ইউরোপ মহাদেশের মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি সুপরিচিত রাষ্ট্র পোল্যান্ড। সরকারি ভাবে দেশটির নাম পোল্যান্ড প্রজাতন্ত্র। পোল্যান্ডের বাসিন্দারা নিজেদেরকে পোল বা পোলিশ হিসেবে পরিচয় দেয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে দেশটি বেশ সমৃদ্ধশীল। পোল্যান্ড এর রাজধানীর নাম ওয়ার্শ।
দেশটির মোট আয়তন ৩,১২,৬৭৯ বর্গ কিলোমিটার বা ১,২০,৭২৬ বর্গ মাইল। আয়তনের দিক থেকে পোল্যান্ড বিশ্বের ৭০তম বৃহত্তম দেশ। পোল্যান্ডের ২০১৪ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী দেশটির মোট জনসংখ্যা ৩৮,৪৮৩,৯৫৭। জনসংখ্যার দিক থেকে দেশটি বিশ্বের ৩৪ তম বৃহত্তম দেশ।
পোল্যান্ডে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার সিংহ ভাগই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। পাশাপাশি কিছু সংখ্যক জনসংখ্যার মাঝে অন্যান্য ধর্ম প্রচলিত আছে। দেশটির সরকার স্বীকৃত ভাষার নাম পোলীশ ভাষা এবং শতকরা ৯৮ ভাগ লোকই এই ভাষায় কথা বলে।
পোল্যান্ড এর ইতিহাস
দ্বিতীয় পোলিশ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৮ সালে এবং এটি ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিদ্যমান ছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাধ্যতামূলক আঞ্চলিক সামঞ্জস্যের কারনে পোল্যান্ডের ভৌগলিক কেন্দ্রটি মূল ভূখন্ড থেকে পশ্চিম দিকে সরে যায় এবং পোলিশ ভূখন্ড তাদের বহু জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে হারিয়ে ফেলে এবং নতুন জাতিগোষ্ঠীর সাথে তাদের মেলবন্ধন তৈরি হয়।
১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে পোলিশ সংস্কার আন্দোলন সলিডারিটি দেশটিকে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র থেকে সংসদীয় গনতন্ত্রের রাষ্ট্রে পরিনত করতে গুরুত্ব দেয়া শুরু করে। এরই ফলস্বরূপ ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক পোলিশ রাষ্ট্র তথা তৃতীয় পোলিশ প্রজাতন্ত্র।
EU রেকর্ড অনুযায়ী ২০১৯ সালের হিসেবে- পোলিশ অর্থনীতি গত ২৮ বছর ধরে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে পোল্যান্ডের জিডিপি সাত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশটির প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলোর মধ্যে আছে আসবাবপত্র, খাবার, মোটর বোট, প্লেন, শক্ত কাঠের পণ্য, নৈমিত্তিক পোশাক, জুতা, প্রসাধনী সামগ্রী ইত্যাদি। রপ্তানি এবং আমদানি উভয় ক্ষেত্রেই পোল্যান্ড বিশ্বের শীর্ষ ২০ টি দেশের তালিকার মধ্যে রয়েছে।
পোল্যান্ড এর মুদ্রার নাম
পোল্যান্ড এর মুদ্রার নাম পোল্যান্ড জলোটি। পোল্যান্ড এর এক জলোটি বাংলাদেশী টাকায় কনভার্ট করলে এর মান হয় সাধারণত ২৫ টাকা, তবে এর মান প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে।
পোল্যান্ড এর ভিসা
বাংলাদেশ থেকে পোল্যান্ড ভিসা পাওয়ার জন্য স্টুডেন্ট ভিসা, বিজনেস ভিসা, ট্যুরিস্ট ভিসা এবং কাজের ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। Schengen অন্তর্ভুক্ত ২৭টি দেশের মধ্যে একটি হলো পোল্যান্ড। তাই Schengen ভিসার মাধ্যমে পোল্যান্ড যেতে পারবেন।
বাংলাদেশে কোনো পোল্যান্ড এম্বাসী নেই তবে বাংলাদেশে সুইডেন এম্বাসী থেকে পোল্যান্ড যাওয়ার জন্য শর্ট টার্ম ভিসার আবেদন করা যাবে। যেমন: বিজনেস ভিসা, ট্যুরিস্ট ভিসা।
অপরদিকে, দীর্ঘমেয়াদী পোল্যান্ড ভিসা যেমন: ওয়ার্ক পারমিট ভিসা অথবা স্টুডেন্ট ভিসার জন্য ভারতের নয়া দিল্লিতে অবস্থিত পোল্যান্ড এম্বাসী থেকে আবেদন করতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে পোলান্ড যেতে আনুমানিক চার লক্ষ টাকা খরচ লাগতে পারে। স্টুডেন্ট ভিসায় আনুমানিক খরচ ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।
তাছাড়া ভ্রমণ ভিসায় এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা খরচ হতে পারে। এটা মোটামুটি আনুমানিক হিসাব, তবে কাজের উদ্যেশ্য, থাকার মেয়াদ, সুযোগ সুবিধা, স্কলারশিপ এর উপর ভিত্তি করে খরচ কম বেশি হতে পারে।
পোল্যান্ডে জব ফ্যাসিলিটি এবং বেতন
পোল্যান্ডে বহু সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগ করে তাদের শ্রমশক্তির ঘাটতি পূরণ করছে। নির্মাণ শ্রমিক, ওয়েল্ডার, মেকানিক্স, ইলেকট্রিশিয়ান, ট্রাক চালক সহ বিভিন্ন পদে কাজের জন্য পোল্যান্ডে পাড়ি জামাতে পারেন। ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী পোল্যান্ডে ট্রাক চালক, নার্স, মিডওয়াইফ, মনোবিজ্ঞানী, সাইকোথেরাপিস্ট পদের জন্য সবথেকে বেশি অভিবাসীর চাহিদা রয়েছে।
২০২৩ সালে পোল্যান্ডে কর্মরত অভিবাসীদের গড় বেতন ৭১২৪ পোল্যান্ড জলোটি যা প্রায় ১৭২৯ আমেরিকান ডলারের সমতুল্য। বিভিন্ন কাজের উপর ভিত্তি করে এবং শ্রমিকের দক্ষতা বিবেচনা করে মাসিক আয় নির্ধারন করা হয়। পোল্যান্ডের মাসিক বেতন সাধারনত ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার আশেপাশেই থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ সুবিধা
অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর থেকে পোল্যান্ডে পড়াশোনার খরচ তুলনামূলক অনেক কম তাই বিদেশী শিক্ষার্থীদের এই দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের আগ্রহ বেশি। তাছাড়া পড়াশোনা শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতে শিক্ষার্থীর কাজের সুযোগ হয়ে যায়। উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এখানে সরকারি ও বেসরকারি বেশ কিছু ভকেশনাল ইনস্টিটিউট রয়েছে। বর্তমানে পোল্যান্ডে নার্সিং প্রোগ্রাম খুবই চাহিদাসম্পন্ন। বিদেশি শিক্ষার্থীদের নার্সিংয়ে গ্রাজুয়েশন করার জন্য পোল্যান্ড সরকার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে এবং পড়াশোনার শেষে চাকরির ব্যবস্থা করে থাকে। বর্তমানে পোল্যান্ডে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।
পোল্যান্ড এর দর্শনীয় স্থানের তালিকা

ইতিহাস ও স্থাপত্য প্রেমীদের জন্য পোল্যান্ড একটি উপযুক্ত দর্শনীয় দেশ। ১৪ টি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সহ বিভিন্ন শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক আকর্ষণের এক চমৎকার কেন্দ্রস্থল এই দেশটি। পোল্যান্ড এর জনপ্রিয় কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে তুলে ধরা হলো
১. উইলিক্সকা লবণের খনি
১৩ তম শতাব্দীতে রমরমা পরিবেশে চলমান উইলিক্সকা লবণের খনিটি ১৯৯৬ সালে এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং তখন থেকে এটি একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। এখানকার সকল যাবতীয় সব কিছুই লবন খোদাই করে তৈরি করা।
পর্যটন কেন্দ্রটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইট: https://www.wieliczka-saltmine.com/
২. ওয়ারশ ওল্ড মার্কেট প্লেস
শহরের প্রাচীন নিদর্শন গুলোর মধ্যে অন্যতম ওয়ারশ ওল্ড মার্কেট প্লেস। এখানে আছে প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর বিভিন্ন ভবন, জাদুঘর, পুরাকীর্তি সহ বিভিন্ন ক্যাফে এবং রেস্তোরা। মার্কেট চত্বরে আছে বিভিন্ন শিল্প বিক্রেতার দৃষ্টি নন্দিত স্টল।
৩. মালবোর্ক দুর্গ
১৩ শতকে নির্মিত মালবোর্ক দুর্গটি মূলত টিউটনিক নাইটদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাদুঘরের অভ্যন্তরে দেখার মতো আছে ছয় মিটার চওড়া ফায়ারপ্লেস সহ একটি মধ্যযুগীয় রান্নাঘর, একটি বর্ম এবং অস্ত্রের সংগ্রহশালা এবং একটি টাওয়ারের চূড়ায় অবস্থিত নাইটদের ব্যক্তিগত টয়লেট।
মালবোর্ক দুর্গের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট: http://www.zamek.malbork.pl/en
৪. ল্যাজিয়েঙ্কি পার্ক
পোল্যান্ড এর বৃহত্তম শহুরে পার্ক গুলোর মধ্যে অন্যতম ল্যাজিয়েঙ্কি পার্ক যা ৭৬ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ১৭ শতকে একজন সম্ভ্রান্ত লোকের জন্য একটি স্নান পার্ক হিসেবে পার্কটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পার্কের মধ্যে একটি জাদুঘর আছে।
৫. শিন্ডলারের কারখানা
শিন্ডলারের কারখানা হলো অস্কার শিন্ডলারের এনামেল এবং মেটাল ফ্যাক্টরি যা কিনা ১৯৯৪ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গের মুভি দ্বারা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিল্ডিংয়ের মূল অংশটিকে সমসাময়িক শিল্পের জাদুঘর হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছে। এছাড়াও আছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন ভবন এবং শিন্ডলারের কারখানার অফিস ঘর সহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
৬. ক্রুকড ফরেস্ট
ক্রুকড ফরেস্ট মূলত এর ব্যতিক্রমী পাইন গাছের জন্য বিখ্যাত। এই বনের প্রতিটি পাইন গাছ পুরোপুরি ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে বেকে উপরের দিকে উঠে গেছে, যা সবারই নজর কাড়বে৷ মজার বিষয় হলো সবগুলি গাছই উত্তর দিকে বাঁকানো। পাইন গাছগুলো মূলত ১৯৩০ এর দশকে এখানে রোপণ করা হয়েছিল তবে গাছের এই বাঁকানো বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে ১০ বছর সময় লেগেছিল। পুরো বনটিই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং ঠান্ডা পরিবেশ বিদ্যমান। একটি শান্ত ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ছুটি কাটাতে চাইলে ক্রুকড ফরেস্ট থেকে ঘুরে আসা যেতেই পারে।
৭. ওয়ারশ রাইজিং মিউজিয়াম
১৯৪৪ সালের ওয়ারশ বিদ্রোহের স্মৃতি ও ইতিহাসকে তুলে ধরতে ওয়ারশ রাইজিং মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। মিউজিয়ামের ভেতরে উপভোগ করার জন্য আছে শিল্পকর্ম এবং ইন্টারেক্টিভ ডিসপ্লের মাধ্যমে জীবন্ত অনেক কক্ষ যা যুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন ঘটনার বাস্তব প্রামাণ্য চিত্রকে তুলে ধরে। আরও আছে একটি প্রিন্ট শপ যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের পোস্টার দেখতে পাবেন।
ওয়ারশ রাইজিং মিউজিয়াম এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট : https://www.1944.pl/en/
৮. ওয়াওয়েল রয়্যাল ক্যাসেল
পোল্যান্ডে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট স্থান হিসাবে ঘোষণা করা প্রথম স্থানগুলির মধ্যে একটি হলো ওয়াওয়েল রয়্যাল ক্যাসেল। রাজা সিগিসমন্ড আই দ্য ওল্ড ১৬ শতকে এই দুর্গে বসবাস করতেন। তিনি একজন রুচিশীল মানুষ ছিলেন, দুর্গের আনাচে কানাচে ভালোভাবে খেয়াল করলেই এটা বোঝা যায়। বর্তমানে দুর্গটি একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্থাপত্যকর্মের পাশাপাশি জাদুঘরে আছে অস্ত্র এবং বর্ম, চীনামাটির বাসন এবং সিরামিক, প্রচুর টেক্সটাইল এবং প্রিন্ট এবং বেশ কিছু পরিমাণের আসবাবপত্র। ওয়াওয়েল রয়্যাল ক্যাসেল এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট : https://wawel.krakow.pl/en
অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধশীল দেশ পোল্যান্ড যা শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি সহ যে কোনো কারিকুলামে নিজের অনবদ্য শক্তিকে বার বার তুলে ধরতে পেরেছে। নিজেদের উন্নয়নের পথ ধরে হেটে এসে এখন দেশটি সবদিক থেকে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পেরেছে।