে আছে বাঁকানো কার্নিশ।
মসজিদের প্রত্যেক বাহু বাইরের দিকে ৩৯ ফুট ও ভেতরের দিকে ২৫ ফুট লম্বা। ইট নির্মিত মসজিদটির প্রাচীর গুলো প্রায় সাত ফুট প্রশস্ত। মসজিদের পূর্ব দেওয়ালে আছে প্রবেশের পথ এবং প্রবেশ পথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি অলংকৃত মেহরাব।
তবে কেন্দ্রীয় মেহেরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় ও সুসজ্জিত। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন এই সিংগাইর বা সিংড়া মসজিদের নির্মাণকাল আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। সিংগাইর মসজিদ কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে আমরা এবার পথ ধরলাম হযরত খানজাহান আলীর মাজারের পথে।

খান জাহান আলী
বাংলাদেশে যে কয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে বাগেরহাট জেলাটি সু পরিচিতি লাভ করেছে হযরত খানজাহান আলী রহ. তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মূলত ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও বাংলাদেশের যশোর ও বাগেরহাট অঞ্চলে আসেন ধর্ম প্রচার করতে।
বাগেরহাটে নির্মাণ করেন স্মরণকালের বিখ্যাত মসজিদ ষাট গম্বুজ মসজিদ। তার সমাধি সৌধটি বর্গাকৃতি। এর আয়তন ৪২ ফুট বাই ৪২ ফুট ও প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট। এর ছাদে একটি গম্বুজ আছে। সমাধি সৌধটির ভেতরে একটি প্রস্তর নির্মিত ব্যাধিতে হযরত খানজাহান রহ. এর মাজার অবস্থিত।
দরগা বা সমাধি সৌদের স্থাপত্য শিল্প অনেকটা ষাট গম্বুজের ন্যায়। এখানে শিলালিপিতে তার দাফন তারিখ ও মৃত্যু তারিখ ছাড়াও লিপিবদ্ধ আছে আল্লাহর নাম ও কোরআন শরীফের কয়েকটি সূরা এবং তার উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক ইত্যাদি।
পরবর্তী গন্তব্য খাঞ্জলি দিঘী
হযরত খানজাহান আলী রহ এর মাজারের দক্ষিণ দিকে এই খাঞ্জেলি দিঘিটি অবস্থিত যার আয়তন প্রায় ২০০ বিঘা। হযরত খানজাহান আলী কালাপাহাড় ও ধলা পাহাড় নামে কয়েকটি কুমির এই দীঘিতে ছেড়েছিলেন।
এই কালাপাহাড় ও ধলা পাহাড় নামে দুটি বিরাট সাইজের কুমির কিন্তু পরবর্তীতে মারা যায়। পরবর্তী সময়ে কিছু মিঠা পানির কুমের দিকে ছাড়া হয়। মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগত লোকজন প্রধানত দিকের এই কুমিরগুলোকে হাঁস, মুরগি ,ভেড়া, খাসি সহ বিভিন্ন ধরনের মানতের পশু উৎসর্গ করেন।
কালাপাহাড় মারা যাওয়ায় ষাট গম্বুজ মসজিদের জাদুঘরে মমি করে রাখা হয়েছে। দেখে প্রধান ঘাটটি প্রশস্ত ও সুন্দর এবং মনমুগ্ধকর। এখানে নারীদের জন্য আলাদা ঘাটের ব্যবস্থা রয়েছে। এই দিকের পানি সুপেয়।
এই দিঘিকে ঠাকুর দিঘী বলেও ডাকা হয়। এইখান জেলি দিকের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। কারো কারো মতে বৌদ্ধ ঠাকুরের মূর্তি প্রাপ্তির জন্য এর নাম হয় ঠাকুরদিঘী। কেউ কেউ বলেন খান জাহানকে দেশীয় হিন্দুগণ ভক্তি ভরে ঠাকুর বলতেন ও তারই বিশেষ তত্ত্বাবধানে এই দিঘীখনন করা হয় বলে তাদের ভক্তিভজন ঠাকুরের নাম অনুসারে একে ঠাকুর দিঘী বলা হতো।
আমরা স্থানীয় কিছু মানুষের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলাম তারাও একই মতবাদ স্বীকার করল। এভাবে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ শেষে আমরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এজন্য আমরা একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাবারের মান এবং দাম দুইটি ছিল অনেক উন্নত। ঐতিহ্যবাহী এই বাগেরহাট ভ্রমণ করে আমরা অনেক আনন্দিত ছিলাম। পরে আবার সময় পেলে আবারো বাগেরহাট ভ্রমণের সংকল্প করলাম।