টাঙ্গাইল জেলার বিখ্যাত খাবারের নাম ও পরিচিতি

পোড়াবাড়ির চমচম ও তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত টাঙ্গাইল জেলা ঢাকা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল। এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহু বছরের পুরনো। নানা ধরনের লোকসংস্কৃতি মিশে আছে টাঙ্গাইল জেলার সাধারণ মানুষের সাথে । 

পোশাক শিল্পের পাশাপাশি নানা বৈচিত্র্যের খাবারের জন্যও এই জেলা বিখ্যাত।চমচম, দই, আমৃত্তি, কদমা টানা বাদাম সহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন-এর জন্য টাঙ্গাইল জেলা বিখ্যাত। শুধু মিষ্টান্নই নয় এই জেলার সাধারণ মানুষের বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারের পদ টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করেছে।চলুন জেনে নেয়া যাক টাঙ্গাইল জেলার ঐতিহ্যবাহী বেশ কিছু খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত।

১. টাঙ্গাইলের চমচম

চমচম মানেই টাঙ্গাইলের বিখ্যাত সুস্বাদু চমচম – এর বিকল্প আর কিছু হতেই পারে না। চমচম একধরনের ছানার তৈরি মিষ্টি – যা সুপ্রাচীন কাল থেকেই টাঙ্গাইল জেলার নামের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি নামক স্থানে সর্বপ্রথম চমচম তৈরির প্রচলন ও বিক্রি শুরু হয়। এই বিখ্যাত মিষ্টির ইতিহাস প্রায় দুইশো বছরের পুরোনো। পেড়াবাড়িতে এর উৎপত্তি হলেও বর্তমানে মিষ্টির ব্যবসার রমরমা পরিবেশ চলছে টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনি বাজারে। এখানে প্রায় এক শতাধিকেরও বেশি মিষ্টির দোকান রয়েছে। 


আর এইসব দোকানে স্থানীয় লোকসহ বিদেশী পর্যটক ও দেশের বিভিন্ন লেকজন ভিড় জমায় বিখ্যাত চমচম এর স্বাদ নেয়ার জন্য । অন্যদিকে পোড়াবাড়িতে আছে হাতে গোনা পাঁচ থেকে ছয়টি দোকান। চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা। বাইরের অংশ কিছুটা শক্ত কিন্তু ভেতরে নরম তুলতুলে রসে টইটুম্বুর এই মিষ্টি ছোট থেকে বুড়ো সবারই বেশ পছন্দ ।

২. কচুশাকের ইলিশ ভুনা

টাঙ্গাইল জেলার সাধারণ জনজীবনের সাথে জড়িত খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার ‘কচু শাকের ইলিশ ভুনা ‘। ইলিশ মাছ আর কচুর শাক, সে যেন এক দারুণ কম্বিনেশন । কচুর ডগা কেটে ভিজিয়ে রেখে ভাপে সিদ্ধ করে পানি ফেলে দেয়া হয়।
 ইলিশ মাছের ভাজা মাথা ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে রান্না করা হয় কচুর ডগা । ইলিশ মাছের সুগন্ধ সাথে কচুর ডগার মজাদার স্বাদ সব মিলিয়ে গরম গরম ভাতের সাথে জমে একেবারে ক্ষীর। স্বাদের পাশাপাশি কচুর শাকে আছে প্রচুর পুষ্টিগুণ যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

৩. চুকা খিচুড়ি

টাঙ্গাইলের একদমই সাধারণ কিন্তু বেশ জনপ্রিয় খাবার চুকা খিচুড়ি । টক শব্দটিকে টাঙ্গাইলের ভাষায় বলা হয় চুকা। চুকা খিচুড়ি খেতে কিছুটা টক স্বাদের বলে এর নাম হয়েছে চুকা খিচুড়ি ।
আগের দিনের বেচে যাওয়া ভাত দিয়ে বিভিন্ন মসলা ও ডালের সংমিশ্রণে রান্না করা হয় এই খিচুড়ি৷ খিচুড়ির থিকনেস হয় কিছুটা পাতলা, একদম শক্ত বা ভুনা ভুনা হয় না। বাসি ভাত দিয়ে রান্না করা হয় বলে খিচুড়ির মধ্যে চলে আসে একটু টক টক ভাব, যা এই খাবারের স্বাদকে দ্বিগুণ করে দেয়। 


সব উপাদান ভালোভাবে জ্বাল করে শেষ মুহুর্তে পেয়াজ, রসুন ও তেল দিয়ে ফোড়ন দেয়া হয়,ফলে এর মন মাতানো গন্ধে সবারই আগ্রহ জন্মায় খাওয়ার জন্য । সাধারণত বিভিন্ন ধরনের ভর্তা দিয়ে চুকা খিচুড়ি খাওয়া হয় ।

৪. টানা বাদাম

টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন এর মধ্যে টানা বাদাম বহুল প্রচলিত একটি খাবার। টানা বাদামকে মুখরোচক খাবার হিসেবেও ধরা হয়। বিশেষ করো ছোটদের খুবই প্রিয় একটি খাবার টানা বাদাম।


ভাজা চিনাবাদাম ও গুড়ের সংমিশ্রণে এই খাবারটি তৈরি করা হয় । চিনা বাদাম ভেজে খোসা ছাড়িয়ে গুড় জ্বাল করে ঘন কেরামেল তৈরি করে তার মধ্যে বাদাম দিয়ে দেয়া হয়। তারপর ছড়ানো কোনো পাত্রে সেই মিশ্রনটি ঢেলে ঠান্ডা করলেই হয়ে যায় মজাদার টানা বাদাম। কামরে কামড়ে গুড়ের মিষ্টতা সাথে বাদামের দারুণ স্বাদ,সব মিলিয়ে চমৎকার অনুভূতি । টানা বাদামের সাথে নব্বই দশকের ছেলেমেয়েদের আছে দারুণ শৈশবের স্মৃতি।

৫. বেগুনের খাষি

টাঙ্গাইল জেলার খুবই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খাবার বেগুনের খাষি। বগুনের খাষি প্রথমত গারো সমাজের লোকজনের মধ্যে খাওয়ার প্রচলন ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই খাবারটির বেশ জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
বেগুনের খাষি বেগুন দিয়ে তৈরি একধরনের সাধারন ধাচের রান্না। মাঝারি আকৃতির বেগুন কেটে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে সব ধরনের মসলা দিয়ে রান্না করা হয় বেগুনের খাষি। চিংড়ি বাটা ব্যবহার করলে এই তরকারির স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। শীতের সকালে গরম গরম ভাতের সাথে বেগুনের খাষি টাঙ্গাইল বাসীর খুব প্রিয় এবং প্রচলিত একটি খাবার।

৬. খুইড়া কাটার চচ্চড়ি

একদমই আনকমন ও আঞ্চলিক খাবার ‘খুইড়া কাটার চচ্চড়ি’। খুইড়া কাটা একধরনের জংলী গাছ। জঙ্গলের ঝোপ ঝাড়ে আগাছা হিসেবে জন্মায় এই গাছ। বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ এই খাবার সম্পর্কে জানে না বিধায় এই গাছ আগাছা হিসেবেই পড়ে থাকে। কিন্তু টাঙ্গাইলের মানুষের কাছে খুবই প্রিয় একটি খাবার খুইড়া কাটার চচ্চড়ি। খুইড়া কাটা গাছের পাতা শাক হিসেবে ভাজি করে খাওয়া হয়। 


বিভিন্ন ছোট মাছ বা শুটকি দিয়ে অন্য শাক এর সাথে মিশিয়ে ভাজি করা হয় খুইড়া কাটা শাক। ছোট মাছ ভেজে আলাদা করে রেখে সব মসলা দিয়ে শাক ভাজি করে তার মধ্যে দিয়ে দেয়া হয় ভাজা মাছ। একদমই অপরিচিত এই খাবারটি টাঙ্গাইলের মানুষ বহু আগ থেকেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিবেশন করে আসছে।

৭. গরুর মাংসের শুটকি

আগে এমন ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিল না, তাই কোরবানির মাংস ফ্রিজে রেখে সারাবছর খাওয়ার প্রচলনও ছিল না। অতিরিক্ত মাংস অনেক দিন রেখে খাওয়ার পদ্ধতি হিসেবে উদ্ভাবন করা হয়েছে গুরুর মাংসের শুটকি । টাঙ্গালের মানুষের সংস্কৃতির সাথে এই খাবার এমন ভাবে মিশে গেছে যে এখন ফ্রিজ থাকা সত্বেও শুটকির অনন্য স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না তারা।

তাই স্পেশাল আইটেম হিসেবে এখনও গরুর মাংসের শুটকি তৈরির প্রচলন আছে ঘরে ঘরে।
গরুর মাংশ লবন, হলুদ ও তেল দিয়ে জ্বাল করে রোদে শুকানো হয়। শুকনো মাংস বয়ামে ভরে সংরক্ষণ করে রাখা হয় অনেক দিন। ইচ্ছে হলে নামিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু ভর্তা,ভুনা ইত্যাদি।

৮. চিনার উনসা

কালের বিবর্তনে প্রায় হারাতে বসা টাঙ্গাইলের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার চিনার উনসা।চিনার উনসা এক ধরনের ডেজার্ট আইটেম।
চিনা একধরনের দানা শস্য। টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে চিনা উৎপাদিত হতো। সেই চীনা সংগ্রহ করে সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে ঢেকিতে ভাঙলে এক ধরনের চাল পাওয়া যায়। সেই চাল বালুতে ভেজে চেলে তা দিয়ে রান্না করা হতো পায়েস। দুধ,চিনি,বাদাম, তেজপাতা আর চিনা মিলে তৈরি করা পায়েস ছাড়া আগে অতিথি আপ্যায়নের কথা টাঙ্গাইলের মানুষ ভাবতেই পারতো না। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, বর্তমানে টাঙ্গাইলের অনেকেই চিনার উনসা কি জিনিস বলতে পারে না।

৯. মাংস দিয়ে মুড়ি

একদম সাধারণ একটি খাবার হলেও টাঙ্গাইল বাসীর কাছে খুবই প্রিয় এবং প্রচলিত একটি খাবার ‘মাংস দিয়ে মুড়ি’। বাড়িতে মাংস রান্না হয়েছে অথচ মুড়ি দিয়ে খাওয়া হয় এমন ঘটনা হতেই পারে না। টাঙ্গাইলের জন জীবনের সাথে মিশে আছে সুস্বাদু এই খাবারটি।

১০. আনারসের তরকারি

টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় প্রচুর পরিমাণ আনারস উৎপাদন হয়। আনারস পাকলে সাধারণত কেটে খাওয়া হয়। কিন্তু টাঙ্গাইলের মানুষ কাঁচা এবং পাকা উভয় আনারস রান্না করে খেতে ভালোবাসে। কচি আনারস কুচি করে কেটে শুটকি দিয়ে রান্না করা হয়। আর পাকা আনারস দিয়ে খাওয়া হয় ইলিশ মাছের তরকারি। আনারসের মৌসুমে এই তরকারি রান্না হয়না এমন বাড়ি খুজে পাওয়াই মুশকিল।

টাঙ্গাইল জেলার আরও কিছু ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার হলো:

১. আমের পায়েস
২. কলার কেঞ্জাল
৩. ঢেপের মোয়া
৪. জোয়ারের খই
৫. দানাদার
৬. কাঁঠাল
৭. আনারস
৮. মেন্দা
৯. বেগুন দিয়ে দেশী মুরগি
১০. আম দুধ ভাত (ইত্যাদি)

Scroll to Top