বগুড়া জেলার জনপ্রিয় খাবার তালিকা ও পরিচিতি

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ভরপুর বগুড়া জেলা। এই জেলা বাংলা অঞ্চলের খুবই প্রাচীন একটি জনপদ । কালের বিবর্তনে এই জেলায় আনাগোনা হয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর। তারই ধারাবাহিকতায় একানকার খাদ্য সংস্কৃতিতে এসেছে নানা বৈচিত্র্য। বগুড়া জেলার বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার বাংলাদেশ সহ বিদেশেও খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বগুড়ার দইয়ের কথা শোনেনি এমন কাউকে হয়তো খুজেই পাওয়া যাবে না।এই জেলার এমনই বেশ কিছু জনপ্রিয় খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে আজকের এই লেখাটি। চলুন জেনে নেয়া যাক বগুড়ার বিখ্যাত খাবারগুলো সম্পর্কে।

১. বগুড়ার দই

বগুড়া জেলার ব্রান্ড পণ্য ‘বগুড়ার দই’। সব থেকে ভালো দই এর কথা চিন্তা করলেই প্রথমে মাথায় আসে বগুড়ার দই এর কথা। যুগ যুগ ধরে এই বিখ্যাত দই ভোজন রসিক বাঙালির খাদ্য তালিকায় পছন্দের শীর্ষে রয়েছে।
কম বেশি সব জেলাতেই উৎকৃষ্ট মানের দই পাওয়া যায়,কিন্তু নিজস্ব গুন ও স্বাদের কারনে ‘বগুড়ার দই’ নিজের অবস্থান রাখতে পেরেছে সবার শীর্ষে।
বগুড়ার দই এর ইতিহাস আড়াইশ বছরের পুরোনো । সর্ব প্রথম বগুড়া জেলার শেরপুরে আড়াইশ বছর আগে টক দৈ তৈরির প্রচলন শুরু হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে চিনি দেয়া মিষ্টি দই তৈরি করা শুরু হয়। আড়াইশ বছর আগে থেকেই এই জেলায় দই তৈরি শুরু হলেও এর স্বর্নযুগ শুরু স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছু আগ থেকে ।
ঐতিহ্যবাহী এই দই এখনও পর্যন্ত নিজের সুনাম ধরে রাখতে পেরেছে বিশেষ স্বাদ ও গুনের কারনে। এখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশের মাটিতেও পৌছে যাচ্ছে বিখ্যাত ‘বগুড়ার দই’ এর স্বাদ।

২. চালের কটকটি

বগুড়া জেলার জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান মহাস্থানগড়। এই মহাস্থানগড়ের একটি জনপ্রিয় খাবার ‘চালের কটকটি’। চালের কটকটি তৈরির মূল উপকরণ সুগন্ধি চালের আটা বলেইনএর নামকরণ করা হয়েছে চালের কটকটি। সুস্বাদু ও ব্যতিক্রম স্বাদের চালের কটকটি শুধু বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়েই পাওয়া যায়।
মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে ১০০ টিরও বেশি অস্থায়ী কটকটির দোকান স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ৫ শতাধিকেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।
মহাস্থানগড়ের বিখ্যাত এই কটকটির মূল্য ১২০ থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

চালের কটকটি তৈরির জন্য সুগন্ধি চাল ভিজিয়ে রাখা হয় কয়েক ঘন্টার জন্য। ভেজা চালের পানি ঝরিয়ে মেশিনে চাল গুড়ো করা হয়। সেই চালের গুড়োর সাথে তেল মিশিয়ে ডো তৈরি করে ছোট ছোট আকৃতিতে কাটা হয়। সেই টুকরো গুলো তেল, ডালডা বা ঘি এ ভেজে ৫ মিনিটের মতো গুড়ের শিরায় দিয়ে নেড়েচেড়ে ঠান্ডা করলেই হয়ে যায় সুস্বাদু চালের কটকটি।
মহাস্থানগড় গেলে ঐতিহ্যবাহী দারুন স্বাদের কটকটির স্বাদ না নিয়ে আসলে পুরো ভ্রমনটাই বৃথা।

৩. স্পঞ্জ মিষ্টি

মিষ্টি আর বগুড়া শব্দ দুটি যেন একে অপরের সমার্থক । এই জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন আইটেম গুলো পুরো বাংলাদেশে অনন্য । সেরকমই একটি ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় মিষ্টি হলো স্পঞ্জ মিষ্টি। একদমই নরম, তুলতুলে ও স্পঞ্জ এর মতো রসে ফুলে টইটুম্বুর বলেই এর নামকরণ হয়েছে স্পঞ্জ মিষ্টি ।
স্পঞ্জ মিষ্টি মূলত এক ধরনের রসগোল্লা । তবে এর স্বাদ কিছুটা অন্য এলাকার রসগোল্লার থেকে ব্যতিক্রম । ছানার তৈরি এই স্পঞ্জ মিষ্টি পছন্দ করে না এমন লোক হয়তো খুজে পাওয়া মুশকিল। বগুড়ায় গেলে সবারই একবার স্পঞ্জ মিষ্টি ট্রাই করে আসা উচিত।

৪. আলু ঘাটি

বগুড়া জেলার সাধারণ মানুষের খুবই ট্রাডিশনাল একটি খাবার আলু ঘাটি। বাড়িতে কোনো সবজি নেই তো কি হয়েছে, শুধু আলু দিয়ে রান্না করা বিশেষ এই পদ দিয়েই খেতে পারবেন ২/৩ প্লেট ভাত অনায়াসে।
ছোট থেকে বড় এই অঞ্চলের সবারই কম বেশি আলু ঘাটি খুব পছন্দের একটি খাবার।
আলু ঘাটি রান্নার প্রধান উপকরণ আলু।সাথে থাকে মাছ বা মাংস, পেয়াজ, রসুন সহ সব ধরনের মসলা । আলু সিদ্ধ করে ভর্তার মতো চটকে পানির সাথে গুলে রাখা হয় একটি পাত্রে।অন্যদিকে মাছ ভেজে উঠিয়ে সেই তেলে সব মসলা দিয়ে কষিয়ে আলু ও ভাজা মাছ বা মাংস দিয়ে ঘেটেঘুটে রান্না করা হয় আলু ঘাটি।
যেমন সুগন্ধ তেমনই সুস্বাদু খেতে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী রান্না ‘আলু ঘাটি বা আলুর ঘাটি’।

৫. হাতে ভাজা লাচ্ছা সেমাই

বগুড়া জেলার ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার হাতে ভাজা লাচ্ছা সেমাই। প্রতিবছর হাতে ভাজা লাচ্ছা সেমাই ছাড়া যেন ঈদ পরিপূর্ণ হয়ইননা। বগুড়া বাসীর ঈদের মিষ্টান্ন আইটেম এর মধ্যে সর্বপ্রথম তালিকায় থাকে এই ঐতিহ্যবাহী লাচ্ছা সেমাই।
শুধু বগুড়াতেই সীমাবদ্ধ নেই,এই জেলায় উৎপাদিত সেমাই এখন পুরো বাংলাদেশে বাজারজাত তো হচ্ছেই তার পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
বর্তমানে বগুড়া জেলায় দুই শতাধিক ছোট-বড় লাচ্ছা সেমাই তৈরির কারখানা রয়েছে। ময়দাকে বিশেষ কৌশলে হাতের সাহায্যে ডালডার মিশ্রনে ডো তৈরি করে ভাজা হয় তেল,ঘি ও ডালডা দিয়ে। বগুড়া জেলায় হাতে ভাজা লাচ্ছা সেমাই এর ঐতিহ্য শত বছরের পুরোনো ।

৬. পুরপুরি

বগুড়ার স্থানীয় লোকজনের কাছে খুবই প্রিয় একটি খাবার পুরপুরি। পুরপুরি মূলত ছোট মাছের চচ্চরি। মাছের সাথে কেউ ব্যবহার করে নানা ধরনের শাক কেউবা বিভিন্ন ধরনের সবজি। তবে লোকাল ভাবে পুরপুরি রান্নার মূল উপকরণ আলু। ছোট মাছ, আলু, পেয়াজ, কাঁচামরিচ, তেল, হলুদ গুড়ো একসাথে মেখে কড়াইয়ে দিয়ে হালকা পানি দিয়ে ঢেকে রান্না করা হয় এই তরকারি। কড়াইয়ের পানি শুকিয়ে তেল উপড়ে উঠে একদম ভাজা ভাজা করে নামিয়ে পরিবেশন করা হয়। একদম পোড়া পোড়া করে ভাজা হয় বলেই এর নাম পুরপুরি । একদম অথেনটিক স্বাদের পুরপুরি রান্না দিয়ে যে কেউ অনায়াসে তৃপ্তি সহকারে পেট পুরে ভাত খেতে পারবে। গরম ভাতের সাথে সাধারনত পুরপুরি খাওয়া হয়।

৭. আলুর বাটাম

বগুরা জেলার রন্ধনশালায় আছে আলুর বেশ কয়েক ধরনের রেসিপি। এর মধ্যে আলুর বাটাম একটু বেশিটি স্পেশাল। খুবই সাধারণ উপকরণের অসাধারণ এই রান্না ছোট বড় সবারই খুব বেশি পছন্দের।
আলু চাক চাক করে কেটে বিভিন্ন মসলা মেখে অল্প তেল দিয়ে রান্না করা হয় আলুর বাটাম। একদম ভাজা ভাজা করে রান্না করা এই আলুর বাটাম গরম ভাত, রুটি, পরোটা, লুচি দিয়ে খেতে খুবই সুস্বাদু। একদমই কম তেলে, সাধারণ কিছু উপকরণ দিয়ে তৈরি আলুর বাটাম বগুড়া জেলার ঐতিহ্যবাহী খাদ্য তালিকায় বিশেষ ভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

৮. আলুর ডাল

আলু দিয়ে আরও একটি স্পেশাল খাবার আলুর ডাল। নাম আলুর ডাল হলেও এই রান্নায় কোনো ধরনের ডাল ব্যবহার করা হয় না। পুরো রান্নাটি হয় মসুর ডাল দিয়ে পাতলা ডাল রান্না করার মতো করে , কিন্তু রান্নার উপকরণ আলু। আলু, পানি, হলুদ ও লবন বেশ কিছু সময় ধরে জ্বাল করে আলু সিদ্ধ হয়ে গেলে তা ঘুটে আলু ভেঙে একদম পানির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়। তারপর সেই আলু মিশ্রিত পানি তেল, পেয়াজ,রসুন দিয়ে ফোড়ন দিয়ে খাওয়া হয় আলুর ডাল। সাথে যদি দেয়া হয় দু একটা টমোটো কাটা তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

৯. লাল মরিচ

বগুড়া জেলার লাল মরিচের খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ ছেড়ে বিদেশেও।প্রতি বছর কয়েক মেট্রিক টন লাল মরিচ উৎপাদিত হয় এই জেলায়। বগুড়া জেলার বিখ্যাত খাদ্য উপাদানের মধ্যে তাই লাল মরিচ উল্লেখযোগ্য। অনুকূল পরিবেশ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হওয়ায় এই জেলায় মরিচের ফলন ভালো হয়। বগুড়া জেলার মরিচের বিশেষত্ব হলো এর রং ও ঝালের মাত্রা। একদম টকটকে লাল রঙ কিন্তু ঝাল হয় মধ্যম ধাচের ফলে তরকারির স্বাদ হয় একদমই অনন্য। স্থানীয় ভাষায় এই অঞ্চলের মানুষ লাল মরিচকে ‘পত্ত্যে’ বলে।

বগুড়া জেলার আরও কিছু ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় খাবার হলো:

১. ক্ষির
২. আঠা আলু
৩. শিক কাবাব
৪. মুরগি ও গরুর চাপ
৫. মাগুর পোলাও
৬. মাছ মিষ্টি (ইত্যাদি)

Scroll to Top