সৌদি আরবের মক্কা প্রদেশের একটি প্রসিদ্ধ শহর তায়েফ। এই শহরের আয়তন ৩২১ বর্গকিলোমিটার বা ১২৪ বর্গমাইল। জনসংখ্যার দিক থেকে শহরটি রাজ্যের ষষ্ঠতম জনবহুল শহর। তায়েফকে অনানুষ্ঠানিকভাবে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী বলা হয়। কেননা সৌদি আরবের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশেও পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে তুলনামূলক অনেক কম তাপমাত্রা থাকে৷ ফলে এখানে জন্মায় বিভিন্ন ধরনের শস্য ও প্রচুর পরিমানে গোলাপ।
আবহাওয়া বেশ নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে মক্কায় আগত বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে শহরটি বেশ জনপ্রিয়। এই শহরকে গোলাপের রাজধানীও ও বলা হয়। পাহাড়ের খাদে খাদে এবং উপত্যকায় প্রচুর পরিমানে গোলাপ ফোটে। তাছাড়া এই শহরে আছে সৌদি আরবের বেশ কিছু প্রাচীন নিদর্শন ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। পবিত্র মক্কা নগরী থেকে খুব সহজেই ক্যাবের মাধ্যমে তায়েফ শহরে আসা যায়।তায়েফের বেশ জনপ্রিয় কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে তুলে ধরা হলো।
১. তায়েফ’স রোজ ফিল্ড
তায়েফে প্রচুর পরিমানে গোলাপের উৎপাদন হয়।প্রায় ৯০০ চাষি প্রতিবছর ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি গোলাপ উৎপাদন করে। বিখ্যাত ৩০ পাপড়ির দামেস্ক গোলাপের মিষ্টি সুগন্ধে চারপাশ মুখরিত হয়ে থাকে। পাহাড়ের ঢালে ও উপত্যকায় গড়ে তোলা গোলাপ বাগান ছবি তোলার জন্য একদমই আদর্শ একটি জায়গা। এখানে দেখা যায় কয়েকশ জাতের বেশ কয়েকটি রাঙের সুগন্ধি ফুলের বাগান।
এই সব ফুল দিয়ে তৈরি করা হয় বিখ্যাত গোলাপের তেল বা আতর, গোলাপজল, রোজ স্যোপ সহ বিভিন্ন জিনিস। চাইলে গোলাপের এইসব পণ্য কিনে আনতে পারবেন। গোলাপ বাগানে যাওয়ার পারফেক্ট সময় ফেব্রুয়ারীর শেষের দিক থেকে মার্চের শুরুর দিকে। এসময় প্রতিটি বাগান চমৎকার ফুলের সমারোহে সতেজ হয়ে ওঠে।
২. আল হাদা পর্বত
গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে যেতে পারেন সৌদি আরবের তায়েফ শহরে অবস্থিত আল হাদা পর্বতে। পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যোদয় দেখে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে, আরও দেখা যায় পেছনে সারিবদ্ধ অন্যান্য পর্বতমালা। একটি লম্বা রাস্তা উঠে গেছে সেজা পাহাড়ের চূড়ার দিকে। এই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সৌভাগ্য কেউই হাতছাড়া করতে চায়না। কাছেই আছে একটি ওয়াটার পার্ক। আল হাদা পর্বতে ভ্রমনের জন্য ক্যাবল কার ভাড়া নিতে পারেন বা উট কাফেলার সাথে ভ্রমণ করতে পারবেন।

৩. আল শাফা পর্বত
তায়েফের সবথেকে উঁচু এবং আকর্ষণীয় পর্বত হলো আল শাফা পর্বত। এই পর্বত টি তায়েফ শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। পবিত্র মক্কা নগরী থেকে সরাসরি গাড়ি ভাড়া করে আল শাফা পর্বতে পৌঁছানো যায়। পর্বতের একদম চূড়া পর্যন্ত পাকা রাস্তা আছে বিধায় গাড়ি নিয়েই ট্রেকিং করা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় আছে চমৎকার একটি রিসোর্ট।
শহরটির সবথেকে উঁচু পর্বতের চূড়ায় উঠে রিসোর্ট ভ্রমনের অভিজ্ঞতা কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর হবে। তাছাড়া এখানে বারবিকিউ করারও সুব্যবস্থা আছে। পরিবার পরিজন নিয়ে মক্কায় হজ্জ করতে গেলে সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন তায়েফের আল শাফা পর্বতে। পর্বতের চূড়ায় রাত্রিযাপনের জন্য পাওয়া যাবে আবাসিক হোটেল বা কটেজ।
৪. আল-ওয়াহবা ক্রেটার
তায়েফ শহর থেকে আনুমানিক ২৫০ কিলোমিটার দূরে আল-ওয়াহবা ক্রেটার অবস্থিত। এটি মূলত একটি আগ্নেয়গিরির গর্ত। এই এলাকাটতে অনেকগুলো ছোট বড় আগ্নেয়গিরির গর্ত থাকলেও গভীরতা ও ব্যাসের দিক থেকে এটিই সবথেকে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গর্তটির গভীরতা ২৫০ মিটার এবং ব্যাস ২ কিলোমিটার।
গর্তের নীচে সাদা সোডিয়াম ফসফেট স্ফটিকের আবরণ রয়েছে যা এর সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িতে তোলে। এই সুবিশাল আগ্নেয়গিরির গর্তটি দেখার জন্য প্রতিনিয়ত স্থানীয় লোকজন থেকে শুরু করে বিদেশি পর্যটকেরা দলে দলে এসে ভীড় করে। এর নৈসর্গিক সৌন্দর্য যে কাউকেই মুগ্ধ করতে সক্ষম। মক্কা শহর থেকে নিজস্ব গাড়ি অথবা ক্যাব ভাড়া করে সহজেই আল-ওয়াহবা ক্রেটারে যাওয়া যায়।
৫. সাইসাদ ন্যাশনাল পার্ক
তায়েফ শহর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাইসাদ ন্যাশনাল পার্ক বিনোদনের একটি চমৎকার জায়গা। বিশেষ করো বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার মতো বেশ কিছু রাইড ও প্রোগ্রাম রয়েছে। এছাড়া পার্কটির ডেকোরেশন ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের কারনে সবারই ভ্রমনের সময়টুকু বেশ ভালো কাটবে। হজ্জের শুরুতে বা শেষে তায়েফ শহর ভ্রমণ করতে আসলে হাজীগন পরিবারের সবাইকে নিয়ে সাইসাদ ন্যাশনাল পার্ক থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
তায়েফ শহরে অবস্থানকালে বিকেলে ঘোরাঘুরি করার জন্য আদর্শ জায়গা হতে পারে এটি। পার্কটি তায়েফ বিমানবন্দর এলাকায় পড়েছে এবং মূল সড়কের সাথেই এর অবস্থান। তাই যাতায়াতেও কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় না।
৬. আল ফয়সালিয়া গার্ডেন
তায়েফ শহরে অবস্থানকালীন বিকেলের হালকা ঘোরাঘুরির জন্য আল ফয়সালিয়া গার্ডেন আদর্শ একটি জায়গা। কোলাহল থেকে একটু দূরে মনোরম পরিবেশে পার্কটি সাজানো হয়েছে। পার্কের ডেকোরেশন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা বেশ উন্নত।
পার্কের মধ্যে বেশ কয়েকটি পানির ফোয়ারা, বাচ্চাদের বিভিন্ন রাইড, দোলনা ও চমৎকার বসার জায়গা রয়েছে। চারদিকে গাছগাছালির সমারোহ, হাটার জন্য সুন্দর রাস্তা ও মাঠ সব মিলিয়ে বেশ দারুণ একটি বিকেল কাটিয়ে আাসা যায় আল ফয়সালিয়া গার্ডেনে। বারবিকিউ করার জন্য দারুণ ব্যবস্থা আছে পার্কটির মধ্যে।
প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার আল ফয়সালিয়া গার্ডেন এর সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। বুধ বার থেকে রবিবার পর্যন্ত বিকাল ৪ টা থেকে রাত ১১:৩০ মিনিট পর্যন্ত পার্কটি খোলা থাকে এবং সোমবার দুপুর ১২ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

৭. শুভ্রা প্যালেস
তায়েফ শহরের ঐতিহাসিক ও প্রাচীন নিদর্শন গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শুভ্রা প্যালেস। ১৯০৫ সালে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রাসাদটি ছিল সৌদি আরবের বিখ্যাত বাদশাহ আব্দুল আজিজের বাসভবন। বর্তমানে শুভ্রা প্যালেস স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় একটি দর্শনীয় স্থান।
প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী প্রাসাদটির অত্যাশ্চর্য নির্মানশৈলীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে প্রাসাদটিতে ভ্রমন করতে যায়। তবে এই পর্যটন কেন্দ্রের কোনো প্রবেশ মূল্য নেই, যে কেউ বিনামূল্যে এখানে ঢুকতে পারবে এবং এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। শুভ্রা প্যালেস তায়েফ শহর থেকে মাত্র ৩.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই স্থানীয় যে কোনো বাহনের সাহায্যেই এখানে পৌঁছানো যায়।
৮.গ্রিন মাউন্টেন পার্ক
তায়েফের আলহাদা স্ট্রিটে অবস্থিত চমৎকার একটি থিম পার্ক হলো গ্রিন মাউন্টেন পার্ক। সবুজের সমারোহে পুরো পার্কটি ঘেরা। এই পার্কের মূল আকর্ষণ হলো রোলার কোস্টার।এই রাইডটি ছোট বড় সবারই খুব পছন্দের একটি বিনোদন। তাছাড়া শিশুদের জন্য রয়েছে আরও অসংখ্য রাইড। প্রতিটি রাইডই উত্তেজনাপূর্ণ ও মজার। তবে প্রতিটি রাইডই বেশ ব্যয়বহুল। তাছারা পার্কের ডেকোরেশন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সব মিলিয়ে বেশ চমৎকার একটি পরিবেশ তৈরি করে।
৯. তায়েফ সৌক মার্কেট
তায়েফের ঐতিহ্যবাহী মার্কেটগুলোর মধ্যে তায়েফ সৌক মার্কেট উল্লেখযোগ্য। শুধু কেনাকাটার উদ্যেশ্যেই নয় বরং দেশ বিদেশের পর্যটকেরা মার্কেটটি ঘুরে দেখার জন্যও এখানে ভীড় জমায়। সৌক মার্কেটে বিভিন্ন এরাবিক সস্থশিল্প পাওয়া যায়। তাছাড়া পুদিনা চা, সুগন্ধি, গোলাপজল, স্থানীয় মধু কিনতে অনেক লোক সমাগম ঘটে এই মার্কেটে৷
১০. তায়েফ সেন্ট্রাল মার্কেট
তায়েফ সেন্ট্রাল মার্কেট সোনা ও রূপার গহনার জন্য বিখ্যাত। বিদেশি পর্যটকেরা এই মার্কেটে আসে মূলত এরাবিক গোল্ড কালেক্ট করতে। বিশেষ করে বাংলাদেশি পর্যটকেরা সৌদি আরব থেকে সোনার গহনা কিনতে সাধারণত তায়েফের সেন্ট্রাল মার্কেটে চলে যায়।
এছাড়াও এই মার্কেটে মুসলমানদের পোশাক, সুগন্ধি, গোলাপ জল, গোলাপের তেল, সৌদি আরবের বিখ্যাত খাটি মধু পাওয়া যায়। মার্কেটটিতে শুধু স্থানীয় লোকজনই নয় বরং বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকদের ভীড় লক্ষ করা যায়। সকাল ৮ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত মার্কেটের সকল কার্যক্রম চালমান থাকে।
সৌদি আরবের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে তায়েফের আবহাওয়া বেশ স্বাভাবিক বলে হজ্জের শুরুতে এবং শেষে অথবা যাওয়া আাসার পথে যাত্রা বিরতি হিসেবে হাজীগন এই শহরে কিছুদিন সময় কাটান। এই সময়টুকুতে তায়েফ শহরের বিশেষ সব পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে তাদের সমাগম দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে পরিবার পরিজনের জন্য কেনাকাটা করতে তারা চলে যায় তায়েফের জনপ্রিয় সব মার্কেট গুলোতে