বিশাল জলরাশির সমাহার ও প্রাকৃতিক কলকাকলিতে মুখরিত বাংলাদেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন হাওর ‘টাঙ্গুয়ার হাওর’। টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। জলজ গাছপালা, শত শত প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণী ও হাজারো প্রজাতির পাখির বিশাল অভয়াশ্রম টাঙ্গুয়ার হাওর।
বিশাল জলরাশির কোলে ভেসে ভেসে প্রকৃতির সাথে এক নিবিড় মেলবন্ধন তৈরি করতে প্রতিবছর অসংখ্য ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের ভীড় জমে টাঙ্গুয়ার হাওরে। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বিখ্যাত এই হাওর। হাওর টির বর্তমান জলমহাল সংখ্যা ৫১ টি।
সাধারণত টাঙ্গুয়ার হাওরের আয়তন ৬৯১২.২০ একর, তবে বর্ষার সময়ে হাওরের পানির উচ্চতা বেড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার ফলে হাওর টির আয়তন ২০,০০০ একরেরও বেশি হয় কখনও কখনও। প্রকৃতিপ্রেমী মাত্রই চাইবে বিশাল এই মিঠাপানির জলরাশিতে কাটিয়ে আসতে দুটো দিন একান্ত নিজের মতো করে।তাইতো জেনে নেয়া দরকার টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমন সম্পর্কে বিস্তারিত সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যা আপনার পুরো ভ্রমন পরিকল্পনা সাজাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
টাঙ্গুয়ার হাওর কেন যাবেন?
বিশাল জলরাশির মধ্যে শত শত মাছের মেলা, বৃহৎ জলাভূমি, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী, পাখপাখালির কলকাকলীতে মুখরিত প্রাকৃতিক স্বর্গীয় পরিবেশে একান্ত নিজের মতো করে ছুটির দিনগুলো কাটাতে চাইলে অবশ্যই চলে যেতে পারেন টাঙ্গুয়ার হাওরে। টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমনের সবথেকে আকর্ষণীয় দিক হলো নৌকায় ভ্রমণ ও নৌকায় রাত্রিযাপন। পরিবার পরিজন নিয়ে পুরো একটা রাত নৌকায় কাটিয়ে দেয়া সত্যিই দারুণ এক অভিজ্ঞতা। সাথে খাওয়া দাওয়া, রান্না বান্না সবই যদি হয় বিশাল জলরাশির বুকে ভেসে থাকা নৌকার ওপরে তবে তো বেশ জমে যায়।
টাঙ্গুয়ার হাওরের বিশাল জলরাশিতে ভেসে বেড়ায় ১৪০ প্রজাতির মাছ। আরও আছে ১৫০ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ও হাজার হাজার বন্য পাখি।নৌকায় ভাসতে ভাসতে দেখা মিলবে হিজল ও করচ গাছের লম্বা সারি।তাছাড়া নলখাগড়া, দুধিলতা,নীল শাপলা,পানিফল, শোলা,হেলেঞ্চা, শতমূলী সহ প্রায় দুইশ প্রজাতির গাছ দেখতে পাবেন এখানে। শীতের সময় ২৫০ টিরও বেশি প্রজাতির অতিথি পাখি এসে ভীড় জমায় টাঙ্গুয়ার হাওরে।
হাওরের ঠিক মাঝ বরাবর হাতিরগাতা বিল অবস্থিত। এই বিলকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বিল গুলোর অবস্থান। শীতের সময় সব বিলের পানি শুকিয়ে গেলেও হাতিরগাতা বিল আগলে রাখে জলরাশির শেষ চিহ্নটুকু।
টাঙ্গুয়ার হাওরে ভাসতে ভাসতে দেখতে পাবেন ভারতের মেঘালয় পাহাড়। মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে যাচ্ছে ৩০ টি ছোট বড় পাহাড়ি ঝর্ণা বা ছড়া। এ যেন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
হাওড়ের মাঝখানে মাঝখানে আছে ৪৬ টি ভাসমান দ্বীপের মতো ছোট ছোট গ্রাম।এসব গ্রামের বাজার থেকে বিলের তাজা মাছ কিনে নৌকায় রান্না করে খাওয়ার মজাই আলাদা। হাওরের মধ্যে আছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। এর আসেপাশের পানি এতোটাই স্বচ্ছ যে ওপর থেকে হাওরের তলদেশের সবকিছু খুবই স্বচ্ছভাবে দেখা যায়।
সব মিলিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর প্রাকৃতিক প্রাচুর্য ও সৌন্দর্যের এক বিশাল লীলাভূমি। পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটির দিনগুলো টাঙ্গুয়ার হাওরে কাটালে মন্দ হয় না।
টাঙ্গুয়ার হাওর কোথায় অবস্থিত?
টাঙ্গুয়ার হাওর সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। সুনামগঞ্জ এর দুটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত বিশাল জলরাশিই হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওর অবস্থিত।

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
বছরের দুটো সময়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড় দেখা যায়। প্রথমত বর্ষার মৌশুম টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের একদম উপযুক্ত সময়। তখন চারদিক পানিতে থৈ থৈ করে, তাই নৌকা ভ্রমণ করতে বেশ সুবিধা হয়।
তবে অতিথি পাখির দেখা মিলতে চাইলে অবশ্যই শীত ঋতুতে যেতে হবে। শীতের সময় লক্ষ লক্ষ পাখি এসে রাজত্ব শুরু করে হাওরের বুকে। কখনও কখনও দেখা যায় প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে শুধু পাখির দল উড়ে যাচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল অতিথি পাখিদের সব থেকে প্রিয় অভয়ারণ্য।
তাই টাঙ্গুয়ার বিল ভ্রমণের জন্য বর্ষা অথবা শীত ঋতু বেছে নেয়াটাই উত্তম। তবে শীতের সময় হাওরের জলরাশি একদমই কম থাকে।
টাঙ্গুয়ার হাওর কীভাবে যাবেন?
টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার জন্য সহজ দুটি পথ রয়েছে। সবথেকে সহজ হবে ঢাকা থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জ গিয়ে সেখান থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়া। অন্যটি হলো যে কোনো জায়গা থেকে প্রথমে সিলেট এবং সিলেট থেকে আবার সুনামগঞ্জ গিয়ে সেখান থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর।
ঢাকা থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জ যাওয়ার ক্ষেত্রে –
ঢাকার সায়দাবাদ বাস স্টেশন থেকে প্রতিদিন শ্যামলী পরিবহন, এনা পরিবহন, হানিফ পরিবহন এবং মামুন পরিবহন এর বাস সুনামগঞ্জ এর উদ্যেশ্যে যাত্রা করে। যে কোনো বাসে চেপে পছন্দমতো সময়ে ঢাকা থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জ পৌছুতে পারবেন। বাস ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পৌছুতে সময় লাগবে ৬ ঘন্টা।
সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার ক্ষেত্রে –
সিলেটের কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ রুটে চলাচলকারী লোকাল বাস পাওয়া যায়। বাসে চেপে সরাসরি সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ পৌছুতে পারবেন। বাস ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১০০ টাকা। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ পৌছুতে সময় লাগবে ২ ঘন্টার মতো।
তাছাড়া সিলেটের শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার লাইট গাড়ি পাওয়া যায়। ২০০ টাকা ভাড়ায় শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জ পৌছুতে পারবেন।
সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার পদ্ধতি-
সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর উপরে অবস্থিত ব্রিজের কাছ থেকে লেগুনা, সিএনজি বা বাইকে করে চলে যেতে হবে তাহিরপুর। তাহিরপুর নৌকা ঘাট থেকে পছন্দমতো নৌকা দরদাম করে নিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন টাঙ্গুয়ার হাওর।
তবে শীতকালে পানি কম থাকায় তাহিরপুর নৌকা ঘাট থেকে নৌকা নেয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই ব্রিজের কাছ থেকে বাইক বা সিএনজি নিয়ে সরাসরি চলে যেতে হবে সোলেমানপুর। সোলেমানপুর নৌকা ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর টাঙ্গুয়ার হাওরে।
কোথায় থাকবেন?
টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে গেলে সবথেকে চমকপ্রদ বিষয় হয় হাওরের বুকে নৌকায় ভেসে রাত কাটানো। বেশিরভাগ পর্যটকই নৌকায় রাত কাটানোর সুযোগটি হাতছাড়া করতে চান না। এক্ষেত্রে পছন্দমতো নৌকা দরদাম করে নিয়ে এক রাতের জন্য ভাড়া করতে পারবেন। ভাড়া করার সময় অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নিবেন যে নৌকায় টয়লেট ব্যবস্থা ও সোলার প্যানেলের ব্যাবস্থা আছে কিনা।
নৌকায় রাত কাটাতে না চাইলে চলে যেতে হবে তিন কিলোমিটার উত্তর পূর্বে অবস্থিত টেকেরঘাটে। এখানে ‘হাওর বিলাশ’ নামক কাঠের বাড়িতে স্বল্পমূল্যে রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। তাছাড়া টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউজেও থাকার ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।
দিনে দিনে ঘোরাফেরা শেষ করতে পারলে সুনামগঞ্জ এসে হোটেল ভাড়া করে থাকতে পারবেন। সুনামগঞ্জে ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি হোটেল পাবেন।
খাওয়ার ব্যবস্থা
ভ্রমন যদি হয় শুধুমাত্র এক দিনের জন্য তাহলে তাহিরপুর বাজারে অবস্থিত হোটেলে খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা সারতে পারবেন। এখানকার হোটেল গুলোতে পাবেন ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির বিলে ধরা পড়া সুস্বাদু মাছ।
রাতে থাকার জন্য নৌকা ভাড়া করলে মাঝির সাথে চুক্তি করে নির্দিষ্ট টাকা দিলে মাঝি নিজেই নৌকায় রান্না ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে।
যদি দুই তিন দিন এর ট্যুর প্লান থাকে তাহলে তাহিরপুর বাজার থেকে প্রয়োজনীয় সব বাজার করে নিয়ে নৌকায় উঠবেন। ভ্রমণকালে হাওরের মধ্যে অবস্থিত দ্বীপ গ্রামের বাজার থেকে তাজা মাছ কিনে রান্না করে খেতে পারবেন। পিকনিক গ্রুপ একসাথে গেলে ওয়াচ টাওয়ারে নেমে রান্না ও খাওয়ার ঝামেলা সেরে ফেলতে পারবেন।
সতর্কতা :
ভ্রমনের সময় অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট আছে এমন নৌকা বাছাই করুন।
নোকায় লাইফ জ্যাকেট না থাকলে তাহিরপুর বাজার থেকে লাইফ জ্যাকেট ও সোলার প্যানেল ভাড়া নিয়ে নিতে হবে।
সাথে প্রয়োজনীয় খাবার, পানি ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে নৌকায় উঠতে হবে।