ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলা। কিন্তু শুধু কি পানাম নগর আর গোয়ালদি মসজিদ দেখেতেই সবাই সোনারগাঁও পাড়ি জমায়? ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সোনারগাঁওয়ে। হ্যাঁ, বলছিলাম মায়াদ্বীপ এর কথা৷ অনেকের কাছে আবার এটা নুনেরটেক দ্বীপ নামেও বহুল পরিচিত।
শহরের যান্ত্রিকতাকে দূরে রেখে একটা পুরো বিকেল প্রকৃতির মাঝে কাটিয়ে দিতে চাইলে চলে যেতে পারেন মায়াদ্বীপে। নদীর জলরাশির কলধ্বনি আর গ্রামীণ পরিবেশে অনায়াসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারবেন ছোট্ট এই দ্বীপে। পরিবার পরিজন নিয়ে একটি ছোটখাটো বনভোজন করতে চাইলে মায়াদ্বীপে চলে যান।
তাছাড়া যে কোনো প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক বনভোজনের জন্য একটি শান্ত, নিরিবিলি ও আদর্শ পিকনিক স্পট হতে পারে এটি। ঢাকার খুব কাছাকাছি হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই কমবেশি পর্যটক এই দ্বীপে ঘুরতে আসে। সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসতে পারবেন তাই খরচ ও সময় দুটোই থাকবে সাধ্যের মধ্যে। চলুন মায়াদ্বীপ ভ্রমণের যাবতীয় তথ্য, যাওয়ার উপায় ও খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
মায়াদ্বীপ এর অবস্থান
মায়াদ্বীপ এর মায়ায় আটকে যেতে চাইলে আপনাকে চলে যেতে হবে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায়। সোনারগাঁও উপজেলার বারদী ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি ছোট্ট ত্রিভুজাকার দ্বীপের নাম হলো মায়াদ্বীপ। ঢাকা থেকে এই দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ৩৯.২ কিলোমিটার। বারদী ইউনিয়নের মূল ভূখন্ড থেকে দ্বীপটি ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্ব নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। মেঘনা নদীর বুকে আনুমানিক এক শতাধিক বছর আগে এই দ্বীপটি জোগে ওঠে।
মায়াদ্বীপ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
বর্ষা ঋতু বাদ দিয়ে বছরের যে কোনো সময়ে মায়াদ্বীপ ভ্রমণে যেতে পারবেন৷ কেননা বর্ষায় দ্বীপটি পানির নিচে ডুবে যায়। তবে বর্ষার শেষে আবার মাথাচাড়া দিয়ে বিষ্ময়কর সৌন্দর্য নিয়ে মেঘনার বুকে জেগে ওঠে এই দ্বীপটি। তাছাড়া বর্ষায় নদীর স্রোতও বেশ উত্তাল থাকে। তাই এ সময়ে নৌকায় করে ঘোরাফেরা বেশ বিপজ্জনক।
মায়াদ্বীপ এর আসল রূপ ও সৌন্দর্য ধরা দেয় মূলত শীতের সময়। এসময় চরের অধিকাংশ জায়গা পানির নিচ থেকে জেগে ওঠে। আর বালুচরের পুরোটা অংশ ছেয়ে যায় সবুজ ঘাসে। তাই ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হিসেবে শীত ঋতুকে বেছে নিতে পারেন। তবে নদীর তীরে কাশ ফুলের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে অবশ্যই শরতের সময় ঘুরতে যাওয়া উচিত।
মায়াদ্বীপ কেন যাবেন?
নদীমাতৃক বাংলাদেশের এক সাধারণ গ্রাম্য জীবনের মায়ায় ধরা দিতে চাইলে চলে যেতে হবে মায়াদ্বীপ। মায়া দ্বীপের বালুচরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে কোনো এক শান্ত সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে আছেন। যেখানে থাকবে না কোনো জনকোলাহল, গাড়ির হর্ণ, মেশিনের ঘটঘট শব্দ। শুধু একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে মন চাইবে খোলা প্রকৃতির দিকে।
নৌকা নিয়ে মেঘনার বুকে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে মায়াদ্বীপের পুরো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন৷ নদীর সুবিশাল ঢেউগুলো যখন ছোট নৌকাটিকে দোলাতে থাকবে তখন এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি হবে। আকাশে উড়ে যেতে দেখবেন গাঙচিল আর সাদা বকের সারি। জেলে নৌকায় পাল তুলে দিয়ে মাঝিরা গান ধরবে করুন সুরে। এ যেন এক স্বপ্নের ভূবন।
পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসলে মায়াদ্বীপের মাঝখানে সবুজ শীতল ঘাসের ওপর বসে আড্ডা জমবে বেশ। সমবয়সীরা মিলে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলার আয়োজন করতে পারবেন কিছু সময়ের জন্য। বালুচর ধরে নদীর তীরে সাতার কাঁটার সুযোগ তো একদমই হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
দ্বীপটা খুব বেশি বড় না হওয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যেতে পারবেন কুব কম সময়েই। এক পাশে ছোট ছোট কয়েকটি বাড়িঘর মিলে একটি গ্রাম আর অন্যপ্রান্তে খোলা চর। আর চারদিকে শুধু অথৈ পানির সমারোহ। মনে হবে আপনি অজানা কোনো এক সাগরের বুকে ভেসে চলেছেন
এতো সুন্দর স্নিগ্ধ পরিবেশে যে কোনো একটি ছুটির দিন কাটিয়ে আসতে কার না ইচ্ছে করে বলুন তো! তাই নদীর বুকে ভেসে ভেসে প্রাকৃতিক এক দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে চলে যান ঢাকার খুবই নিকটে অবস্থিত মায়াদ্বীপে।
মায়াদ্বীপ যাওয়ার উপায়
মায়াদ্বীপ যাওয়ার সবথেকে সহজ উপায় হলো ঢাকার গুলিস্তান থেকে যাত্রা শুরু করা। সেক্ষেত্রে আপনাকে ঢাকার যে কোন প্রান্ত থেকে প্রথমে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে চলে যেতে হবে৷ অধিকাংশ পথ পাড়ি দিতে হবে সড়কপথে তারপর নদীপথে কিছুটা পথ অতিক্রম করে চলে যেতে পারবেন মায়াদ্বীপ। এক্ষেত্রে আপনার বোঝার সুবিধার্থে পুরো যাত্রা পথটিকে দুটো আলাদা আলাদা অংশে বিভক্ত করা হলো।

গুলিস্তান থেকে বারদী বৈদ্যের বাজার
গুলিস্তান থেকে দশ মিনিট পর পরই মোগরাপাড়ার উদ্যেশ্যে বিভিন্ন বাস ছেড়ে যায়। এই রুটে চলাচলকারী বাসগুলো হলো: স্বদেশ পরিবহন, বোরাক পরিবহন, দোয়েল পরিবহন ও সোনারগাঁ পরিবহন। যে কোনো একটি বাসে চেপে প্রথমে চলে যাবেন মোগরাপাড়া। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা।
মোগরাপাড়া নেমে সেখান থেকে চলে যেতে হবে বারদী বৈদ্যের বাজার। বৈদ্যের বাজার যাওয়ার জন্য ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা পাবেন।লোকাল অটোতে যেতে চাইলে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১৫ টাকা। তাছাড়া অটো রিজার্ভ করেও যেতে পারেন। সংখ্যায় বেশি হলে রিজার্ভ করে যাওয়াই ভালো। এতে জনপ্রতি ভাড়া তুলনামূলক কম পড়বে।
বারদী বৈদ্যের বাজার থেকে মায়াদ্বীপ
বারদী বৈদ্যের বাজার পৌঁছে চলে যেতে হবে ট্রলার ঘাটের কাছে। তবে মায়াদ্বীপে সারাদিন থাকার পরিকল্পনা করে গেলে বৈদ্যের বাজার থেকে শুঁকনো খাবার ও পানি কিনে নিয়ে নৌকায় উঠতে হবে। এই বাজারে মুদি দোকান, খাওয়ার হোটেল সহ যাবতীয় সকল দোকান মোটামুটি ভাবে রয়েছে।
ট্রলার ঘাট গেলে অনেক নৌকার সারি দেখতে পাবেন৷ সেখানে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে নৌকার মাঝিরা আপনাকে ঘিরে ধরবে। এখানে আপনি ঘন্টার হিসেবে ভাড়ার চুক্তি করে নৌকা বা ট্রলার রিজার্ভ করতে পারবেন। প্রতি ঘন্টার জন্য ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। ভাড়া নির্ভর করে দলের লোকসংখ্যা ও নৌকার আকৃতির ওপরে। তবে আপনাকে এক্ষেত্রে দর কষাকষিতে এক্সপার্ট হতে হবে।
চাইলে সারাদিনের জন্যও নৌকা ভাড়া করতে পারেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় নিয়ে একটি নৌকা রিজার্ভ করলে ভাড়া পড়বে ১২০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে। নৌকা নিয়ে রওয়ানা করবেন মায়াদ্বীপের উদ্যেশ্যে। যাওয়ার পথে পুরো মেঘনা নদীর অসাধারণ সৌন্দর্য ধরা দেবে আপনার চোখে।
বৈদ্যের বাজার থেকে মায়াদ্বীপ যেতে সময় লাগবে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মতো। আবার ঐ ট্রলারে করেই চুক্তি মাফিক সময় অনুযায়ী আপনাকে ফিরে আসতে হবে। কেননা মায়াদ্বীপ থেকে ফেরত আসার জন্য আলাদা করে কোনো ট্রলার বা নৌকা পাবেন না।
দ্বীপের সুযোগ সুবিধা
মায়াদ্বীপ কোনো পরিকল্পিত পর্যটন এলাকা না হওয়ায় এখানে পর্যটকদের জন্য আলাদা কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। খাওয়া দাওয়া করার জন্য কোনো হোটেল বা দোকান পাবেন না এখানে। তাই প্রয়োজনীয় খাবার ও পানি নিজেদের সাথে করেই নিয়ে যেতে হবে।
তবে পিকনিক গ্রুপ হিসেবে গেলে মায়াদ্বীপ গিয়ে রান্না করে খেতে পারবেন৷ এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম ও রসদ নিজেদের সাথে করেই নিয়ে যেতে হবে। নদীর বুকে ছোট একটি দ্বীপে দলবল নিয়ে এমন বনভোজন করার মজাই আলাদা।
এখানে কোনো ধরনের পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। তাই মহিলাদের জন্য বিষয়টি মাথায় রেখে ভ্রমণ প্লান করা উচিত। একটু বড় আকৃতির ট্রলার গুলোতে টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে। প্রয়োজন মনে করলে এমন ট্টলার রিজার্ভ করে মায়াদ্বীপ আসতে পারেন।
মায়াদ্বীপে আলাদা ভাবে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। তাই এখানে গ্রুপ করে ট্যুরে যাওয়াই ভালো। আর চেষ্টা করবেন সন্ধ্যার আগেই বৈদ্যের বাজার ফিরে যাওয়ার।
আশাকরি মায়াদ্বীপ ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত সকল তথ্য ইতোমধ্যে পেয়ে গেছেন৷ প্রকৃতির কোলে নিজেকে সপে দিতে চাইলে ছুটির একটি দিন ব্যয় করে আসতে পারেন মায়ায় ঘেরা এই দ্বীপে।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ মায়াদ্বীপ Mayadip পেজ