জামালপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকা

খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে জামালপুরের লোকজনের মধ্যে আছে বেশ শৌখিনতা। নানা পালা পার্বন থেকে শুরু করে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় থাকে সুস্বাদু এবং ব্যতিক্রমধর্মী সব খাবার। উৎসব অনুষ্ঠানে তো খাওয়া দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। জামালপুর জেলার স্থানীয় বেশ কিছু খাবার এই অঞ্চলের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। আসুন জেনে নেই জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার সম্পর্কে।

১. মিল্লি / পিঠালি

জামালপুরের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাবার পিঠালি। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই গ্রামে বা মহল্লায় বিচার শালিশ হলে বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের মিল্লি খাওয়ার প্রচলন ছিল। এখনও মিলাদ মাহফিল বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে পিঠালি রান্না করা হয়। পিঠালি রান্না হলেই যেন বাড়িতে উৎসবের আমেজ চলে আসে। মিল্লি বা পিঠালির জন্য জামালপুর জেলা সারা বাংলাদেশে বিখ্যাত।

পিঠালি রান্না করা হয় গরু, খাসি বা মহিষের মাংস দিয়ে। সাথে দেয়া হয় চালের গুঁড়ো, বিভিন্ন মসলা ও তেল। চালের গুঁড়ো দিলে খাবারটি ঘন থকথকে হয় এবং স্বাদে আসে বৈচিত্র্যতা। সবাই একসাথে বসে কলাপাতায় করে পিঠালি খাওয়া হয়। পিঠালি সাধারণত গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়।

তবে বর্তমানে উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়াও অনেকেই বাড়িতো শখ করে পিঠালি রান্না করে। পিঠালি রান্না হলে অন্য কোনো তরকারি কারো মুখেই রোচে না। পিঠালিকে অনেকে ম্যান্দা বা মিলানি নামেও চেনে।

২. প্যারা সন্দেশ

জামালপুর জেলার বিখ্যাত মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার প্যারা সন্দেশ। জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলায় এই মিষ্টির উদ্ভব হয়েছিল এবং এখনও এখানে প্যারা সন্দেশের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। ফলে এই সন্দেশকে অনেকে সরিষাবাড়ির সন্দেশও বলে থাকে। সরিষাবাড়ি উপজেলার সব মিষ্টির দোকানেই প্যারা সন্দেশ পাওয়া যায় এবং প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে ক্রেতা সমাগম ঘটে এইসব দোকানে।

প্যারা সন্দেশ বানানোর মূল উপকরণ খাটি গরুর দুধ ও চিনি। প্রায় চার কেজি দুধ দিয়ে এক কেজি সন্দেশ তৈরি হয়। এক কেজিতে সন্দেশ হয় ৭০ থেকে ৭৫ পিস। প্রতি কেজি সন্দেশ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। জামালপুরে বেড়াতে গেলে সবাই নিজের পরিবার পরিজনের জন্য সুস্বাদু এই সন্দেশ কিনে নিয়ে যায়। প্রবাসীদের হাত ধরে প্যারা সন্দেশের স্বাদ বিদেশের মাটিতেও পৌছেছে।

৩. ছানার পায়েস

জামালপুরের ভোজন রসিকদের খাদ্য তালিকায় সুস্বাদু পদ ছানার পায়েস। উৎসব অনুষ্ঠান কিংবা অতিথি আপ্যায়নে অথবা খুশির সংবাদে মিষ্টি মুখ করতে ছানার পায়েস গুরুত্ব পায় সবার আগে। সাধারণ দুধের তৈরি পায়েসের থেকে ছানার পায়েসের স্বাদ কয়েক গুন বেশি। ঘরোয়া ভাবে তৈরি করার পাশাপাশি জামালপুরের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে ও রেস্টুরেন্টে ছানার পায়েস তৈরি করা হয়।

ছানার পায়েশ তৈরির মূল উপকরণ হিসেবে থাকে ছানা। এর সাথে যুক্ত হয় গরুর দুধ, চিনি, ক্ষীর, কিসমিস, বাদাম। হাঁড়িতে দুধ জ্বাল করে তার সাথে চিনি, ছানা ও ক্ষীর দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নেয়া হয়। জ্বাল করে ঘন হয়ে আসলে নামিয়ে পরিবেশন পাত্রে ঢেলে উপরে বাদাম ও কিসমিস ছড়িয়ে দেয়া হয়। সুস্বাদু ছানার পায়েস জামালপুর সহ বিভিন্ন জেলাতেই জনপ্রিয় মিষ্টান্ন খাবার।

৪. খাজা

বিকেলের নাশতায় মুখরোচক খাবারের তালিকায় জামালপুর বাসীর প্রিয় আইটেম খাজা। তবে খাজা পাওয়া যায় শুধুমাত্র জামালপুর জেলার জগন্নাথ ঘাট নামক স্থানে।
খাজা মূলত আটা ও চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টি জাতীয় খাবার। জগন্নাথ ঘাট ঘুরতে গেলে সবাই এখানকার ছোট ছোট দোকান থেকে খাজা কিনে নিয়ে আসে।

খাজা তৈরির জন্য আটা ও তেল দিয়ে খামির করে রাখা হয়। সেই খামির একটু শক্ত হয়ে গেলে চাকুর সাহায্যে চারকোনা ছোট ছোট করে কেটে তেলে ভাজা হয়। তেলে ভাজা খাজা আবার চিনির সিরায় দিয়ে উপরের পুরো অংশ চিনি দিয়ে কোটিং করা হয়। উপরে চিনি ভেতরে নোনতা স্বাদের হওয়ার খেতে বেশ দারুণ। প্রতি পিস খাজা ৫ থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।

৫. চাল বিরন

জামালপুরের আঞ্চলিক ভাষায় খাবারটি চাল বিরন নামে পরিচিত হলেও অন্যান্য অঞ্চলে এই খাবারটি বুট বিরিয়ানি বা ছোলার বিরিয়ানি নামেও পরিচিত। সাধারণত রমজানে ইফতারে সময় প্রধান খাবার হিসেবে থাকে চাল বিরন।

চাল বিরন তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে থাকে ছোলা বুট। ছোলা বুটের সাথে পোলাওয়ের চাল দিয়ে চাল বিরন রান্না করা হয়। তবে অনেকে আতপ চাল দিয়েও রান্না করে। বিরিয়ানি বলা হলেও এই খাবারে কিন্তু সাধারণ বিরিয়ানির মতো কোনো মাংস ব্যবহার করা হয় না। শুধু খোসা সহ ছোলা বুট, পোলাওয়ের চাল বা আতপ চাল ও বিভিন্ন ধরনের মসলা ব্যবহার করে চাল বিরন রান্না করা হয়।

প্রথমে ছোলা বুট সিদ্ধ করে আলাদা করে রাখা হয়। তারপর হাড়িতে মসলা কষিয়ে তার মধ্যে ধুয়ে রাখা চাল ও সেদ্ধ বুট দিয়ে রান্না করা হয়। রান্না হয়ে গেলে ভাপে রাখা হয় ইফতারের আগ পর্যন্ত। ইফতারের সময় ঢাকনা উঠিয়ে গরম গরম চাল বিরন পরিবেশন করা হয়। সাথে একটু সালাদ হলে মাংসের বিরিয়ানির স্বাদকেও হার মানায় সুস্বাদু এই খাবারটি।

৬. ক্যানজাল

কলাগাছ কেটে ফেলার পর উপরের কয়েক পাল্লা চামড়া উঠিয়ে ফেললে ভেতরে নরম ও সাদা অংশ পাওয়া যায়। কলাগাছের এই সাদা অংশকে জামালপুরের মানুষ কলার ক্যানজাল বলে। বিভিন্ন অঞ্চলে এটা কলার থোর নামেও পরিচিত।

কলাগাছের এই সাদা অংশ তরকারি হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। কেউ খায় পাতলা করে কেটে শুধু ভাজি,কেউ খায় ডাল দিয়ে রান্না করে,কেউ রান্না করে মাছের সাথে তরকারি আবার কেউবা বানায় ভর্তা। তবে যেভাবেই রান্না করা হোক না কেন ক্যানজাল কিন্তু গরম ভাতের সাথে খুবই উপাদেয় একটি খাবার।

উপরের অংশ ফেলে নরম ক্যানজাল বের করে পাতলা পাতলা করে কেটে ভাপিয়ে নেয়া হয়। কুচো চিংড়ি দিয়ে ভাপানো ক্যানজাল ভাজি করলে বেশ সুস্বাদু হয়।
একটু বড় সাইজ কেটে ভাপিয়ে পানি ঝড়িয়ে ডাল ও শাকের সাথে মসলা দিয়ে সিদ্ধ করে পেয়াজ রসুনের ফোড়ন দিলেও হয় অসাধারণ তরকারি।

আবার ভাপানো ক্যাজাল ও মাছ একসাথে ভেজে পেয়াজ মরিচ চটকে ভর্তা করে ২ প্লেট ভাত অনায়াসে খাওয়া যায়।

৭. বেগুন দিয়ে কাচকি মাছ

কাচকি মাছ ও বেগুন তরকারি জামালপুরের মানুষের নিত্য দিনের খাদ্য তালিকায় বেশ গুরুত্ব পায়। কাচকি হলো ছোট ছোট সাদা রঙের মাছ। জামালপুরে কাচকি মাছ খাওয়ার প্রচলন অনেক বেশি। কাচকি মাছ অনেক ভাবেই রান্না করা হয়। কিন্তু বেগুন দিয়ে কাচকি মাছ রান্নাটা বেশ ট্রেডিশনাল।

কাচকির গুঁড়া মাছ ভালোভাবে ধুয়ে তারসাথে পেয়াজ, কাঁচা মরিচ, রসুন বাটা, হলুদ,মরিচ লবন ও তেল মেখে নেয়া হয়। সাথে বেগুন ছোট ছোট লম্বা আকৃতির কেটে ধুয়ে মাখিয়ে নেয়া হয় মাছ ও মসলার সাথে। সামান্য পানি দিয়ে ভাজা ভাজা করে পরিবেশন করা হয় গরম গরম ভাতের সাথে।

৮. নাইল্লা পাতা


জামালপুর জেলার খুবই ট্রেডিশনাল একটি খাবার নাইল্লা পাতা ভাজি। শুকনো পাট শাককে মূলত নাইল্লা পাতা বলা হয়। সিজনের সময় পাট শাক সংগ্রহ করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়, যাতে সারাবছর খাওয়া যায়।

পাট শাক ভালোভাবে ধুয়ে কেটে রোদে দিয়ে শুকানো হয়। তারপর বায়ুরোধক পাত্রে ভরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। এভাবে ১ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায়। যে কোনো সময় নামিয়ে হালকা ভিজিয়ে বেশি করে পেয়াজ মরিচ দিয়ে ভাজি করে খাওয়া হয়। জামালপুরের মানুষের খুবই প্রিয় খাবার নাইল্লা পাতা ভাজি। গরম ভাতের সাথে নাইল্লা পাতা ভাজি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।

জামালপুর জেলার আরও কিছু জনপ্রিয় খাবার হলো:

১. ছানার পোলাও
২. বোল্ডা
৩. দমকলস শাক
৪. মোঠা পিঠা
৫. এঁচোড় তরকারি
৬. মালাই চা (ইত্যাদি)

Scroll to Top