সোমেশ্বরী নদী। এই নদীর সাথে আমার শৈশবের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সংক্ষিপ্ত আকারে এই নদীর ইতিহাস বলে নেই তারপর আমার গল্প শুরু করব।
বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুর উপজেলায় সোমেশ্বরী নদী অবস্থিত।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া ও বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্র হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি হয়।
এক সময় এই নদীটি সিমসাং নামে পরিচিত ছিল। ৬৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে সোমেশ্বর পাঠক নামের লোক এই অঞ্চল দখল করে। এর পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি লাভ করে। মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার হয়ে বাংলাদেশের রাণীখং পাহাড় ঘেঁষে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঘমারা মুক্তিবাহিনীদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল।
আমার বাড়ি থেকে সোমেশ্বরী নদী কয়েক কিলোমিটার পূর্ব দিকে। আমার এলাকার বহু মানুষ সুসং দুর্গাপুরে ভূমি অফিস যেত জমিজমার কাগজপত্র ঠিক করতে। সেই সুবাদে আমার এলাকার মানুষজন সোমেশ্বরী নদীর সাথে পরিচিত। ছোটবেলায় বন্ধুরা মিলে সাইকেলে করে এই নদী দেখতে যেতাম। পাহাড়ে ঘুরতাম। আমরা সাধারণত শরৎ কালে যেতাম। কেননা এই সময় বৃষ্টি হতো না। নদীর পানি থাকতো নীল ও একদম স্বচ্ছ।
ছোটবেলায় যখন এই নদীটা দেখতাম তখন মনের মাঝে অনেক ভাবের সঞ্চার হত।
মনে হতো, নীল আসমান থেকে সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় নীলকান্তিমণি গলে গলে পড়ছে আর বয়ে চলছে। এই নীল জল ধারায় নীল একাকীত্ব। নিচে চকচকে বালুকারাজি। উত্তরের সুউচ্চ পাহাড়। নদীর তীরে ধবধবের সাদা কাশফুল; যেন আকাশের মেঘ নিচে নেমে এসেছে। সোমেশ্বরী হিম শীতল জলে হাত ডুবালে শরীরে শিহরণ জাগে।
এই মনমুগ্ধকর প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে এত গভীর ভাবের অনুভূতি হতো যে, তখন বিশ্বাস করতেই হয় এই জামানার ভিড়ে আমারও অস্তিত্ব আছে। যান্ত্রিক সভ্যতার আড়ালে আমিও একটি প্রকৃতির অংশ।
এই নদীর বালি বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর বালির মতো সাদা নয়। এই বালির দানাগুলো মোটা এবং কাঞ্চন বর্ণের। সেখানে অনেক মহিলা এবং শিশুরা এই বালি খুঁড়ে খনিজ কয়লা সংগ্রহ করে। পুরুষেরা নদীর মাঝখান থেকে ডুব দিয়ে চালুনি দিয়ে ছোট নুড়ি পাথর সংগ্রহ করে। এগুলো খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। কিন্তু তারা তাদের কাজের ন্যায্য মূল্যটাও পায় না।
নদী পারাপারের জন্য ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও এখনো বহু মানুষ নৌকা দিয়ে নদী পার হয়। শৈশবে যখন আমি এখানে যেতাম তখন এত পর্যটকের আনাগোনা ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে পর্যটকের সংখ্যাও বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে নৌকার সংখ্যা। অল্প টাকা দিয়েই এখানে নৌকা ভাড়া করে এখন নদী ভ্রমণ করা যায়।
পর্যটকদের জন্য দিক নির্দেশনা
ঢাকা থেকে এখানে যাওয়ার জন্য রেল ও বাস দুটো ব্যবস্থাই আছে।
বাসঃ মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি অনেক বাস সুসং দুর্গাপুর ও নেত্রকোনা শহরে যায়। তবে জিন্নাত ও সরকার নামে দুটি বাস এর সার্ভিস খুব ভালো। ভাড়া ৩০০-৩৫০ টাকা। আপনি যেকোনো একটি বাসে উঠে সহজেই চলে যেতে পারবেন।
রেলঃ কমলাপুর থেকে খুব ভোরে জারিয়া-ঝাঞ্জাইল স্টেশনে ট্রেন যায়। জারিয়া-ঝাঞ্জাইল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তরে সুসং দুর্গাপুর। সিএনজি ভাড়া সর্বচ্চো ৫০ টাকা। জারিয়া-ঝাঞ্জাইল স্টেশনটা ছোট হলেও এটা সেই ব্রিটিশ আমলের। একটা সময় এই স্টেশন সংলগ্ন বাজারটা খুবই জমজমাট ছিল। যখন নদী ও রেলপথে পণ্য আনা-নেওয়া হতো।
থাকার স্থানঃ এখানে মাত্র দুইটি হোটেল রয়েছে। একটি স্বর্ণা গেস্ট হাউস (01712-284698) অন্যটি হোটেল সোমেশ্বরী লাক্সারিয়াস (01712-661232)। তবে উপজাতি গারোদের বিরিসিরি কালচারাল একাডেমীতে একটি ডাক বাংলো আছে। সেটা শুধুমাত্র সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য সীমিত।
হোটেল গুলো অতটা উন্নত না হলেও যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কেননা পর্যন্ত যাওয়া শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক বছর ধরে। তবে তাদের ব্যবহার খুবই অমায়িক। বাংলাদেশের অন্যান্য পর্যটকবহুল স্থানে গুলোতে অনেক বাটপার শ্রেণীর লোক থাকে। যাদের কাজ হচ্ছে পর্যটকের কাছ থেকে ছল-চাতুরি করে অধিক টাকা হাতিয়ে নেওয়া। কিন্তু এরা পর্যটক আসলে অনেক খুশি হয় এবং আন্তরিকভাবে যথা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করে।
আপনি এই হোটেল গুলোতে গিয়ে আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে আসার মতো অনুভূতি পাবেন। আপনি এটাকে কোনো অচেনা স্থান মনে না করে একটি গ্রাম মনে করে আসুন। দেখবেন এখানকার গারো ও বাঙালির সৌহার্দপূর্ণ সহবস্থান ও সহজ-সরল জীবন যাত্রা।
খাবারঃ এখানে উন্নত মানের রেস্টুরেন্ট নেই। তবে যেই খাবারের হোটেল গুলো আছে সেগুলোর মান ভালো। খাবারের দামও বেশি নয়। আপনি যেকোনো একটি হোটেল ঢুকে খাবার খেতে পারেন।
দর্শনীয় স্থান সমূহ
আপনি যদি সোমেশ্বরী নদীর নীল রূপটি দেখতে চান, তাহলে শীতকাল অথবা শরৎকালে ভ্রমন করতে হবে। কেননা বর্ষাকালে পাহাড়ে বৃষ্টি আসলেই পানি ঘোলা হয়ে যায়।
বিরিশিরি কালচারাল একাডেমীঃ এটা উপজাতি গারদের একটি সংস্কৃতিক কেন্দ্র। হোটেল একটু পথ হাঁটলেই বিরিশিরি কালচারাল একাডেমী। এটার ভেতরটা অনেক সুন্দর। এখানে আছে গারোদের সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন।
এখানে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন প্রকৃতির সাথে মানুষের আদিম সম্পর্ক কেমন ছিল। কীভাবে মানুষ প্রকৃতির থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে জীবন পরিচালনা করতো তবে প্রকৃতির কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু বর্তমানে নগর সভ্যতা যেন প্রকৃতির ধ্বংস যজ্ঞে নেমেছে।
রানিখং পাহাড় ও গির্জাঃ এই রানিখং পাহাড় ঘেঁষেই সমেশ্বরী নদী প্রবাহিত। পাহাড়ে উঠতে উঠতে অবশ্য আপনার পা ব্যথা হয়ে যাবে। উচু উচু নাম না জানা অনেক বৃক্ষ। বিকেল হলেই যেন এখানে অন্ধকার নেমে আসে। শিয়ালের ডাক শুনে ভয় পাবেন না।
পাহাড়ের নিচে একটি পোস্ট অফিস রয়েছে। আপনি চাইলে সেখান থেকে আপনার নিজের ঠিকানায় অথবা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের কাছে চিঠি লিখে পোস্ট করতে পারেন। সেই চিঠি স্মৃতি হয়ে থাকবে।
চীনা মাটির পাহাড়
নদী থেকে কিছুটা পূর্ব দিকে রয়েছে বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড়। সেখানে রয়েছে সাদা ও গোলাপি রঙের চীনামাটি। চীনামাটি সংগ্রহের জন্য গভীর খনন কার্য করা হয়। যা একটি বৃহৎ পুকুরে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই পুকুরের পানি গাঢ় সবুজ। ভুলতেও এখানে সাঁতার কাটতে নামবেন না। কেননা এটা এক থেকে দেড়শ ফুট গভীর।
এই পাহাড়ের আশেপাশে কিছু বুনো ফুল গাছ আছে। যেগুলোতে গাঢ় গোলাপি রঙের ফুল ফোটে। এখানে একটি বৃহৎ বটগাছ রয়েছে। যার পাশে একটি ছোট শিলাখণ্ড। সেখানে আর্যদের অর্থাৎ হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতীক খোদাই করা। যেখানে এখনো পুষ্প অর্পণ করা হয়। কিন্তু কেউ বলতে পারে না এই পাথরটা কবে এখানে রাখা হয়েছিল। এটা একটি রহস্য।
গোপন কথা
রানিখং ও বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড়ে কিছু দোকানপাট রয়েছে। যারা ভারতীয় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। এই পণ্যগুলো গারো নারীরা ভারত থেকে সরাসরি নিয়ে আসে। কেননা তারা পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই অনায়াসে সীমান্ত পারা হতে পারে।
অন্যগুলোর মধ্যে আছে ক্যাটবেরি, কিন্ডার জয় সহ আরো অনেক ব্র্যান্ডের চকলেট। বিভিন্ন ভারতীয় সাবান ও প্রসাধনী। আনন্দের বিষয় হচ্ছে এগুলোর দাম খুবই কম। যদি কোনো পণ্যের দাম ১০ রুপি হয় তাহলে সেটা ১৫ টাকাতে বিক্রি করে। কিন্তু বাংলাদেশের মার্কেটগুলোতে এগুলো তিনগুণ দামে বিক্রি হয়। তাই পর্যটকেরা ব্যাগ ভর্তি করে এই সকল জিনিস ক্রয় করে নিয়ে আসে।
সোমেশ্বরী নদী ও সীমান্ত
সোমেশ্বরীর স্রোতে গা ভাসিয়ে আপনি সাঁতার কাটতে থাকবেন। সে সাথে অবলোকন করবেন প্রকৃতির উদার সৌন্দর্য। যদি এখন নদী পূর্ব তীরে কিছু অসাধু বালু ব্যবসায়ীরা ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। এর ফলে শব্দ দূষণ বেড়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এত বালি উত্তোলন করছে কিন্তু বালি শেষ হচ্ছে না।
আপনি যখন সীমান্তবর্তী রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন। তখন একটু গা ছমছমে ভাব আসবে। কিন্তু সেই সাথে এটাও ভাববেন যে, সামান্য একটি কাঁটাতারের বেড়া দুই পাশের মানুষকে কত সহজেই না আলাদা করে ফেলে।