ফেনি জেলার দর্শনীয় স্থান – ফেনি ভ্রমন গাইড

বাংলাদেশের ৬৪ তম জেলা ফেনী যা কিনা আগে নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।ভৌগলিক অবস্থানের কারনে ফেনী জেলা বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন সমৃদ্ধ পর্যটন এলাকার উত্তরাধিকারী হয়েছে।এছাড়াও এই জেলায় সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নির্মাণ করা হয়েছে জনপ্রিয় বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র। আজকে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো ফেনি জেলার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র সম্পর্কে।

১. শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা

ফেনি জেলার খুবই জনপ্রিয় একটি রিসোর্ট শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট। রিসোর্টটির মেইন থিম হলো বাঁশ।পুরো রিসোর্টের দেয়াল, ছোট ছোট ঘর, বেঞ্চ, আসবাবপত্র সবকিছুই বাঁশের তৈরি।মনোরম নিরিবিলি পরিবেশে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার জন্য অথবা দলবল নিয়ে পিকনিকে যাওয়ার জন্য বাঁশের কেল্লা রিসোর্টটি একদমই উপযুক্ত একটি স্পট।রিসোর্টে আছে সুবিশাল একটি লেক ও লেকের বুকে ভেসে বেড়ানোর জন্য ছোট বৈঠা চালিত নৌকা।

ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার চম্পকনগর গ্রামে শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা রিসোর্টটি অবস্থিত।

রিসোর্টের প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ২০ টাকা।
ফেনী জেলা সদর থেকে প্রথমে ছাগলনাইয়া হয়ে সরাসরি পৌছুতে পারবেন বিখ্যাত এই বাঁশের কেল্লা রিসোর্টে।

২. বিজয় সিংহ দিঘি

ফেনি জেলার ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন গুলোর মধ্যে বিজয় সিংহ দিঘি সবথেকে বেশি উল্লেখযোগ্য। ফেনি সার্কিট হাউজের সামনে অবস্থিত সুবিশাল এই দিঘির পাড়ে প্রতিদিন বিকেলে মানুষের উৎসব লেগে যায়।জলজ বাতাস,পানির কলকল শব্দ, চারদিকে গাছগাছালির ছায়া সাথে লোকজনের রমরমা পরিবেশ সব মিলিয়ে অসাধারণ এক চিত্র।

ফেনি জিরো পয়েন্ট থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ফেনি সার্কিট হাউজের সামনে বিখ্যাত এই দিঘিটি অবস্থিত।
ফেনি জিরো পয়েন্ট থেকে বা রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিএনজি নিয়ে সরাসরি চলে যাওয়া যাবে বিজয় সিংহ দিঘির সামনে।

৩. চাঁদগাজী ভূঁইয়া মসজিদ

ফেনির সবথেকে পুরোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন চাঁদগাজী ভূঁইয়া মসজিদ।পুরোনো স্থাপত্য শৈলির জলজ্যান্ত নিদর্শন এই বিখ্যাত মসজিদটি।মসজিদের ভেতরে ও বাইরের দেয়ালে আছে অসংখ্য কারুকার্য খচিত টেরাকোটা। মসজিদের সুউচ্চ তিনটি মিনারের গায়ে ফুল, লতাপাতায় নকশা করা।মসজিদের সামনে শ্বেতপাথরের নামফলকে লেখা “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ” ও কালিমায় তাইয়্যেবা।ছন্দে ছন্দে লেখা আছে স্থাপনার সময় ও স্থপতির নাম।প্রতিবছর ঈদে এই মসজিদে অনেক বড় ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়।

১৬৩৫-১৭০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে (হিজরি ১১১২) চাঁদগাজী ভূঁইয়া নামক এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন।২৮ শতক জমির ওপর মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।হাজার বছরের সাক্ষী ঐতিহাসিক এই মসজিদটি দেখতে অসংখ্য দর্শনার্থী প্রতিনিয়ত হাজির হয় এখানে।

ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার
মহামায়া ইউনিয়নের মাটিয়াগোদা গ্রামের ভূঁইয়া বাড়িতে “চাঁদগাজী ভূঁইয়া জামে মসজিদ ” অবস্থিত”

৪. শর্শাদী শাহী মসজিদ

ফেনী জেলায় মোঘল শাসন আমলের ইসলামি স্থাপত্য শৈলির একমাত্র নিদর্শন হিসেবে বিদ্যমান আছে “শর্শাদী শাহী মসজিদ” এই মসজিদটি প্রায় ৪৫০ বছরের পুরোনো। চুন,সুরকি ও ইট দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল যার দেয়ালের পুরুত্ব ৫ ফুট।বর্তমান সময়ে এত পুরু দেয়ালের নির্মাণ শৈলির কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।দেয়ালে আছে নানা কারুকার্য খচিত নকশা।সবমিলিয়ে অসাধারণ একটি চিত্র।

বর্তমানে এই মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জাদুঘরের অধীনে পরিচালিত পুরাকীর্তি সংরক্ষিত এলাকা।
ফেনি জেলার ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি শর্শাদী ইউনিয়নে অবস্থিত।স্থানীয় লোকজন সহ বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ প্রাচীন নিদর্শন সমৃদ্ধ এই মসজিদটি ভ্রমন করতে আসেন প্রতিনিয়ত।

৫. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ

শর্শাদী মসজিদের মতোই ফেনী জেলার আরেকটি প্রাচীন পুরাকীর্তি নিদর্শন সমৃদ্ধ মসজিদ “মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ”
এই মসজিদটিও মোঘল আমলের স্মৃতি বহন করে আসছে।মোহাম্মদ আলী চৌধুরী নামে একজন মোঘল নায়েবের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই মসজিদটি। 
মসজিদের গায়ে ফলকের লেখনীর মাধ্যমে বোঝা গিয়েছে এই মসজিদটির নির্মাণ কাল ১৬৯০ সাল থেকে ১৬৯১ সালের মধ্যে। তবে এর বেশি কোনো তথ্য উদ্ধার করা যায়নি
তিনটি গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের দেয়ালে করা হয়েছে নানা ধরনের মনোরম কারুকার্য। সামনেই আছে সুন্দর একটি রাস্তা।বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে “মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ” মসজিদটি।
এই মসজিদটিও ফেনী জেলার শর্শাদী ইউনিয়নে অবস্থিত।

৬. প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি

ভোগোলিক অবস্থানের কারনে ঐতিহাসিক নিদর্শনে ঠাশা বাংলাদেশর ঐতিহ্যবাহী ফেনি জেলা।এই প্রাচীন সম্পদশালী জেলার আরও একটি ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি হলো “প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি”। স্থানীয়দের কাছে এটি প্রতাপপুর বড় বাড়ি বা রাজবাড়ী নামে পরিচিত।এই বাড়িটির সবথেকে বড় আকর্ষন হলো এর বিশালতা।১৩ একর জমির ওপরে নির্মাণ করা হয়েছিল এই বাড়িটি যেখানে ১০ টি সুবিশাল ভবন ও ১৩ টি পুকুর রয়েছে।তার মধ্যে ৫ টি পুকুরই সুন্দর ঘাট বাধানো।
জানা গেছে যে আসেপাশের সব জমিদারের মধ্যে এই বাড়ির কর্ণধার ছিলেন সবথেকে বেশি প্রভাবশালী, যার ছাপ পড়ে আছে তার নিজ বাড়িতেই।এই বাড়িটির মালিকানা এখনও বহন করে আসছে জমিদারের বংশধরেরা। তাই বাড়িটি সরকারি মালিকানাধীন হতে পারেনি, ফলে এই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ কাজও হচ্ছে না।

ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার প্রতাপুরে অবস্থিত এই প্রাচীন ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি অবস্থিত।

৭. মুহুরী প্রজেক্ট

মুহুরী প্রজেক্ট বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প।মুহুরী প্রকল্পের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ফেনী নদী যা সরাসরি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। বিশাল জলরাশির উৎস হওয়ার প্রচুর পরিমাণে মাছ উৎপাদিত হয় এখানে।বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মাছ সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবেও এই প্রকল্পটি খ্যাত।জলরাশির এতো বিশালতার কারনে এখানে গড়ে উঠেছে বেশ জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
সারাদেশের অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায় ফেনী মুহুরী প্রজেক্টের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

ফেনী সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সোনাগাজী উপজেলায় বিখ্যাত মুহুরী প্রজেক্ট অবস্থিত।মুহুরী প্রজেক্ট যেতে চাইলে প্রথমে ফেনি সদর থেকে বাস যোগে সোনাগাজী পৌছুতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি ভাড়া করে সরাসরি মুহুরী প্রজেক্টে পৌছুতে পারবেন।

৮. সেনেরখিল জমিদার বাড়ি

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাক্ষী বহনকারী ঐতিহাসিক স্থাপত্যশৈলি সেনেরখিল জমিদার বাড়ি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে এই বাড়িটি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত হলেও বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল পাঁচশ শতাব্দী আগে। পুরোনো স্থাপত্য শৈলিতে নির্মিত বলে সবারই নজর কাড়ে বিখ্যাত এই জমিদার বাড়িটি।
এই বাড়িটি ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামে অবস্থিত।

৯. কৈয়ারা দিঘী

ইতিহাসখ্যাত মুসলিম বীর শমসের গাজী এলাকার জনগনের পানি সরবরাহের সুবিধার্থে খনন করেছিলেন বিশাল এক দিঘি যার নাম কৈয়ারা দিঘী।ভাটির বাঘ নামে খ্যাত এই বীর তার মায়ের নামে দিঘী টির নামকরণ করেন। তার মা কৈয়ারা বিবি বীরমাতা হিসেবে খ্যাত ছিলেন শুধুমাত্র ছেলের প্রতাপ ও শক্তির কারনে।
ইতিহাসখ্যাত এই দিঘিটি বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে।ফেনী জেলার সবথেকে বড় এই দিঘীটির চারপাশে অসংখ্য গাছপালায় ঘেরা সুন্দর মনোরম পরিবেশ যে কোনো প্রকৃতি প্রেমীর মন কাড়বেই। দিঘির বিশাল জলরাশিতে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ানোর জন্য আছে সুব্যবস্থা।
কৈয়ারা দিঘী ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলায় অবস্থিত। ফেনী জেলা সদর থেকে বাসে করে ছাগলনাইয়া আসতে হবে প্রথমে।ছাগলনাইয়া থেকে সিএনজি ভাড়া করে সরাসরি চলে আসতে পারবেন ঐতিহাসিক নিদর্শন কৈয়ারা দিঘীর কাছে।

অসংখ্য প্রাচীন নিদর্শনে ভরা ফেনী জেলার প্রতিটি অঞ্চল।ফেনী জেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলোর যাথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা করলে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকার পরিনত হবে ফেনী জেলা।পর্যটন এলাকার মর্যাদা পাওয়ার জন্য সবধরনের বৈশিষ্ট্য এই জেলায় বিদ্যমান।

Scroll to Top