ফুল ভালোবাসে না এমন লোক হয়তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শখের বসে বাড়ির আঙিনায় দু চারটে ফুলের গাছ লাগালে সেই গাছে ফুল ফুটলেই আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। কিংবা বাজারে ফুলের দোকান গুলোর সামনে দাঁড়ালে তো আর সেখান থেকে নড়তেই ইচ্ছে করে না। তাহলে একবার ভাবুন তো যদি এমন হয়, আপনার সামনে মাইলের পর মাইল- গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে শুধু ফুলের সমারোহে ছেয়ে আছে।
এমন একটা পরিবেশে সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারাটা কতোটা সৌভাগ্য। হ্যাঁ, আপনি চাইলেই হারিয়ে যেতে পারবেন রঙ বেরঙের সুগন্ধি ফুলের অজানা এক রাজ্যে। সেজন্য চলে যেতে হবে আপনাকে যশোরের গদখালীতে।
গদখালী বাজার থেকে শুরু করে এর আশেপাশের অনেক গ্রামে চাষাবাদের একমাত্র ফসল ফুল। জমিতে ধান, পাঠ, ডাল যেমন মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে চাষ হয়, ঠিক তেমনিভাবে গদখালীতে ফুলের চাষ হয়। এজন্য গদখালীকে বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী বলে অভিহিত করা হয়।
ফুলের রাজধানীর অবস্থান
বাংলাদেশের সবথেকে বড় ফুলের উৎপাদন কেন্দ্র যশোর জেলার গদখালী ইউনিয়নে অবস্থিত। যশোর জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে গদখালী বাজার যা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ফুলের হাট হিসেবে পরিচিত।
শুধু বাজারই কিন্তু ফুলের রাজধানীর প্রধান আকর্ষণ নয়, যশোর জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ঝিকরগাছা ও শর্শা থানার ৯০ টি গ্রামে ফুলের চাষ হয় যা বাংলাদেশের মোট ফুলের চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগের জোগান দেয়। চার হাজার বিঘা জমিতে চাষকৃত একমাত্র ফসল বাহারি রঙের ও বৈচিত্র্যময় জাতের লক্ষ লক্ষ ফুল।
যশোর ফুল বাগান ভ্রমনের উপযুক্ত সময়
গদখালী ও তার আশেপাশের গ্রাম গুলোতে সারা বছরই কোনো না কোনো ফুলের চাষ হয়। তবে ভরা ফুলের মৌসুম হিসেবে শীতকালকেই সবথেকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। এই ঋতুতে প্রকৃতি তার কোল উজাড় করে ফুটিয়ে তোলে মিষ্টি সুগন্ধে ভরপুর অসংখ্য দেশী বিদেশী জাতের ফুল।
সেই সাথে শর্ষে ফুলের ক্ষেতও তখন হলুদের সমারোহে ভরে ওঠে। তাই ফুলের রাজধানী ঘুরতে যাওয়ার একদম উপযুক্ত সময় হিসেবে শীতকালই প্রাধান্য পায়। আর গদখালী ফুলের হাটের রমরমা পরিবেশ দেখতে চাইলে আপনাকে রবিবার বা বৃহস্পতিবার এই দুই দিনের মধ্যে যে কোনো একদিন যেতে হবে। কেননা সপ্তাহে এই দুই দিন গদখালীতে ফুলের হাট বসে ও অসংখ্য ক্রেতা, বিক্রেতা ও পর্যটকদের সমাগম ঘটে।

ফুলের রাজধানীর মূল আকর্ষণ সমূহ
যশোরের গদখালীর ফুল বাগানের মূল আকর্ষণই হলো হরেক রকমের ফুলে আচ্ছাদিত ক্ষেত আর গদখালীতে বসা ফুলের হাট। হাটের দিনে গদখালী বাজারে চাষীরা গরুর গাড়ি বোঝাই করে বিভিন্ন জাতের ফুল নিয়ে হাজির হয়। চাষী আর পাইকারের ব্যবসায়ীক আলাপে পুরো হাট মুখরিত থাকে।
গরুর গাড়ি বোঝাই করা ফুলের সৌন্দর্যে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। চারদিক থেকে শুধু ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে ভেসে আসবে। দেশী ফুলের মধ্যে দেখতে পাবেন গেলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, জিপসি ইত্যাদি। দেশী ফুলের পাশাপাশি নানা জাতের বিদেশী ফুলও নিয়ে আাসা হয় গরুর গাড়ি বোঝাই করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : জারবেরা, রথস্টিক, ক্যালোন্ডোলা, লিলিয়াম, গ্লাডিউলাস, রডস্টিক ইত্যাদি।
হাটের রমরমা পরিবেশে ঘোরাঘুরি শেষ করে চলে যেতে পারেন ঝিকরগাছা ও শর্শা থানার গ্রামগুলির ভেতরে। পুরো পথটাই যেন এক স্বপ্নের ভূবন। রাস্তার দুই ধারে শুধু ফুলের চাদোয়া বিছিয়ে আছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, সাদা ইত্যাদি রঙের ছড়াছড়ি।
ফুলের রাজ্যের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারবেন। যতদুর চোখ যায় শুধু ফুলের ক্ষেত আর আশেপাশে ছোটখাটো কৃষকের ঘরবাড়ি। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন যে কতোটা মধুমাখা তা এই গ্রামগুলির ভেতর থেকে হাটতে হাটতেই অনুভব করতে পারবেন।
ফুলের রাজধানী গদখালী যাওয়ার উপায়
খুলনা বিভাগের যশোর জেলার গদখালী ইউনিয়নে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ফুলের হাট অবস্থিত হওয়ায় এখানে যেতে চাইলে সর্বপ্রথম যশোর জেলা শহরে পৌছুতে হবে। ঢাকা থেকে সড়ক, রেল কিংবা আকাশপথে যশোর যেতে পারবেন।
সড়কপথে যশোর
ঢাকা থেকে সড়কপথে যশোর যেতে চাইলে কল্যাণপুর, গাবতলি বা কলাবাগান বাস স্ট্যান্ড থেকে যশোর গামী বাসে উঠতে হবে। ঢাকা টু যশোর রুটে সোহাগ, হানিফ, এসপি গোল্ডেন লাইন, দেশ ট্রাভেলস, এ কে ট্রাভেলস, গ্রীণলাইন পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, ঈগল পরিবহন সহ বিভিন্ন বাস সার্ভিস চালু আছে।
বাসের শ্রেনি ও সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী নন এসি সার্ভিস এর ভাড়া ৪৮০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা হতে পারে এবং এসি সার্ভিস এর ভাড়া ৭৫০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
রেলপথে যশোর
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে নিয়মিত সুন্দরবন এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস ও বেনাপোল এক্সপ্রেস এই তিনটি ট্রেন ঢাকা ও যশোর রুটে চলাচল করে। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন- সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং বেনাপোল এক্সপেস এর সাপ্তাহিক বন্ধ বুধবার আর চিত্রা এক্সপ্রেস এর সোমবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। ট্রেনের ক্লাস ভেদে টিকেট মূল্য ৪৫৫ টাকা থেকে শুরু করে ১৬৫০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আকাশপথে যশোর
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ডাকা টু যশোর রুটে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং নভোএয়ারের নিয়মিত ফ্লাইট রয়েছে। সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী জনপ্রতি বিমান ভাড়া ৩০০০ টাকা থেকে শুরু করে ৮০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
যশোর থেকে গদখালী
যশোর বাস স্যান্ড বা জেলা শহরের অন্যান্য যে কোনো জায়গা থেকে রিকশা নিয়ে প্রথমে চলে যেতে হবে যশোর লোকাল বাস স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে গদখালী যাওয়ার লোকাল বাস পাবেন।অথবা সিএনজি রিজার্ভ করেও যেতে পারবেন। বাসে চেপে গদখালী পৌছে ফুলের হাট পরিদর্শন করে চলে যেতে পারেন গ্রামের দিকে।
গদখালী থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ভ্যান পাবেন। ১ ঘন্টার জন্য ভ্যান ভাড়া ১০০ থেকে ২০০ টাকার মতো নিতে পারে। খোলা ভ্যানে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এক দারুণ অভিজ্ঞতা। তাও যদি হয় ফুলের রাজ্যের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া দারুণ রাস্তা তাহলে তো বেশ জমে যায়।
থাকার ব্যবস্থা :
গদখালী থেকে ঘোরাফেরা শেষ করে চলে আসতে হবে যশোর জেলা শহরে। এখান থেকে চাইলে ঐ দিনই ফিরে যেতে পারবেন। তবে যশোরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে চাইলে আরেকটা দিন কাটিয়ে দেয়াই যেতে পারে। যশোর জেলা শহরে থাকার জন্য সাধারণ থেকে শুরু করে বেশ আধুনিক মানের হোটেল পাবেন।
যশোরের ভালো মানের হোটেল গুলোর মধ্যে হোটেল সিটি প্লাজা, জবির ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, হোটেল শামস ইন্টারন্যাশনাল, হেটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া যশোর জেলা শহরে বেশ কয়েকটি সরকারি রেস্ট হাউজ আছে।
ঝিকরগাছায় রাত কাটাতে চাইলে সেখানে জেলা পরিষদের দুইটি ডাক বাংলোর যে কোনো একটিতে থাকতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে।
খাওয়ার ব্যবস্থা
যশোরে বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল ও রেস্তোরাঁ রয়েছে। এখানে দেশী খাবার থেকে শুরু করে চাইনিজ, থাই সহ বিভিন্ন ধরনের খাবার পাবেন। এছাড়া নাশতা ও হালকা খাবারের জন্য পাবেন অসংখ্য ছোট স্টল, স্ট্রিট ফুড, হোটেল ও ক্যান্টিন।
যশোরের কিছু উল্লেখযোগ্য খাবার আছে যা একবার হলেও টেস্ট করে আাসা উচিত। যেমন-
- ১) চুক নগরের বিখ্যাত চুই ঝাল
- ২) খাম্বার মোড়ের জনি কাবাব
- ৩) জামতলার মিষ্টি
- ৪) ভিজা পিঠা
- ৫) খেজুর গুড়ের প্যারা সন্দেশ
- ৬) ধর্ম তলার মালাই চা (ইত্যাদি)
গ্রাম, হাট-ঘাট, ক্ষেত-খামার, নদী-নালায় পরিবেষ্টিত বাংলার রূপ মাধুর্যে মুগ্ধ হবে না এমন কাউকে খুজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু গদখালী হাট ও গ্রামের সৌন্দর্য যেন একটু বেশিই সুন্দর। ফুলের দেশ ফলের দেশ বাংলাদেশ – এই কথাটির প্রমাণ মিলবে ফুলের রাজধানী গদখালীতে আসলে।