চাঁদপুরের বিখ্যাত খাবার

পদ্মা,মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত চাঁদপুর জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বদিকে চাঁদপুর জেলা অবস্থিত।চাঁদপুর জেলা ” ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর “নামে বহুল পরিচিত,কেননা এই জেলায় সবথেকে বেশি ইলিশের প্রজনন হয়।তাছাড়া চাঁদপুরের মানুষ খুবই অতিথি পরায়ন বলে খ্যাত। এই অঞ্চলের স্থানীয় লোকজনের আছে নিজস্ব রন্ধন প্রনালী। চাঁদপুরের বেশ কিছু খাবার বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সুখ্যাতি ছড়িয়েছে।আজকের আয়োজনে চাঁদপুর জেলার জনপ্রিয় খাবার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

১. চাঁদপুরের ইলিশ

চাঁদপুরের ইলিশ এর কথা শোনেনি বাংলাদেশে এমন মানুষ নেই বললেই চলে।শুধু বাংলাদেশেই নয়, চাঁদপুরের ইলিশের সুখ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ ছেড়ে বিদেশেও।প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ইলিশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচুর পরিমান ইলিশ পাওয়া গেলেও চাঁদপুরের ইলিশের স্বাদই আলাদা।জাতীয় মাছ ইলিশ দিয়ে রান্না করা যায় হরেক রকমের খাবার।

ইলিশের বেশ কয়েকটি মজাদার আইটেম এর নাম হলো:

  1.  ইলিশ ভাজা
  2.  ইলিশ ভুনা
  3.  ইলিশের দোপেয়াজা
  4.  ইলিশ পাতুরি
  5.  ইলিশ পোলাও
  6.  ইলিশ খিচুড়ি
  7.  সর্ষে ইলিশ
  8.  ভাপা ইলিশ
  9.  ইলিশ মাছের কোপ্তা কারি ( ইত্যাদি)

এই প্রতিটি খাবারই কিন্তু চাঁদপুরের রন্ধন প্রনালীর সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।

২. কাঁঠাল নিরামিষ

চাঁদপুরের সাধারণ মানুষের একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো কাঁঠাল নিরামিষ যা কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে রান্না করা হয়।কাঁঠাল নিরামিষ বলা হলেও এই রান্নায় করলা বাদে সব ধরনের সবজিই ব্যবহার করা হয়। তবে অনেকে করলাও ব্যবহার করে।সবজির সাথে থাকে শুকনো শিমের বিচি, ছোলার ডাল মুগ ডাল ও মসুর ডাল। খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনই স্বাস্থ্যকর।

প্রস্তুত প্রনালী :

প্রথমে পাতিলে শুকনো শিমের বিচি ও ছোলার ডাল সিদ্ধ দিয়ে তার মধ্যে হলুদ গুড়ো ,মরিচ গুড়ো, লবন,জিরা গুড়া,আদা বাটা,রসুন বাটা ও গরম মসলা দিয়ে দিতে হবে।এরপর পর্যায়ক্রমে সব ডাল ও অন্যান্য সবজি দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হবে।
অন্য একটা কড়াইয়ে সামান্য তেল,পেয়াজ,গরম মসলা,তেজপাতা ভেজে বেটে নিতে হবে ফোঁড়নের ঘ্রাণ আসার জন্য। আবার কড়াইয়ে তেল দিয়ে পেয়াজ,রসুন বাটা,ও বেটে রাখা মসলা দিয়ে ফোঁড়ন দিলেই হয়ে যাবে কাঁঠাল নিরামিষ।

পরিবেশন:
কাঁঠাল নিরামিষ সাধারণত ভাতের সাথে খাওয়া হয়।তাছাড়া রুটি, পরোটা দিয়ে খেতেও বেশ লাগে।

৩.শোল মাছের পাতুরি

চাঁদপুরের মানুষের খুবই প্রিয় আরেকটি খাবার শোল মাছের পাতুরি।এই খাবারের স্বাদ মাংসের স্বাদকেও হার মানাবে।বর্তমানে শুধু চাঁদপুরেই নয়, সারা বাংলাদেশেই কম বেশি এই খাবারটি খাওয়ার প্রচলন আছে। তবে চাঁদপুরের স্থানীয়দের হাতে তৈরি শোল মাছের পাতুরির অথেনটিক স্বাদ আর কোথাও পাওয়া যায় না।

প্রস্তুত প্রনালী :

শোল মাছ ছোট করে কেটে ধুয়ে নিতে হবে। তার মধ্যে পেয়াজ বাটা,রসুন বাটা,সাদা সর্ষে বাটা,কাচা মরিচ বাটা,আস্ত কাচা মরিচ,হলুদ গুড়ো,লবন ও সরিষার তেল দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে।কচি কলাপাতায় মিশ্রনটি দিয়ে ভালোভাবে চারপাশ মুড়ে দিতে হবে।তারপর সেই পাতা সহ মাছ ভাজতে হবে।পাতা পুড়ে যাওয়া পর্যন্ত ভেজে নামিয়ে ফেলতে হবে।

পরিবেশন:
গরম গরম ভাতের সাথে শোল মাছের পাতুরি খেতে সব থেকে বেশি মজা।তাছাড়া খিচুড়ির সাথেও দারুণ জমে যায় এই খাবারটি।

৪.সরিষা ইলিশ পাতুরি

ইলিশের রাজ্যে যাদের বসবাস তাদের আবার ইলিশ নিয়ে কোনো স্পেশাল রেসিপি থাকবে না এ আবার কখনও হয় নাকি।চাঁদপুর বাসীর ইলিশ দিয়ে তৈরি সবথেকে ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো” সর্ষে ইলিশ পাতুরি “।সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ইলিশ পাতুরি খাওয়ার প্রচলন চলে আসছে।অতিথি আপ্যায়নে ইলিশ পাতুরির বিকল্প আর কিছু তারা ভাবতেই পারে না।

প্রস্তুত প্রনালী :

সর্ষে ইলিশ পাতুরি রান্নার পদ্ধতি অনেকটা শোল মাছের পাতুরির মতোই।ইলিশ মাছ কেটে নিয়ে তার মধ্যে সর্ষে বাটা, কাঁচা মরিচ বাটা,নারকেল বাটা,হলুদ গুড়ো,লবন, টক দই দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে নিতে হবে। এরপর কলাপাতায় দিয়ে উপর থেকে আরও একটি কলাপাতা ফেলে চারপাশ সুতো দিয়ে আটকে দিতে হবে। কড়াইয়ে সামান্য তেল দিয়ে ভালোভাবে দুই পাশ ভেজে ফেললেই হয়ে যাবে সুস্বাদু ” সর্ষে ইলিশ পাতুরি “

পরিবেশন:
গরম ভাত,খিচুড়ি, পোলাওয়ের সাথে ইলিশ পাতুরি খাওয়া হয়।

৫.মতলবের ক্ষীর

চাঁদপুরের ইলিশের মতোই একনামে সবাই চেনে চাঁদপুরের মতলবের ক্ষীর। মতলবের ক্ষীর এই জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহক।অনেক আগ থেকেই চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলায় একচেটিয়া ভাবে তৈরি ও বিপনন হচ্ছে সুস্বাদু এই ক্ষীর। এর স্বাদ,গুন ও মানের কারনে ব্রিটিশ শাশনামলে এই অঞ্চলের জমিদার ও ইংরেজদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল মতলবের ক্ষীর। চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলায় উদ্ভাবন হয়েছে বলে জায়গার নামানুসারে এর নামকরণ হয়েছে মতলবের ক্ষীর। আত্মীয় বাড়ি গেলে বা প্রভাবশালী কাউকে খুশি করতে উপহার হিসেবে এক হাড়ি মতলবের ক্ষীরই যথেষ্ট। বর্তমানে চাঁদপুর জেলার নতুন প্রজন্ম অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে বাংলাদেশের সব জেলায় ছড়িয়ে দিচ্ছে মতলবের ক্ষীরের স্বাদ ও মান।

প্রস্তুত প্রনালী :

পুরো উপজেলার গোয়ালা ও ব্যবসায়ীরা সকাল বেলা দুধ নিয়ে চলে আসে মতলব বাজারে।সেখান থেকে ময়রা এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যায় খাটি গরুর দুধ।সেই দুধ জ্বাল করে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় মতলবের ক্ষীর।

পরিবেশন:
মতলবের ক্ষীরের স্বাদ এতোটাই অসাধারণ যে এর সাথে আর কিছু না হলেও চলে।তবে এই অঞ্চলের মানুষের মুড়ি, খৈ,রুটি দিয়ে ক্ষীর খাওয়ার প্রচলন আছে।

৬.ওয়ান মিনিট আইসক্রিম

সম্প্রতি চাঁদপুরে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ওয়ান মিনিট আইসক্রিম। মাত্র এক মিনিটেই তৈরি হয় বলে এর নাম হয়েছে ওয়ান মিনিট আইসক্রিম। একদমই নতুন স্বাদের এই আইসক্রিমের খ্যাতি ছড়িয়ে পরেছে সারা বাংলাদেশে।চাঁদপুর ঘুরতে গেলে সবারই প্লান থাকে ওয়ান মিনিট আইসক্রিম খাওয়ার।প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো মিষ্টির দোকানের স্বত্বাধিকারী বাবার ব্যবসা ধরে রাখতে মিষ্টির পাশাপাশি নতুন সংযোজন করেছেন ব্যাতিক্রম ধর্মী এই ওয়ান মিনিট আইসক্রিম।

প্রাপ্তিস্থান:
নতুন বাজার প্রেসক্লাব রোড,চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর

মূল্য :
প্রতি কাপ আইসক্রিমের দাম মাত্র ৪০ টাকা।

প্রস্তুত প্রনালী :
ব্যাতিক্রম ধর্মী ওয়ান মিনিট আইসক্রিম বানানো হয় বিশেষ এক ধরনের ইলেকট্রিক মেশিনের মাধ্যমে। মেশিনটি ইন্ডিয়া থেকে আনা হয়েছে।অর্ডার করার সাথে সাথে চোখের সামনে এক মিনিটের মধ্যে আইসক্রিম তৈরি করে দেয়া হয়।

পরিবেশন:
মেশিনে তৈরি নরম আইসক্রিম ছোট ছোট কাপে পরিবেশন করা হয়।

৭.আউয়ালের মিষ্টি

চাঁদপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির কথা বললেই প্রথমে মনে আসে আউয়ালের মিষ্টির কথা।১৯৫২ সালে হাজী আবদুল আউয়াল এই দোকানটি চালু করেন এবং সেই থেকে এখনও পর্যন্ত তার মিষ্টির সুখ্যাতি অব্যাহত আছে। বয়োবৃদ্ধ আবদুল আউয়ালের ছেলেরা এখন এই দোকানের দায়িত্ব পালন করছেন।কোনো উৎসব অনুষ্ঠান চাড়াও সব সময়ই এই দোকানে ভীড় পড়ে থাকে।এই মিষ্টির বিশেষত্ব হলো এটি খুবই নরম তুলতুলে হয়।এই মিষ্টির এতোই চাহিদা যে একাথে বেশি কিনতে চাইলে আপনাকে আগেই টাকা এডভান্স করে অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে।

প্রাপ্তিস্থান:
আউয়াল সুইটস,ফরিদগঞ্জ উপজেলা বাজার,চাঁদপুর।

মূল্য :
প্রতি কেজি মিষ্টি ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়।

প্রস্তুত প্রনালী :
আউয়ালের মিষ্টি তাদের নিজস্ব রেসিপিতে তৈরি হয় যা তারা বাইরে শেয়ার করেন না, এমনকি মিষ্টি তৈরির সময় কোনো প্রকার ছবিও তুলতে দেন না।এই রেসিপি তাদের নিজস্ব সম্পদ। আউয়ালের মিষ্টি কোনো প্রকার মেশিনের সাহায্য ছাড়া সরাসরি হাতে তৈরি করা হয়।

পরিবেশন:
দোকানে বসে চাইলে পরোটা দিয়ে মিষ্টি খাওয়া যাবে। বসে খাওয়ার জন্য আছে সুব্যবস্থা। তাছাড়া পার্সেল করে নিয়ে আসতে পারবেন।

ভোজন রসিক বাঙালির এই দেশের প্রতিটা জেলা ই কোনো না কোনো খাবারের জন্য বিখ্যাত। এই খাবার গুলো প্রতিটা অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বহন করে।

Scroll to Top