মুসলমানদের সবথেকে পবিত্রতম ভূমি মক্কা নগরীর প্রবেশদ্বার জেদ্দা শহর। শহরটি সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত। জেদ্দা শহরের আয়তন ৩,০০০ বর্গকিলোমিটার বা ১,০০০ বর্গমাইল যা কিনা সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং মক্কা প্রদেশের সব থেকে বড় শহর। এটি সৌদি আরবের একটি গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক কেন্দ্র।
এই শহরে আছে সৌদি আরবের বিখ্যাত সব চমৎকার স্থাপনা এবং ইসলামের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। মক্কায় হজ্জ করতে আসা মুসুল্লিগন হজ্জের সফরের শেষে বা শুরুতে জেদ্দা শহরে আসেন এখানকার বিখ্যাত স্থাপনা, মসজিদ ও ঐতিহাসিক স্থান সমূহ পরিদর্শন করতে। আজকের আয়োজনে থাকছে সৌদি আরবের জেদ্দা শহরের বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান সমূহ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য।
১. আল রাহমা মসজিদ
জেদ্দা শহরের চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে আল রাহমা মসজিদ অন্যতম। এর ডিজাইন ও অবকাঠামো এতোটাই চমৎকার যে, সৌদী আরবের শীর্ষস্থানীয় মসজিদ গুলোর মধ্যে এই মসজিদটি রয়েছে। আল রাহমা মসজিদকে ভাসমান মসজিদও বলা হয়। পানির নিচে বসানো পিলারের ওপর এমন ভাবে মসজিদটি নির্মান করা হয়েছে যে আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হবে সমুদ্রের পানির মধ্যে ভেসে আছে মসজিদটি।
পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নিয়েছে চমৎকার ডিজাইনে নির্মিত আল রাহমা মসজিদ।মসজিদটির সাদা ও ফিরোজা মর্বেল পাথরের গম্বুজটি যে কারো নজর কাড়তে সক্ষম। মক্কার হজ্জ যাত্রীগন মূলত এখানে যাত্রা বিরতি করে এবং পুরো পথের ক্লান্তি কাটিয়ে উঠে পুরো মসজিদের অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করে।
২. আল বালাদ
আরবের একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা আল বালাদ। এটি জেদ্দার একটি দরিদ্র প্রতিবেশী শহর যেখানে ৫০০ বছরের পুরোনো নিদর্শন রয়েছে। শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার দুই পাশের পুরোনো দালানগুলো যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। প্রাচীন আরব সম্পর্কে জানতে ও আরবের ঐতিহ্য নিজ চোখে পরিদর্শন করতে হজ্জের উদ্যেশ্যে আসা মুসুল্লিগন এখানে আসেন।
আল বালাদ স্থানটির জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো এখানকার খাবার। এখানে আরবের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার পাওয়া যায়। বেশ নামকরা কয়েকটি হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেখানে আরবের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো পাওয়া যাবে। তাছাড়া কেনাকাটা করার জন্যও অনেক মুসুল্লী এখানে ভীড় করেন। থাকার জন্য আছে গোল্ডেন হোটেল, আল আজহার হোটেল সহ আরও বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় আবাসিক হোটেল।
৩. আথর গ্যালারি
শিল্পের দিক থেকে সৌদি আরব পুরো বিশ্বের মধ্যে বেশ এগিয়ে আছে। সৌদি আরবের সমসাময়িক শিল্পকে বিশ্বের সকল মুসলিমদের কাছে তুলে ধরতে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় আথর গ্যালারি।
এখানে সৌদি আরবের প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন শিপ্লকে প্রাধান্য দিয়ে গ্যালারিটি নির্মাণ করা হয়েছে।আথর গ্যালারিতে প্রায়ই দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজীগন সৌদি আরবের দর্শনীয় স্থান সমূহ ঘুরে দেখতে চাইলে আথর গ্যালারির গুরুত্ব থাকে বেশ। জেদ্দার তাহলিয়া স্ট্রিটে গ্যালারিটি অবস্থিত।
শুক্র ও শনি এই দুই দিন আথর গ্যালারির সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এবং রবিবার সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
৪. আল-শাল্লাল থিম পার্ক
সৌদি আরবের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র গুলোর মধ্যে আল-শাল্লাল থিম পার্ক অন্যতম। এটি সৌদি আরবের জেদ্দা শহরের আল হারামাইন রোডে অবস্থিত। ৬০,০০০ বর্গমিটার জায়গা নিয়ে পার্কটি নির্মাণ করা হয়েছে। ছোটদের জন্য রিসোর্টটি খুবই চমৎকার।
এখানে আছে বিভিন্ন ধরনের বিনোদন মূলক রাইড যা ছোট বড় সবারই বেশ ভালো লাগবে। আছে খুবই ভালো মানের রেস্তোরা, যেখানে পরিবারের সাথে সুন্দর একটি খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করতে পারবেন। সব ধরনের এরাবিক খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে অবশ্যই রেস্তারাটিতে বসতে হবে।
প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার আল-শাল্লাল থিম পার্ক বন্ধ থাকে। পার্কের প্রবেশ মূল্য ৯.৩৩ মার্কিন ডলার।
৫. আল সাইফ সমুদ্র সৈকত
সৌদি আরবের সমুদ্র সৈকত গুলোর মধ্যে জনপ্রিয় একটি সমুদ্র সৈকত হলো আল সাইফ সমুদ্র সৈকত। এই বীচটি স্থানীয় লোক থেকে শুরু করে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। সকালের মনোরম পরিবেশে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখা যায় এই বীচে৷ পরিবার নিয়ে বনভোজন, সুইমিং, বীচের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ এ সব কিছুই মক্কায় আগত হাজীদের টেনে নিয়ে যায় জেদ্দায় অবস্থিত এই আল সাইফ সমুদ্র সৈকতে।
আছে সী বীচ ক্যাফে যেখানে আরবের জনপ্রিয় বিভিন্ন খাবারের স্বাদ উপভোগ করা যাবে। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে সমুদ্রের সাথে একাত্মতা গড়ে তুলতে চাইলে অবশ্যই একবার ঘুরে আসা উচিত দক্ষিণ জেদ্দায় অবস্থিত আল সাইফ সমুদ্র সৈকত থেকে।
৬. সওক শাতী
সৌদি আরবের মধ্যে জেদ্দা শহরের মার্কেট গুলো একটু বেশিই জনপ্রিয়। এখানে আছে বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মার্কেট থেকে শুরু করে আধুনিক শপিংমল। তেমনই জেদ্দার একটি জনপ্রিয় মার্কেট হলো সওক শাতী। এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে শুরু করে পোশাক, সুগন্ধি, জায়নামাজ, গৃহস্থালি সাজসজ্জা ও খাবারের বিভিন্ন দোকান রয়েছে৷
এই মার্কেটি জেদ্দার খুবই ব্যস্ততম একটি জায়গা। কেননা স্থানীয় লোকজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকেরা সবাই এখানে আসে প্রয়োজনীয় কোনাকাটা করার পাশাপাশি জনপ্রিয় এই মার্কেটটি ঘুরে দেখতে। প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ২ টা এবং বিকাল ৪:৩০ মিনিট থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত মার্কেটটি খোলা থাকে।
৭. রেড সি মল
জেদ্দার সবথেকে জনপ্রিয় ও বিলাসবহুল শপিং মল হলো রেড সি মল। শপিং মলটির অসাধারণ অবকাঠামো এবং দারুন ইন্টেরিয়র যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। শুধু কেনাকাটার উদ্যেশ্যেই নয়, শপিং মলটির চমৎকার ডেকোরেশন দেখতে ও ঘোরাঘুরি করতেও অসংখ্য লোকজন এই শপিং মলে আসে৷ এখানে আছে বিশ্বের সেরা ব্রান্ডের বিভিন্ন শো রুম, বিলাসবহুল ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্ট, পার্কিং সুবিধা সহ আরও অনেক ফেসিলিটিস। সৌদি আরবে যাওয়ার সুযোগ হলে অবশ্যই রেড সি মল থেকে একবার ঘুরে আাসা উচিত।
৮. সাউথ কর্নিচ
জেদ্দার কর্নিচ খুব জনপ্রিয় একটি জায়গা হলেও সাউথ কর্নিচ কিছুটা অনাবিষ্কৃত এবং নির্জন। এটা জেদ্দা শহর থেকে আনুমানিক ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। জেদ্দা থেকে বিচ্ছিন্ন এই স্থানটিতে রয়েছে বেশ কিছু সী বীচ এবং বেশিরভাগ বীচের পানি একদমই স্বচ্ছ যা সুইমিং এর জন্য আদর্শ। কিছু কিছু বীচে ক্যাফে এবং রেস্তোরাঁ পাওয়া যাবে। এখানে সাইকেলিং, ঘুড়ি ওড়ানো বেশ উপভোগ করা যায়, কেননা জায়গাটি একদমই জনকোলাহল থেকে মুক্ত। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য জেদ্দা সাউথ কর্নিচ খুবই জনপ্রিয় একটি যায়গা।
৯. দুররাত আল আরুস
জেদ্দা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা দুররাত আল আরুস। পর্যটন এলাকাটি ১৯৯৬ সালে জেদ্দার দাহাবান নামক স্থানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখানে একসাথে সমুদ্র সৈকত, চমৎকার ভিলা, রেস্টুরেন্ট, ঘোরার গাড়ি, বিনোদন পার্ক সহ বিভিন্ন উপভোগ্য বিষয়বস্তু একসাথে দেখতে পারবেন। সৌদি আরবে একই ভ্রমনে সবকিছু একসাথে উপভোগ করতে চাইলে চলে যেতে পারেন জেদ্দায় অবস্থিত দুররাত আল আরুস পর্যটন এলাকায়।
১০. কিং ফাহদ’স ফাউনটেইন
কিং ফাহদ’স ফাউনটেইন বা কিং ফাহদের ফোয়ারা পৃথিবীর সবথেকে উঁচু কৃত্রিম ঝর্ণা। এই ফোয়ারাটি জেদ্দা শহরে অবস্থিত। প্রতিদিন অসংখ্য বিদেশী পর্যটক এই ফোয়ারার অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করতে জেদ্দা শহরে এসে ভীড় জমায়। ফোয়ারাটির উচ্চতা ৩১২ মিটার বা ১০২৪ ফুট। রাতের বেলা ঝর্ণাটির সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সন্ধ্যায় ফোয়ারার আশেপাশে ৫০০ টিরও বেশি উচ্চ-তীব্রতার স্পট লাইট জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ফলে দেখতে আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগে।
জেদ্দা শহরের আরও কিছু দর্শনীয় স্থান হলো:
১. মুন ভ্যালি
২. খলিল মিউজিয়াম
৩. সুক আল আলাভী
৪. খুজাম প্যালেস
৫. বাব মক্কা
৬. জেদ্দা ওয়াটারফ্রন্ট
৭. দক্ষিণ ওভুর সমুদ্র সৈকত (ইত্যাদি)