বরিশাল বিভাগের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি জেলা বরগুনা। এখানকার মানুষের মধ্যে আছে আঞ্চলিকতার ছোয়া ও নিজস্ব ঐতিহ্য। এই আঞ্চলিক সংস্কৃতির একটি বিশেষ অংশ জুড়ে রয়েছে এই এলাকার খাদ্যাভ্যাস। উৎসব অনুষ্ঠান ও পৌষ পার্বণে এই জেলার ঘরে ঘরে ধুম পড়ে যায় নানা বৈচিত্র্যের সুস্বাদু খাবারের আয়োজনের।
বরগুনা জেলার বিখ্যাত সব খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
১. চুইয়া পিঠা
বরগুনা জেলার আঞ্চলিক খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো চুইয়া পিঠা । অঞ্চলভেদে এই পিঠাকে চুষি পিঠা , চুই পিঠা বা হাতেকাটা সেমাই পিঠা বলা হয় । বরগুনা ছাড়াও বরিশাল বিভাগের প্রায় সব জেলায়ই কম বেশি এই পিঠা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে ।
চুইয়া পিঠা বানানোর জন্য ব্যবহার করা হয় চালের গুড়ো , খেজুরের রস , খাটি গাইয়ের দুধ , গাছের পরিপক্ব নারকেল ও গ্রামের মহিলাদের হাতের বিশেষ কৌশল ।
শীতের রাতে গাছ থেকে খেজুরের রসের হাড়ি পেড়ে সারারাত বসে গ্রামের মহিলারা চুইয়া পিঠা কাটেন হাত দিয়ে । সেই পিঠা রান্না করে রেখে দেয়া হয় বড় হাড়িতে । সকাল সকাল বাড়ির উঠোনে রোদে বসে পরিবার , প্রতিবেশী ও আত্নীয় স্বজনদের সাথে জমে যাওয়া ঠান্ডা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা । চুইয়া পিঠা বরগুনা জেলার সাধারণ মানুষের খুবই প্রিয় একটি শীতকালীন পিঠা ।
২. চ্যাবা পিঠা
চুইয়া পিঠার মতো একই ধাচের আরেকটা পিঠা হলো চ্যাবা পিঠা । চুইয়া পিঠার আকৃতি হয় চিকন ও ছোট ছোট , কিছুটা সেমাই এর ধাচের আর চ্যাবা পিঠা হয় ছোট , লম্বাকৃতির ও চ্যাপ্টা । চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা করে তৈরি করা হয় বলেই মূলত এর নাম চ্যাবা পিঠা ।
চুইয় পিঠার মতোই চ্যাবা পিঠা বানানো হয় চালের গুড়ো , খেজুরের রস (না থাকলে খেজুর গুড়) , নারকেল ও দুধ দিয়ে । চ্যাবা পিঠা ঠান্ডা হয়ে জমে গেলে খেতে বেশি মজা হয়।
৩. মুইট্টা পিঠা
বরগুনা জেলার একদমই প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক মুইট্টা পিঠা । গ্রাম বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে খুবই প্রচলিত একটি খাবার এই ‘মুইট্টা পিঠা’। হাতের মুঠোয় করে চেপে চেপে মুঠির আকৃতিতে বানানো হয় বলেই এর নাম হয়েছে মুইট্টা পিঠা।
মুইট্টা পিঠা বানানো হয় ভাপে সিদ্ধ করে । চালের গুড়ো , নারকেল , গুড় একত্রে মিশিশে হালকা পানি দিয়ে একটু ভেজা ভেজা করে নেয়া হয়, যাতে হাতে নিয়ে একটু চাপ দিলেই দলা পাকিয়ে যায় । হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিলে যে দলা হয় সেটাকে ভাপে সিদ্ধ করলে পুরোপুরি শক্ত হয়ে চালের গুঁড়োর দানা গুলো একদম সেট হয়ে যায় । পিঠার উপরে হাতের আঙুলের ছাপগুলো বসে যায় , ঠিক যেন একমুঠো আটার গোলা ।
কামরে কামরে নারকেলের স্বাদ , সাথে খেজুর গুড়ের মন মাতানো সুঘ্রাণ । শীতের সকালে গরম গরম মুঠি পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা ।
৪. রুটি পিঠা
বরগুনার মানুষের খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার রুটি পিঠা । চালের রুটিকেই মূলত এই অঞ্চলের মানুষ রুটি পিঠা বলে । কোনো উৎসব অনুষ্ঠান , কোরবানির ঈদ, শীতের রাতে বা বাড়িতে মেহমান আসলে – চালের রুটি হয় সবথেকে স্পেশাল আইটেম । সারা রাত চাল বেটে রুটি বানিয়ে পুরো বাড়ির লোকজন রাত জেগে পিঠা খায়।
পিঠা বানানোর জন্য চলে আশে পাশের বাড়ির মহিলারাও। সে এক উৎসব মূখর পরিবেশ । সারা রাত ধরে চুলা জ্বলতে থাকে , একটা একটা রুটি ভেজে উঠাতে উঠাতেই খেয়ে সাবার । এভাবেই সবাই মিলে শীতের রাতে উৎসব মূখর পরিবেশে রুটি পিঠা খাওয়া অনেক বেশি আনন্দের ।
রুটি পিঠার সাথে থাকে দেশী মুরগির ঝোল , চিংড়ি মাছের সুরুয়া , আল্লান , হাঁসের মাংস অথবা গরুর মাংস ।
৫.তালের মোরব্বা
নাম তালের মোরব্বা হলেও খাবারটি কিন্তু তাল দিয়ে তৈরি করা হয় না।
একটা ধাধা আছে বরগুনার ভাষায়- ” কাঁচা খায়, পাকা কায়,হালাইয়া দিয়া আবার খায়” এর উত্তর হলো ‘তাল’। সেই ফেলে দেয়া জিনিস থেকেই তৈরি হয় তালের মোরব্বা।
কি একটু আবাক হলেন তো?
দাড়ান, বিষয়টা ক্লিয়ার করছি।
পাকা তাল থেকে তালের রস টা আলাদা করে বিচি গুলো নরম মাটির উপর বা পুরোনো অব্যবহৃত মাটির চুলার মধ্যে রেখে দেয়া হয়। মাস কয়েক পরে তালের বিচির মাথায় গজ বা শিকড় বের হয়। সেই গজ বের হওয়া তালের বিচি কাটলে ভেতর থেকে ফোমোর মতো মিষ্টি ও কিছুটা রসালো একধরনের বস্তু পাওয়া যায়। বরগুনার ভাষায় একে বলে তালের ফোঁপরা। এই ফোঁপরা শুধু খেতেও খুব মজা।
এই ফোপরা দুধ চিনি দিয়ে রান্না করে তৈরি করা হয় তালের মোরব্বা।তালের মোরব্বা বরগুনা জেলার একদমই অথেনটিক একটি খাবার।
৬. শিরনি
শরনি হলো বরগুনা জেলার একটি ট্রেডিশনাল ডেজার্ট আইটেম । বরগুনা বা বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হয় ‘শিন্নি’। এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভাবেই অনেক দেশীয় খেজুর গাছ জন্মায় । শীতের সময় গাছে হাড়ি ঝুলিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়ে ক্ষেতের ধানের আল্লা চাউল ও গাছের নারকেল কোড়া দিয়ে এক হাঁড়িতে জ্বাল করে রান্না করা হয় শিরনি বা শিন্নি।
শীতের রাতে উঠোনের মাঝখানে বড় চুলোয় শিরনি বসিয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েরা একত্রিত হয়ে চুলোর চারপাশে বসে আগুন পোহায়। রান্না হয়ে গেলে কলাপাতায় নিয়ে শিরনি খাওয়ার প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকেই ।
শিরনি নিয়ে মজার ঘটনাও আছে গ্রাম বাংলার ছেলেপেলে দের। রাতের বেলায় কয়েকজন বন্ধু বান্ধব মিলে অন্যের গাছের রসের হাড়ি পেড়ে সেই রাতের অন্ধকারে শিরনি রান্না করে মোটামুটি একটা পিকনিক আয়োজন করে। এভাবে শিরনি খাওয়ার প্রচলন বেশ জনপ্রিয় গ্রামে গঞ্জে।
৭. নাড়িকেলের সুরুয়া
একদমই আনকমন স্বাদের বরগুনা জেলার বেশ জনপ্রিয় খাবার নাড়িকেলের সুরুয়া। আগেই বলা হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে রুটি পিঠা খুব পছন্দের খাবার। আর রুটি পিঠার সাথে দারুন কম্বিনেশন হয় নাড়িকেলের সুরুয়ার । গরম গরম ফুলকো ফুলকো চালের রুটি নারিকেলের সুরুয়ায় ভিজিয়ে খাওয়া, সে যেন এক অমৃত স্বাদ।
বরগুনা জেলায় নারিকেল খুব ভালো জন্মায় , তার সাথে আছে খাল থেকে ধরা কুচো চিংড়ি । নারকেল বাটা ও কুচো চিংড়ি অথবা একটু বড় সাইজের চিংড়ি মাছ দিয়ে সব ধরনের মসলা দিয়ে রান্না করা হয় নারকেলের ঝোল। ঝোলের থিকনেস টা হয় অনেকটা পাতলা ডালের মতো । খেতে এতোটাই সুস্বাদু , একবার খেলে যে কারো মনে থাকবে আজীবন ।
বাংলাদেশের ঐতিহ্য মানেই এর বিশাল একটা অংশ জুড়ে থাকবে বাঙালির খাওয়া দাওয়া। হ্যাঁ, এটাই বাঙালির গৌরব , বাঙালির ঐতিহ্য। ভোজন রসিক বাঙালির পরিচয় অনেকটাই পাওয়া যায় তাদের খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে।