বনলতা ও কাঁচাগোল্লার জন্য বিখ্যাত নাটোর জেলা রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ২০০ বছরের পুরোনো এই জেলায় কাঁচাগোল্লা ছাড়াও বিভিন্ন মিষ্টির উৎপত্তি হয়েছে। মিষ্টি ছাড়াও এই জেলার সাধারণ মানুষের হাতের স্পর্শে রান্না করা প্রতিটি খাবারই নাটোরের রন্ধন শৈলীকে বেশ সমৃদ্ধ করেছে। নাটোরের বিখ্যাত মিষ্টি ও আঞ্চলিক বেশ কিছু খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরার প্রয়াসে আজকের আয়োজন।
১. নাটোরের কাঁচাগোল্লা
কাঁচাগোল্লার নাম শুনলেই নাটোর জেলার নাম প্রথমে মনে পরে। কাঁচাগোল্লার উৎপত্তি নাটোর জেলায় হলেও বর্তমানে বেশ কিছু জেলায় এই মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি করা হয়।
কাঁচাগোল্লার উৎপত্তি নিয়ে আছে মজার এক কাহিনি।
নিতান্ত দায়ে পড়ে তৈরি করা হয়েছিল কাঁচাগোল্লা মিষ্টি। নাটোর শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল শহরের নামকরা মিষ্টির দোকান। তার দোকানে প্রতিদিন ১৫ জনেরও বেশি কর্মচারী কাজ করতেন। প্রতিদিন অনেক বেশি পরিমানে ছানার পানতোয়া, মিষ্টি, সন্দেশ তৈরি করা হতো তার দোকানে।
হঠাৎ একদিন ছানা জ্বাল করার পর দোকান মালিক জানতে পারলেন যে, একজন কর্মচারীও কাজে আসবেন না। মালিক পড়ে গেলেন মহা মুশকিলে। সেই ছানা চিনির সিরায় দিয়ে রেখে দিলেন। হঠাৎ চিনির সিরায় দেয়া ছানা মুখে দিয়ে দেখলেন খেতে দারুণ স্বাদ এবং অন্যান্য মিষ্টির থেকে একদমই অন্যরকম। বিক্রি শুরু করলেন নতুন নাম দিয়ে ‘কাঁচাগোল্লা’।
মূলত কাচা ছানা দিয়ে তৈরি করা হয় বলেই এই মিষ্টির নাম হয়েছে কাঁচাগোল্লা।
তারপর থেকে নিয়মিত অনেক ক্রেতা ভীড় করতে থাকে মধুসূদন এর মিষ্টির দোকানে। কাচা ছানার গন্ধ ও চিনির সিরার স্বাদ মিলিয়ে অসাধারণ এক খাবার হলো ‘কাঁচাগোল্লা’। ইতিহাসের পাতায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তির কাছে সুনাম কুড়িয়েছে নাটোরের কাঁচাগোল্লা।
২. অবাক সন্দেশ
সন্দেশ তো বেশ কয়েক রকমেরই আছে, কিন্তু আবাক সন্দেশ টা আবার কেমন?
শুধুমাত্র নাটোর ও এর পার্শ্ববর্তী কিছু জেলাতেই পাওয়া যায় এই সুস্বাদু সন্দেশ। দুধ, চিনি দিয়ে তৈরি করা এই সন্দেশ এর স্বাদ এতোটাই বেশি যে, সবারই মন কেড়ে নিতে সক্ষম।
সন্দেশের নাম অবাক হওয়ার পেছনের কারন নিয়ে আছে তর্ক বিতর্ক।
কেউ কেউ মনে করেন, অবাক সন্দেশ উদ্ভাবনকারীর নাম ছিল আবাক আর তার নামানুসারে সন্দেশের নাম হয়েছে অবাক সন্দেশ। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মজাদার এই সন্দেশের স্বাদ এতোটাই বেশি যে খাওয়ার সাথে সাথে অবাক না হয়ে উপায় নেই।ফলেই এই সন্দেশের নাম হয়েছে অবাক সন্দেশ।
দেখতে চারকোনা, কিছুটা রম্বসের আকৃতি। দুই পাশে ছাচে ফেলে ডিজাইন করা। অবাক সন্দেশের রং কিছুটা গাঢ় ঘিয়া। তৈরি হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত এখনও এর রং, আকৃতি বা স্বাদের কোনো তারতম্য হয়ই। নাটোর জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি গুলোর মধ্যে অবাক সন্দেশ খুবই জনপ্রিয়।
৩. কুশালি
নাটোরের আঞ্চলিক খাবারগুলোর মধ্যে সুস্বাদু এক পিঠা ‘কুশালি’। মূলত দুধ পুলি পিঠাকে নাটোর জেলার মানুষ কুশালি বলে থাকে। শীতের সময় নাটোরের ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় দারুণ মজাদার মুখে লেগে থাকার মতো কুশালি পিঠা।
চালের গুড়োকে রুটির আটার মতো কাই করে ছোট ছোট আকৃতিতে বেলে নেয়া হয়। ছোট ছোট রুটির মধ্যে নারকেল ও গুড় দিয়ে বানানো পুর ভরে চারপাশ ডিজাইন করে মুড়িয়ে দেয়া হয়। গুড় নারকেল এর পুরকে অঞ্চলভেদে খাজা বলা হয়। খাজা ভরা পিঠাকে জ্বাল দিয়ে ঘন করা দুধ ও গুড়ের সিরায় দিয়ে আরও একটু জ্বাল দিয়ে সিদ্ধ করে নিলেই হয়ে যায় মজাদার কুশালি। ছোট থেকে বৃদ্ধ সবারই খুব পছন্দের খাবার এই কুশালি।
৪. ভাত তেলানি
নাটোরের একদম সাধারণ জনজীবনের সাথে মিশে থাকা বিশেষ এক খাবার ভাত তেলানি। আগের দিনের বেঁচে যাওয়া ভাত ফেলে না দিয়ে রান্না করা হয় ভাত তেলানি। খেতেও হয় বেশ সুস্বাদু আবার অপচয়ও রোধ হয়।
সাধারণত সকাল বেলা যখন দেখা যায় হাড়িতে অনেক ভাত এখনও বেঁচে আছে তখন বাড়ির মহিলারা সেই ভাত ফেলে না দিয়ে রান্না করে ভাত তেলানি। একদম সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে তৈরি হয়ে যায় সকালের নাশতা।
কড়াইয়ে তেল, পেয়াজ কুচি ও কাঁচামরিচ কুচি দিয়ে ভেজে তার মধ্যে দিয়ে দেয়া হয় ভাত। ভাত হতে হবে শুকনো এবং তার মধ্যে আগে থেকেই মিশিয়ে রাখা হয় লবন, হলুদ গুড়ো ও মরিচ গুড়ো। বেশ কিছুক্ষণ তেল পেয়াজে ভাজলেই তৈরি হয়ে যায় মজাদার ভাত তেলানি।
যে কোনো ভর্তা, ভাজি বা তরকারির সাথে সকালের নাশতায় বেশ জমে যায় সুস্বাদু এই খাবারটি।
৫. কাঁকড় মুরগির তরকারি
কাঁচা ফুটি বা ফুইট-কে বলা হয় কাঁকড়। কাঁচা কাঁকড় পাকলে ফুটি হয় এবং এটাকে ফল হিসেবে খাওয়া হয়। আর কাঁচা অবস্থায় সবজি হিসেবে রান্না করা হয়। নাটোর জেলার মানুষের খুব প্রিয় খাবার কাঁকড় দিয়ে মুরগির মাংস রান্না। অবশ্য গরুর মাংস, মাছ বা নিরামিষ রান্নাও করা যায় কাঁকড় দিয়ে।
কাঁকড় কেটে বিচি ফেলে ছোট ছোট টুকরো করে রাখা হয়। সব ধরনের মসলা দিয়ে মাংস কষিয়ে তারমধ্যে কাঁকড় দিয়ে রান্না করা হয় তরকারি। একটু ঝোল ঝোল থাকতেই নামিয়ে পরিবেশন করা হয় গরম গরম ভাতের সাথে।
৬. কুমড়ো বড়ি
নাটোরের একদমই আঞ্চলিক একটি খাবার কুমড়ো বড়ি। শুধু নাটোরেই নয় বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলায় এই কুমড়ো বড়ি বেশ জনপ্রিয়। শুকনো কুমড়ো বড়ি দিয়ে রান্না করা হয় মজাদার মাছের তরকারি, ভর্তা বা কুমড়ো বড়ি ভাজা। এই খাবারটি নাটোর জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার।
কুমড়ো বড়ি তৈরি করা হয় চাল কুমড়ো ও মাসকলাই এর ডাল দিয়ে। পরিপক্ব চাল কুমড়ো বেটে বা গ্রেটার দিয়ে গ্রেট করে তার সাথে বাটা মাসকলাই এর ডাল বাটা মিশিয়ে ছোট ছোট বড়ি বানিয়ে শুকোতে দেয়া হয়। বড়ি বানানো হয় কুলার ওপরে, ফলে পেছন সাইডে সুন্দর দাগ পড়ে যা দেখতে বেশ ভালো লাগে। ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে সারাবছর খাওয়া হয় কুমড়ো বড়ি।
৭. রাঘব শাহী
নাটোরের জনপ্রিয় মিষ্টান্ন আইটেম রাঘব শাহী। নাটোর ছাড়াও অন্যান্য জেলায় এই মিষ্টি পাওয়া যায়। কিন্তু নাটোর জেলায় রাঘব শাহী মিষ্টির উদ্ভাবন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ফলে এই মিষ্টি নাটোরের রাঘব শাহী মিষ্টি হিসেবে পরিচিত।
রাঘব শাহী দুধের তৈরি সুস্বাদু এক মিষ্টি।রাঘব শাহী মিষ্টির মূল উপকরণ দুধ, চিনি, মাওয়া, ঘি আর কিসমিস। দুধ থেকে ছানা তৈরি করে নিয়ে কড়াইয়ে ঘি, মাওয়া আর ছানা জ্বাল করে শক্ত আঠালো কাই তৈরি করে নেয়া হয়।
হাতে ঘি মেখে সেই কাই নিয়ে তৈরি করা হয় মিষ্টি। ছাচে ফেলে ছানার ছোট ছোট ডো নিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনে ডেকোরেশন করা হয়। উপরে কিসমিস দিয়ে পরিবেশন করা হয় মজাদার রাঘব শাহী মিষ্টি। নাটোরের প্রায় সব মিষ্টির দোকানেই রাঘব মিষ্টি পাওয়া যায়। ৩০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা প্রতি কেজি দরে রাঘব শাহী মিষ্টি বিক্রি করা হয়।
৮. ধুমার তরকারি
নাটোর জেলার সাধারণ মানুষের অঞ্চলিক খাবার ধুমার তরকারি। ধুন্দল দিয়ে রান্না করা তরকারিকে মূলত ধুমার তরকারি বলা হয়। গাছ থেকে তাজা ধুন্দল ছিড়ে খোসা ছাড়িয়ে চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করা ধুমার তরকারি দিয়ে যে কেউ অনায়াসে পেট পুরে তৃপ্তি সহকারে ভাত খেতে পারবে।
ধুন্দল খোসা ছাড়িয়ে কেটে রেখে কড়াইয়ে সব মসলা ও চিংড়ি দিয়ে কষিয়ে তার মধ্যে ধুন্দল দিয়ে রান্না করলেই তৈরি হয়ে যাবে ধুমার তরকারি।
নাটোর জেলার আরও কিছু জনপ্রিয় খাবার হলো:
১. প্রাণহারা মিষ্টি
২. দাঁত ভাঙ্গা
৩. কচু শাক ও হাঁসের মাংসের ভর্তা
৪. বনলতা পান
৫. পাচুর হোটেলের লেটকা খিচুড়ি
৬. কাঁচা কলা দিয়ে শর্ষে ইলিশ (ইত্যাদি)