বাঙালিরা ভোজন রসিক জাতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই।আমরা যে শুধু খিদে পেলেই খাই তা কিন্তু নয়।আমাদের খাওয়া দাওয়া নির্ভর করে আমাদের মুডের ওপর।এই যেমন বৃষ্টি হলেই খিচুরি, পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ,পৌষে পিঠা পুলি তাছাড়া একেক ধরনের অনুষ্ঠানে একেক রকম খাবার তো আছেই।
এতোটুকুও দেশ তবুও এলাকা ভেদে খাবারে খাবারে কতো তফাত।
এই অঞ্চলের মানুষ একটা খাবার খুব পছন্দ করে তো ঐ অঞ্চলের মানুষ সেটা খেতে তেমন পছন্দ করে না। তবুও তার মধ্য থেকেই একেক অঞ্চল ভেদে একেক খাবার হয়ে উঠেছে বিখ্যাত। যেন খাবারের নাম শুনলেই নির্দিষ্ট একটা অঞ্চলের নাম মনে ভেসে ওঠে।
আজকে পরিচয় করিয়ে দেব বরিশাল জেলার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবারের সাথে। এই খাবারগুলোর নাম শুনলেই প্রথমে বরিশালের কথা মাথায় আাসবে।তো চলুন জেনে নেয়া যাক বরিশালের বিখ্যাত কিছু খাবারের নাম।
১.বিসকি
বিসকি একমাত্র বরিশাল জেলার মানুষই খেয়ে থাকে।বরিশালের বাইরে এই খাবারটির সাথে খুব কম মানুষই পরিচিত । চাল ভেজে সেটাকে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে পরেরদিন সকালে সেই ফুলে ওঠা ভেজা চালভাজাকে নারকেল ও গুড় দিয়ে পাক দেয়া হয়।এই খাবারটি অনেকের কাছে মিঠা ভাত নামেও পরিচিত ।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দিন দিন এই বিসকি খাওয়ার প্রচলন বরিশালের স্থানীয় লোকজনদের মধ্যে থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ।
২.পাকন পিঠা বা মুগ পাকন পিঠা
বরিশাল অঞ্চলে পাকন পিঠা না হলে তো বিয়েই হয়না বললেই চলে।মেয়ে দেখতে আাসা থেকে শুরু করে বিয়ের পরে বেয়াই বাড়িতে পিঠা পুলি পাঠানো পর্যন্ত যতোগুলো আনুষ্ঠানিকতা আছে তার সবগুলোতেই পাকন পিঠা থাকা চাই ই চাই। এছাড়া যে কোনো চোটখাট অনুষ্ঠান,অতিথি আপ্যায়নে পাকন পিঠার কদর সবার আগে।
চলের গুঁড়ো বা ময়দা রুটির কাইয়ের মতো নারকেলের দুধ দিয়ে সিদ্ধ করে সেই কাই ভালোবাভে নরম করে বিভিন্ন ডিজাইনের ফুল, পাতার নকশা করে পিঠা তৈরি করা হয়।এই পিঠা তেলে ভেজে আবার দুধ চিনির/গুড়ের সিরায় ভেজানো হয়।
৩.মলিদা
শুধুমাত্র বরিশালের মানুষই চিনবে এই মলিদা।বিশেষ করে রমজান মাসে এই আইটেমটি বরিশালবাসীর ইফতারিতে বিশেষ মর্যাদা পায়।সারাদিন রোজা রাখার পরে এক গ্লাস মলিদা শরবত রোজাদারের সকল ক্লান্তি দূর করে দেয়।বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ও অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার এই মলিদা।
চালের গুড়ো, পানি,চিনি/গুড়,কাচা আদার রস বা থেতলানো আদা, কিছুটা মুড়ি একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে তৈরি করা হয় বরিশাল বাসীর প্রিয় খাবার মলিদা।
৪. গৌরনদীর বিখ্যাত দই
পুরো বরিশাল জুড়ে গৌরনদীর দই অত্যন্ত জনপ্রিয়। দই কেনার কথা মাথায় আসলেই আগে মনে পড়ে গৌরনদীর দইয়ের কথা। পুরো বরিশাল শহর জুড়ে প্রতিটা মিষ্টির দোকানেই এই গৌরনদীর দই বিক্রি হয়।

এই দই এতোটাই বিখ্যাত যে, পুরো বরিশাল শহরের এতোবড় মার্কেট প্লেসে একচেটিয় ভাবে এই গৌরনদীর দই কর্তৃপক্ষই ব্যবসা করছে।
সারাদিন গোয়ালারা ঘুরে ঘুরে মন কে মন দুধ সংগ্রহ করে।সেই দুধকে জ্বাল করতে করতে একদম হলুদ করে ফেলা হয়।তারপর বিভিন্ন সাইজের মাটির হাড়িতে সেই দুধ ঢেলে দৈ বসানো হয়।
৫. চুষি পিঠা (আঞ্চলিক ভাষায় “চুই” পিঠা)
বরিশালের একটি বহুল জনপ্রিয় পিঠা হলো চুষি পিঠা।অনেক অনেক অঞ্চলে এই পিঠা সেমাই পিঠা নামেও পরিচিত। শীতের দিনে গাছ থেকে রস নামিয়ে সেই রস দিয়ে খাওয়া হয় এই পিঠা।
চালের গুড়ো সিদ্ধ করে রুটির কাইয়ের মতো বানিয়ে নিয়ে সগুলোকে লম্বা লম্বা দড়ির মতো আকৃতি দেয়া হয়।সেই দড়িকে ছোট ছোট করে হাতে কেটে সেমাইয়ের মতো বানানো হয়।তারপর দুধ,নারকেল,খেজুরের রস বা গুড় দিয়ে রান্না করা হয়।চুষি পিঠা কাটাও কিন্তু একটা আর্ট, সবাই চুষি পিটা কাটতে পারে না।
৬.মোটা মুড়ি
বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলে বসে চাইলেও আপনি মোটা মুড়ি খেতে পারবেন না। একমাত্র বরিশাল অঞ্চলেই এই মোটা মুড়ি ভাজা হয়।এই মুড়িগুলো সাধারণ মুড়ির থেকে আকৃতিতে প্রায় দ্বিগুণ বড়।চিকন মুড়ির থেকে মোটা মুড়ির স্বাদও আলাদা।
নতুন ধান ওঠার সাথে সাথে এ অঞ্চলের মহিলারা মুড়ি ভাজা শুরু করে দেয়।প্রথমে চাল ভেজে নিয়ে সেই গরম চালভাজা সাথে সাথে মাটির কলসিতে গরম করতে থাকা বালুর মধ্যে ছেড়ে দিয়ে জোরে জোরে ঘুরাতে হয় কলসিটাকে।

বালুর তাপে ভাজা চাল ফেটে হয়ে যায় মুড়ি।পরে সেই মুড়িকে চেলে বালু থেকে আলাদা করা হয়।মূলত মোটা চাল দিয়ে মুড়ি ভাজা হয় বলেই এটা মোটা মুড়ি হিসেবে বহুল পরিচিত।
৭.মোয়া
বরিশালের ছোট ছোট অঞ্চলভিত্তিক হাটে মোয়া পাওয়া যাবে না এটা একেবারেই অসম্ভব। বাচ্চারা বাবা-চাচার সাথে হাটে যায়ই পলিথিন ভর্তি মোয়া নিয়ে আসার জন্য। এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার এই মোয়া।
মোয়ার মধ্যেও আছে নানা বৈচিত্র্য। মুড়ির মোয়া,চিঁড়ার মোয়া, খৈ এর মোয়া।এই খাবারটি দেখতে যেমন লোভনীয়, খেতেও তেমন সুস্বাদু।
গুড় অথবা চিনিকে হালকা পানি দিয়ে গাড় করে জ্বাল করে নিতে হয় প্রথমে, তারপর সেই জ্বাল করা গুড় বা চিনির সিরার মধ্যে মুড়ি অথবা খৈ দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে গরম গরম থাকতেই ছোট ছোট গোল গোল আকৃতির মোয়া তৈরি করে নিতে হয়।
ঠান্ডা হয়ে গেলে শক্ত হয়ে যায় তাই ঠান্ডা হওয়ার আগেই মোয়া তৈরি করে ফেলতে হয়। চিঁড়ার মোয়া তৈরির জন্য চিঁড়াকে প্রথমে তেল দিয়ে ভেজে তারপর চিনি বা গুড়ের সিরায় জ্বাল করে মোয়া তৈরি করা হয়।
৮. আমড়ার মোরব্বা
বরিশালের একটি বিখ্যাত ফল আমড়া।বরিশালের মতো এতো আমড়ার ফলন আর কোনো জেলায় হয় না।এ অঞ্চলের আমড়ার স্বাদও অনেক বেশি। এই বিখ্যাত আমড়া দিয়ে এই অঞ্চলের মহিলারা একধরনের মিষ্টি খাবার তৈরি করে, যার নাম “আমড়ার মোরব্বা”। সব যায়গায় আমড়া দিয়ে সচরাচর আচার তৈরি করা হয়, কিন্তু এই আমড়ার মোরব্বা একটু বেশিই ইউনিক।এটাকে আচারের ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না।
আমড়াকে ভালেভাবে ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে কাটা চামচ দিয়ে কেচে সব টক বের করে নিতে হয়।তারপর ভালোভাবে ধুয়ে দুধ,চিনি বা গুড় দিয়ে রান্না করা হয়। এটার স্বাদ হয় একদমই রাজকীয় স্টাইলের।এই অঞ্চলের খুবই বিখ্যাত খাবার এই আমড়ার মোরব্বা।
৯.খেজুর রসের চ্যাবা পিঠা
বরিশাল ছাড়া অন্য কোনো অঞ্চলের খুব কম মানুষই চিনে থাকবেন এই চ্যাবা পিঠা।এটা খেতে প্রায় চুষি পিঠার মতোই।বরিশাল জেলায় খেজুরের রাসের উৎপাদন ভালো হওয়ায় সাধারণত এই রস ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় এই পিঠা।এই অঞ্চলের মানুষের খুব জনপ্রিয় শীতকালীন পিঠা হলো ” চ্যাবা পিঠা”।চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা আকৃতি করে এই পিঠা বানানো হয় বলেই আঞ্চলিক ভাবে এটা চ্যাবা পিঠা নামেই পরিচিত।
চালের গুড়ো সিদ্ধ করে রুটির কাইয়ের মতো বানিয়ে, সেই কাইকে ছোট ছোট চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা লম্বাআকৃতি দেয়া হয়।তারপর দুধ,নারকেল,খেজুরের রস বা গুড় জ্বাল করে তার মধ্যে দিয়ে রান্না করতে হয় চ্যাবা পিঠা।এই পিঠা ঠান্ডা করে পরেরদিন সকালে খেলে বেশি ভালো লাগে।
১০. নারকেল বাটা দিয়ে তরকারি
বরিশালের লোকজন যে কোনো তরকারির সাথে নারকেল বাটা থেতে খুবই পছন্দ করে।যেমন কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ ও নারকেল বাটা।ঝিঙা দিয়ে চিংড়ি মাছ ও নারকেল বাটা,যে কোনো মাছ ভুনার মধ্যে নারকেল বাটা,নারকেল ও চিংড়ির ঝোল দিয়ে রুটি পিঠা,হাসের মাংসে নারকেল বাটা।
মানে যে কোনো ধরনের খাবারেই এই অঞ্চলের মানুষ নারকেলটাকে বেশি প্রাধান্য দেয়।
আর নারকেল বাটা দিয়ে তরকারি রান্না করলে সেই তরকারির স্বাদ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
আপাতত আজকের মত এটুকুই। খাবার নিয়ে আরো জানার জন্য আমাদের অন্যান্য পোস্ট পড়তে পারেন।
- চট্টগ্রামের বিখ্যাত খাবারের তালিকা
- কুমিল্লার জনপ্রিয় খাবারের তালিকা
- ঢাকার খাবার
আমরা ভবিষ্যতে আরব, ভারত, পাকিস্তান, আফগান খাবার নিয়েও আর্টিকেল পাবলিশ করবো ইনশা আল্লাহ্।