গাজীপুরের সনামধন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক।স্থানীয়ভাবে সাফারি পার্ক নামেই বহুল পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিপুল সমাহারে ভরপুর এই সাফারি পার্কে এসে একদিনের জন্য নিজেকে ছেড়ে দিতে পারবেন প্রকৃতির কোলে।
সীমানার পরে সীমানা, যেন কোনো শেষ নেই এর।দেখতে দেখতে, ঘুরতে ঘুরতে দিন ফুরিয়ে যাবে কিন্তু দেখার আগ্রহ আর ফুরোবে না।যারা কৃতিমতা পছন্দ না করে বরং প্রকৃতিকেই একটু বেশি ভালোবাসে মূলত তাদের জন্যই এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক।
প্রাকৃতিক গাছপালা, ঝোপ জঙ্গল,বন্য প্রাণী,মিনি শিশুপার্ক, থ্রিডি গ্যালারি, মাছের জগৎ, বাসে করে জঙ্গলে স্বাধীনভাবে ঘুরতে থাকা বাঘ দেখা এই সব কিছুই আপনি উপভোগ করতে পারবেন সাফারি পার্কে এসে।সব মিলিয়ে খরচও কিন্তু নেহায়েতই কম তুলনামূলক।
কীভাবে আসবেন?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক গাজীপুরের বাঘের বাজারে অবস্থিত।ঢাকা থেকে আসতে চাইলে প্রথমে আপনাকে গাজীপুরের যে কোনো বাসে করে গাজীপুর চৌরাস্তা আসতে হবে।সেখান থেকে হাইওয়ে মিনি বাস অথবা ময়মনসিংহের বাসে উঠতে হবে।ঢাকা ময়মনসিংহ হাইওয়ের মধ্যেই বাঘের বাজার নামক স্টপেজে আপনাকে নামতে হবে।গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ভাঘের বাজার পর্যন্ত বাস ভাড়া ৪০/৫০ টাকা নিবে।
অথবা গুলিস্তান থেকে “প্রভাতি বনশ্রী ” নামক গাড়ি আছে, যা কিনা গুলিস্তান টু মাওনা(গাজীপুরের শেষ প্রান্ত)পর্যন্ত আসে।এই বাসে করে ডিরেক্ট আসতে পারেন।উভয় ক্ষেত্রেই বাস কন্ডাক্টর কে বললেই হবে আপনি বাঘের বাজার নামবেন।
বাঘের বাজার স্টপেজে নামলেই দেখতে পাবেন অনেক অটো সাফারি পার্ক বলে ডাকছে।যে কোনো অটোতে উঠলেই ওরা পার্কের গেইটে নামিয়ে দিবে।অটো ভাড়া মাথাপিছু ২০৳ নিবে।
আরেকটা কথা মাথায় রাখাটা অত্যন্ত জরুরি, বাঘের বাজারে দুই স্টপেজ আগেই হোতাপারা নামক স্থানে “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক” নামে বিশাল এক সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন,এই স্টপেজে ভুল করে নামবেন না।হ্যাঁ, এ পথ দিয়েও সাফারি পার্কে যাওয়া যাবে কিন্তু অনেকটা রাস্তা ঘুরে যেতে হয়।আর ভাড়াও তুলনামূলক বেশি পড়ে।তাই বাঘের বাজার স্টপেজ হয়ে যাওয়াই ভালো।
আর কেউ পার্সোনাল গাড়ি নিয়ে গেলেও যেতে পারেন।পার্কের সামনে সুবিশাল জায়গা আছে পার্কিং করার জন্য।
বাজেট/খরচাদি
আমার মতে অন্যান্য পার্কের থেকে বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব সাফারি পার্কে ঘুরতে আসলে খরচ একটু কমই হয়।এই পার্কের এন্ট্রি ফি মাত্র ৫০ থেকে ৮০ টাকা।সময় ভেদে এবং দর্শনার্থীদের চাপ অনুযায়ী এটা কখনও বাড়তে বা কমতে পারে।
আরেকটি ভালো দিক হলো মাঝে মাঝে জাতীয় দিবসগুলোতে এই পার্ক কতৃপক্ষ এন্ট্রি ফি ফ্রী করে দেন।ভিতরে আছে চিড়িয়াখানার মতো নানা ধরনের জীবজন্তু, পাখি। এসব কিন্তু আপনি মাত্র ৫০৳ এন্ট্রি ফি দিয়েই দেখতে পারবেন।সেজন্য আলাদা কোনো চার্জ দিতে হবে না।
জঙ্গলে ঘুরতে থাকা মুক্ত বাঘ দেখতে চাইলে সেখানকার বাসের টিকেট কাটতে হবে। এটার মূল্য ১০০ থেকে ১৫০ এর মধ্যে । আছে ছোটদের জন্য শিশু পার্ক ও রাইড।শিশু পার্কে ঢুকতে হলে আলাদা চার্জ প্রদান করতে হবে।কিন্তু ৫০৳ এন্ট্রি ফি দিয়েই যে কতো কিছু দেখতে পারবেন তার কোনো শেষ নেই।
সারাদিন ঘুরলেও সীমানা শেষ হবে না,আর দেখাও শেষ হবে না।
পার্কের ভেতরে আছে মনোরম পরিবেশে খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্ট। আর এই রেস্টুরেন্টের বিশেষ আকর্ষণ হলো এখানে খাবার খেতে খেতে রেস্টুরেন্টে বসে জঙ্গলে ঘুরতে থাকা বাঘ দেখা যায়। কিন্তু অতিরিক্ত খরচ এড়াতে চাইলে বাহির থেকে খাবার কিনে নিয়ে ঢুকতে পারেন অথবা বাসা থেকে খাবার তৈরি করে নিয়ে আসতে পারেন।সাথে খাবার পানি নিতেও ভুলবেন না কিন্তু।
কী কী দেখতে পাবেন?
প্রথমতই আপনি হারিয়ে যাবেন প্রকৃতির এক মায়ার জোয়ারে।প্রকৃতির মাঝে পার্ক নামে এ যেন আরেক চিরিয়াখানা।রাস্তার প্রতিটি মোড়ে মোড়েই এক একটি বিশাল আকৃতির খাঁচা। কোনোটার ভেতর উটপাখি,কেনোটার ভেতর অজগর একটি জীবন্ত খরগোসকে পাকড়াও করে খাচ্ছে । আছে চিত্রা হরিণ, কুমির,বানর,ঘোড়া,বুনো মুরগি সহ অসংখ্য পশুপাখির এক বিচিত্র জগৎ।
সাফারি পার্কের এক বিশেষ আকর্ষণ হলো ঝুলন্ত ব্রিজ। এই ব্রিজের নিচে কোনো সাপোর্ট নেই,দুই দিকে দুটো টানা দড়ির মাধ্যমেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এই ব্রিজটি।নির্দিষ্ট পরিমান মানুষের থেকে বেশি মানুষ ওঠা নিষেধ এই ব্রিজে।এখানে দাড়িয়ে ছবি তুললে খুবই অসাধারণ ছবি হয়।
আর এ পর্যন্ত যে সব বিষয়গুলোর কথা বলা হলো এগুলোর দেখতে এক্সট্রা কোনো চার্জ দিতে হবে না বা টিকেট কাটতে হবে না।
আর একটা আকর্ষণ হলো বাসে করে বাঘ দেখা।একটা নির্দিষ্ট এরিয়ায় বাঘকে উন্মুক্ত করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।নিজেট কেটে বাসে উঠলে সেই বাস নিয়ে যাবে আপনাকে বাঘের এলাকায়। বাঘ এসে আপনার বাসের জানালা খামচাবে,ভেঙে ফেলতে চাইবে। সে এক গা শিহরিত অভিজ্ঞতা । বাঘকে খুব কাছ থেকে দেখা যায় এভাবে।
আছে থ্রিডি গ্যালারি। এখানে আপনি একটা চশমা চোখে দিয়ে বসবেন যার মাধ্যমে আপনাকে ভূত বা অশরীরী কিছু দেখাবে আর আপনার আশেপাশে বাবল ছড়িয়ে দেয়া হবে।এগুলোর স্পর্শে,ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে আর চোখের চশমায় সব মিলিয়ে আপনার মনে হবে আপনি সেই ভূতের রাজ্যে অবস্থান করছেন। খুবই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা । যদিও আমার মতো দূর্বল হার্টের মানুষের এই থ্রিডি গ্যালারিতে না ঢোকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আছে মাছের রাজ্য। সুন্দর পুল তৈরি করে তার উপরে তৈরি করা হয়েছে কাঠের ব্রিজ। নিতে স্বচ্ছ পানিতে আছে রং বেরঙের দেশি বিদেশি মাছ।নিজ হাতে খাবার ছাড়লে সব মাছ আপনার সামনে এসে জড়ো হবে।সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
আর শিশু পার্কে নানা ধনরের রাইড তো রয়েছেই।ছবি তোলার জন্য পাবেন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার, যারা আপনার পছন্দের যায়গায় মনের মতো ছবি তুলে দিবে।
সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ একটি দিন আপনারা উপভোগ করতে পারবেন এই “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে।
সাফারি পার্কে আমার অভিজ্ঞতা
আমাদের বিয়ের কিছুদিন পরেই ছিল স্বাধীনতা দিবস। কেউ একজন বললো আজকে সাফারি পার্কের এন্ট্রি ফি ফ্রী। ভাবলাম এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?তো যেই ভাবা সেই কাজ।রওনা হলাম সাফারি পার্কের উদ্দেশ্যে।গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে বাসে বাঘের বাজার আর সেখান থেকে ডিরেক্ট পার্কের গেটে।
গেটের সামনেই তো দেখি আরেক পার্ক।বিশাল এড়িয়া নিয়ে শুধু ঘাস বিছানো খোলা মাঠ,মাঠের মাঝখানে বট গাছ।একপাশে নানা রকমের দোকান, একদম মনে হচ্ছিল মেলা বসেছে।
এবার আসি আসল কথায়, গিয়ে শুনলাম ফ্রী এন্ট্রির সুযোগ দুপুরের আগে ছিল।যেহেতু আমরা ২ টার পরে গিয়েছি তাই ফ্রী খাওয়া আর হলো না।
৫০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম।এতো বড় এরিয়া, এক বেলায় কখনও ঘুরে দেখে শেষ করা সম্ভব না।যতোটুকু পেরেছি ঘুরে দেখে এসেছিলাম।তাই সবাই খুব সকাল সকালই চলে যাবেন, নয়তো আমার মতো পস্তাতে হবে।
থ্রডি গ্যালারিতে গিয়ে তো ভয়ে আমি আধমরা অবস্থা, তার উপরে আবার বাঘের এরিয়ার টিকেট কাটাও শেষ। আমার তো মনে হলো এই বুঝি জানালা ভেঙে বাস খেয়ে ফেললো আমাদের। কি এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। বলে প্রকাশ করা সম্ভব না।
ঝুলন্ত ব্রিজ আর মাছের জগৎ দেখে আমার সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নেমে এলো।সবকিছু না দেখতে পারার অতৃপ্তি নিয়ে বেরিয়ে আসতে হলো আমাদের । বাইরে এসে ফুচকা খেলাম সবাই। আমার জীবনে খাওয়া ফুচকার মধ্যে সবথেকে বেস্ট ফুচকা ছিল এটা। সব মিলিয়ে খারাপ ছিল না দিনটা।