নোয়াখালীর বিখ্যাত খাবার

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বদিকে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক জেলা নোয়াখালী। নোয়াখালী জেলা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে বেশ সমৃদ্ধ। নোয়াখালী জেলার সংস্কৃতির এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তাদের ব্যাতিক্রমী ভাষা ও খাদ্যাভ্যাস।

 অতিথি আপ্যায়নে নোয়াখালী জেলার বেশ সুনাম রয়েছে।এই জেলার মানুষ যেমন খেতে ভালোবাসে তেমনি খাওয়াতেও ভালোবাসে।তাদের রান্না বান্নায়ও আছে ব্যাতিক্রমি স্টাইল।নোয়াখালী জেলার জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী বেশিরভাগ খাবার এখন বাংলাদেশের সব জেলার মানুষের কাছেই বেশ জনপ্রিয়।চলুন জেনে নেয়া যাক নোয়াখালী জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলো সম্পর্কে এবং তাদের রন্ধনপ্রণালী সম্পর্কে।

১. মরিচ খোলা

নোয়াখালীর সবথেকে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো মরিচ খোলা।অতিথি আপ্যায়নে সব আইটেমের পাশাপাশি মরিচ খোলা থাকবেই।অথেনটিক ভাবে রান্না করতে পারলে শুধু মরিচ খোলা দিয়েই পেট পুরে খাওয়া যায় অনেক।মরিচ খোলা মূলত ছোট মাছ রান্নার বিশেষ এক পদ্ধতি।যে কোনো ছোট মাছ বা পাঁচমিশালী মাছ দিয়ে মরিচ খোলা রান্না করা হয়।

প্রস্তুত প্রনালী :

চোট মাছ ধুয়ে পুরোপুরি পানি ঝড়িয়ে নিন।একটি পাত্রে সেই মাছ,পেয়াজ কুচি,পেয়াজ বাটা,রসুন বাটা,মরিচ বাটা,কাঁচা মরিচ কুচি,হলুদ গুড়ো,স্বাদমতো লবন ও সরিষার তেল দিয়ে ভালোভাবে মেখে নিন।কচি কলাপাতা মাঝারি সাইজ করে কেটে তার ওপরে পাতলা করে মাখিয়ে রাখা মিশ্রণ দিয়ে ওপর থেকে আরেকটা কলাপাতা দিয়ে ঢেকে দিন।কলাপাতার সাইড গুলো সুতা অথবা টুথপিক দিয়ে আটকে নিয়ে তাওয়ার ওপরে ভেজে নিন।একপাশ ভাজা হয়ে গেলে একই পদ্ধতিতে অন্য পাশ ভেজে নিলেই হয়ে যাবে মজাদার মরিচ খোলা।

পরিবেশন:
কলাপাতা কেটে তার মধ্যে থেকে মাছ বের করে গরম গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয় মরিচ খোলা

২.খাইস্যা বা খাইস্যরা

সিমের বিচি দিয়ে তরকারি সব জেলায়ই কম বেশি খাওয়া হয়।নোয়াখালীতে সিমের বিচি ও চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করা তরকারিকে আঞ্চলিক ভাষায় খাইস্যরা বলে।সিজনে এই তরকারি নোয়াখালীর প্রতি ঘরেই কম বেশি রান্না করা হয়। নোয়াখালী জেলার খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার খাইস্যরা।

প্রস্তুত প্রনালী :

শিমের বিচি লবন পানিতে ভিজিয়ে খোসা ছাড়িয়ে হালকা সিদ্ধ করে নিন।একটি কড়াইয়ে তেল দিয়ে তারমধ্যে লবন হলুদ দিয়ে চিংড়ি মাছ ভেজে আলাদা করে তুলে রাখুন।সেই তেলে পেয়াজ,মরিচ,রসুন,হলুদ ও স্বাদমতো লবন দিয়ে ভালোভাবে কষিয়ে সিদ্ধ করে রাখা শিমের বিচি দিয়ে দিন।সামান্য পানি দিয়ে হালকা আঁচে রান্না করুন।পানি শুকিয়ে আসলে আগে থেকে ভেজে রাখা চিংড়ি মাছ ও ধনিয়া পাতা দিয়ে হালকা নেড়ে নামিয়ে ফেলুন

পরিবেশন:

খাইস্যরা সাধারণত ভাতের সাথে খাওয়া হয়। তবে রুটি বা পরোটা দিয়ে খেতেও অসাধারণ লাগে এই খাবারটি।

৩. খোলাজা পিঠা

বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা ” খোলাজা পিঠা”। নোয়াখালীতেই জন্ম এবং নোয়াখালী জেলা থেকেই এর পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বাংলাদেশে।এই খাবার নোয়াখালী জেলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।

প্রস্তুত প্রনালী :

চালের গুড়ো, লবন ও পরিমানমতো পানি দিয়ে পাতলা করে গুলিয়ে নিতে হবে।তার ভেতরে আগে থেকে ফেটিয়ে রাখা হাঁসের ডিম (না থাকলে মুরগির ডিম) দিয়ে হালকা ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। গোলা কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে রেস্টে রাখতে হবে।চুলায় মাটির খোলা দিয়ে ৫ মিনিট ধরে গরম করে তার মধ্যে বড় ডালের চামচের ১ চামচ গোলা দিয়ে খোলা ধরে চারপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাতলা করে দিতে হবে।এরপর ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে কিছুক্ষণ। ডাকনা উঠিয়ে যাদি দেখা যায় পিঠার চারপাশ খোলা থেকে উঠে এসেছে তাহলে পাতলা খুন্তি দিয়ে পিঠা উঠিয়ে ফেলতে হবে। এভাবে সবগুলো পিঠা ভেজে নিতে হবে।

পরিবেশন:
খোলাজা পিঠা সব ধরনের মাংসের সাথে খাওয়া হয়।তাছাড়া আলু ভাজি,বিভিন্ন প্রকার ভর্তা ও ঝোলাগুড় দিয়েও খাওয়ার প্রচলন আছে।

৪.সাইন্না পিঠা

পিঠাপুলির সমৃদ্ধ জেলা নোয়াখালী। এই জেলায় শীতের সময় তৈরি করা হয় হরেক রকম পিঠা।তেমনই শীতকালীন জনপ্রিয় এক পিঠা ” সাইন্না পিঠা”।বিভিন্ন জেলায় এই পিঠা ম্যারা পিঠা নামেও পরিচিত। শীতের সকালে সাধারণত নাশতা হিসেবে খাওয়া হয় গরম গরম সাইন্না পিঠা।

প্রস্তুত প্রনালী 

সাইন্না পিঠা মিষ্টি দিয়ে অথবা মিষ্টি ছাড়া দুই ভাবেই বানানো যায়।মিষ্টি সাইন্না পিঠা বানানোর জন্য হাড়িতে গুড়, পরিমান মতো লবন, পানি ও নারকেল দিয়ে জ্বাল করে তার মধ্যে চালের গুড়ো সিদ্ধ করে নিতে হবে। তারপর ছোট ছোট গোল গোল করে কিছুটা সরু ও গোলাকৃতির পিঠার শেইপ দিতে হবে।পিঠা গুলো ভাপে সিদ্ধ করে নিলেই হয়ে যাবে মজাদার সাইন্না পিঠা।
মিষ্টি ছাড়া করতে চাইলে শুধু গুড় টা বাদ দিলেই হয়ে যাবে।

পরিবেশন:
মিষ্টি সাইন্না পিঠা শীতের সকালে গরম গরম শুধুই খাওয়া হয়।নোনতা পিঠা ঝোলাগুড় দিয়ে খেতে বেশ মজার।

৫.লোনা শাক

লোনা শাক নোয়াখালী জেলার সাধারণ মানুষের খুবই প্রিয় একটি খাবার হাটে মাঠে ঘাটে সব জায়গাতেই কম বেশি জন্মায় এই শাক।এই শাকের আরও কয়েকটি নাম হলে : নোনা শাক,নুনিয়া শাক,নোনতা শাক,গীমা শাক,বেলে শাক ইত্যাদি। কোনো কোনো অঞ্চলে এই শাককে আগাছা ভেবে ফেলে দিলেও নোয়াখালীর মানুষ কিন্তু এই শাক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের রেসিপি তৈরি করে। ছোট ছোট পাতা ও নরম ডাল, কাচা পাতা মুখে দিলে নোনতা স্বাদযুক্ত এই বৈশিষ্ট্য গুলো দেখলেই চিনতে পারবেন লোনা শাক।

লোনা শাক যেভাবে খাওয়া হয়:
★ খাসির মাংস দিয়ে লোনা শাক
★ গরুর মাংস দিয়ে লোনা শাক
★ মুরগির মাংস দিয়ে লেনা শাক
★ আলু দিয়ে লোনা শাক ভাজি
★লোনা শাক ভর্তা ( ইত্যাদি )

৬. মহিষের দুধের দধি

নোয়াখালী জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন মহিষের দুধের দধি।সব এলাকায় এই দধি জনপ্রিয় হলেও অথেনটিক মহিষের দুধের দধি খেতে চাইলে আপনাকে আসতে হবে নোয়াখালী জেলায়।নোয়াখালী জেলার বেশ কিছু অঞ্চলে আছে অসংখ্য মহিষের বাথান যেখানে শত শত মহিষ পালন করা হয়।দধি তৈরির কারিগর আগে থেকেই টাকা এডভান্স করে রাখে দুধের জন্য, অনেকে আবার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও দুধ সংগ্রহ করে।কোনো ধরনের কেমিক্যাল বা বাড়তি কোনো উপকরণ ব্যবহার না করে একদম অথেনটিক ভাবে তৈরি করা হয় মহিষের দধি।মহিষের দুধ খুব ঘন হয় বলে এর উপরে বেশ পুরু একটা সর পড়ে যা খেতে অসাধারণ।

প্রস্তুত প্রনালী :
সরাসরি বাথান থেকে খাটি দুধ সংগ্রহ করে কোনো প্রকার পানি না মিশিয়ে ঢেলে দেয়া হয় মাটির হাড়িতে। হাড়িতে সেট করার মাত্র ৫ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে দই জমে যায়।

পরিবেশন:
মহিষের দই সাধারণত চিনি মিশিয়ে খাওয়া হয়।তাছাড়া ঝোলাগুড় অথবা শুধু চিনি মিশিয়ে খেতেও খারাপ লাগে না।

৭.হাঁসের মাংসের মালাইকারি

নোয়াখালীর স্থানীয়দের খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার হাঁসের মাংসের মালাইকারি।শীতের সময় বেশিরভাগ পরিবারেই কমবেশি হাঁসের মাংসের পাতুরি রান্না করা হয়।নোয়াখালী ছাড়া অন্যান্য জেলায়ও এই খাবারটি বেশ জনপ্রিয়।

প্রস্তুত প্রনালী :
হাঁসের মাংস চামড়া সহ কেটে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে হবে।তারপর দুধ ও হলুদ দিয়ে ১ ঘন্টা রেস্টে রাখতে হবে।কড়াইয়ে তেল ও ঘি গরম করে তার মধ্যে পেয়াজ ভেজে নিতে হবে লাল করে। তার ভেতরে আাদা বাটা,রসুন বাটা,বাদাম বাটা,টক দই,পেস্তাদানা বাটা,মরিচ,হলুদ ও স্বাদমতো লবন দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে। কষানো হয়ে গেলে মাংস দিয়ে আরও কিছুক্ষণ কষিয়ে নারকেল দুধ দিয়ে রান্না করে নিতে হবে।এই রান্নায় কোনো পানি ব্যবহার করা যাবে না।রান্না হয়ে এলে তার মধ্যে বেরেস্তা,গরম মসলার গুড়ো এবং আরও কিছুটা নারকেল দুধ দিয়ে নেড়ে নামিয়ে ফেলতে হবে।

পরিবেশন:
হাঁসের মাংসের মালাইকারি নোয়াখালীতে বিভিন্ন ধরনের পিঠার সাথে খাওয়া হয়।তাছাড়া রুটি, পরোটা,পোলাও,ভাতের সাথেও বেশ জমে যায় এই স্পেশাল খাবারটি।

নোয়াখালী জেলার আরও কিছু জনপ্রিয় খাবার হলো:
১. ষোল মাছের চচ্চড়ি
২. লতির পাতুড়ি
৩. নারকেল নাড়ু (ইত্যাদি)

Scroll to Top