চলন বিল ভ্রমণ গাইড

বাংলাদেশের সবথেকে বড় ও জনপ্রিয় বিল চলন বিল। প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে চলন বিল তার আসল রূপ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে হাজার হাজার পর্যটকদের। অসংখ্য ছোট বড় বিল, নদী, খাল নিয়ে এই চলনবিল এর অবস্থান। বর্ষার ভরা মৌসুমে সবগুলো বিল, নদী ও খালের দুকুল ছাপিয়ে পানি উঠে একাকার হয়ে যায়। তখন মনে হয় এ যেন এক পানির রাজ্য।

যে দিকেই তাকানো হয় শুধু পানি আর পানি- মাঝে মাঝে ছেট ছোট দ্বীপের মতো ঘরবাড়ি যেন এক ছবির দেশ। সারাদিন পানির রাজ্যে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, সে যেন এক স্বর্গীয় আনন্দ। তবে চলনবিল ভ্রমনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই সঠিক তথ্য জেনে নিয়ে ট্যাুর প্লান করা উচিত। আজকের আয়োজনে জানতে পারবেন চলন বিল ঘুরতে যাওয়ার সঠিক রুট ম্যাপ, থাকার ব্যবস্থা, খাওয়ার ব্যবস্থা ও এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে বিস্তারিত।

চলন বিল ঘুরতে গিয়ে যা যা দেখবেন

চলন বিলের মূল আকর্ষণ হলো নৌকা ভ্রমন। বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর বিলের বিশাল জলরাশিতে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ানোর উদ্যেশ্যেই মূলত পর্যটকেরা এখানে ভিড় জমায়। বিলের পানিতে আছে অনেক প্রজাতির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী। বিলের মাঝখানে ভেসে বেড়ায় সাদা বক ও গাঙচিল। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির বুকে দেখা মিলবে ছোট ছোট গ্রাম ও ঘরবাড়ির।

বিলের বুকে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে শরতের আকাশ দেখার সৌভাগ্য হলে তো কোনো কথাই নেই, সাথে পাবেন সাদা ঘন মেঘের মতো বিস্তৃত কাশফুলের বন। চলনবিলে শীতের সময়ে অসংখ্য অতিথি পাখির দেখা মিলবে। যদিও শীতের সময়ে বিলের পানি কম থাকে তবে, অতিথি পাখির কলকাকলীতে আপনার মন হারিয়ে যাবেই।

হাতে একটু বেশি সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন চলনবিল জাদুঘরে। এখানে চলনবিলে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, মাছ ধরার বিভিন্ন পুরোনো ও আধুনিক সরঞ্জাম দেখতে পারবেন। আরও জানতে পারবেন চলনবিলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে বিস্তারিত।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ানোর এই সুবর্ন সুযোগটা হাতছাড়া করতে না চাইলে অবশ্যই চলনবিল থেকে একবার ঘুরে আসতে পারেন।

tour package goofly24.com

চলন বিল এর অবস্থান ও আয়তন – চলন বিল কোথায় অবস্থিত?

চলনবিল বাংলাদেশের বিল গুলোর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় বিল।সবমিলিয়ে তিনটি জেলাকে সংযুক্ত করে এই বিলের অবস্থান। নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার বিশাল অংশজুড়ে ছড়িয়ে আছে চলনবিল। শীতের সময় যদিও বিলের এক একটি অংশ পানি শূন্যতার কারনে একটি আরেকটির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে ভরা বর্ষায় উপচে পড়া পানিতে সম্পূর্ণ বিলটি নিজের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরে পায়।

পূর্বে চলনবিলের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইল বা ১৪২৪ বর্গ কিলোমিটার। তবে বর্তমানে এর আয়তন কমে গিয়ে হয়েছে ১১৫০ বর্গকিলোমিটার।

সুবিশাল এই বিলটি অসংখ্য ছোট বড় বিলের সমন্বয়ে গঠিত। বেশ কয়েকটি সুপরিচিত বিলের নাম হলো: পিপরূল, সোনাপাতিলা, লারোর, ডাঙাপাড়া, বড়বিল, গজনা, তাজপুর, ঘুঘুদহ, দারিকুশি, শাতাইল, চোনমোহন, মাঝগাঁও, নিয়ালা ইত্যাদি।

চলনবিলের সাথে এসে মিলিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট নদী। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নদী হলো: করতোয়া, আত্রাই, গুড়, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাই। শীতের সময় বিলের পানি শুকিয়ে গেলেও নদীতে তখনও পুরোদমে নৌকা চলে এবং অতিথি পাখির দর্শন পাওয়ার জন্য থাকে পর্যটকদের উপচে পড়া ভীড়।

তিনটি জেলায়ই চলন বিলের অবস্থান হওয়ার যে কোনো সাইড থেকেই চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তবে নাটোর ও সিরাজগঞ্জ থেকে চলনবিলের ভিউ সবথেকে সুন্দর দেখা যায়।

চলনবিল যাওয়ার উপায়

যেহেতু দুটি জেলা থেকেই চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, তাই এখানে যাওয়ার পদ্ধতিও স্থানভেদে আলাদা হবে। প্রথমে ঢাকা টু নাটোর চলনবিল যাওয়ার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে ধারাবাহিক ভাবে ঢাকা থোকে সিরাজগঞ্জ চলনবিল যাওয়ার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

১. ঢাকা টু নাটোর চলনবিল যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে নাটোরের চলনবিল যাওয়ার জন্য রাজশাহী রুটে চলাচলকারী বাসে উঠতে হবে। ঢাকার মহাখালী বাস স্যান্ড থেকে প্রতিদিন এস আই এন্টারপ্রাইজ ও সৌরভ পরিবহন এর বাস রাজশাহীর উদ্যেশে যাত্রা করে।

তাছাড়া ঢাকার গাবতলি স্ট্যান্ড থেকে ইউনিক পরিবহন এর বাস রাজশাহী রুটে চলাচল করে। ঢাকা টু রাজশাহী বাস ভাড়া পরবে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

পছন্দমতো যে কোনো বাসে চেপে রাজশাহীর উদ্যেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে, তবে নেমে পরতে হবে কাছিকাটা নামক স্থানে। এখান থেকে চলনবিল পৌছুতে সবথেকে বেশি সুবিধা হবে। কাছিকাটা থেকে স্থানীয় পরিবহনযোগে চলে যেতে হবে চাচকৈর বাজার। কাছিকাটা থেকে চাচকৈর বাজারের দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার।

চাচকৈর বাজারে হালকা খাওয়া দাওয়া করে সরাসরি চলে যেতে হবে খুবজীপুর গ্রামে। চাচকৈর বাজার থেকে খুবজীপুর গ্রামের দূরত্ব ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার।এই গ্রাম থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী দরদাম করে নৌকা ভাড়া করে সারাদিন চলনবিলে ঘুরতে পারবেন। খুবজীপুর গ্রামে থেকে চলনবিলের সৌন্দর্য সবথেকে ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। বেশিরভাগ পর্যটকই এই রুটে চলনবিলের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন।

train ticket booking

২. ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ চলন বিল যাওয়ার উপায়

সিরাজগঞ্জ চলনবিল যেতে চাইলে সবথেকে সহজ মাধ্যম হবে ট্রেন ভ্রমণ। ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে খুলনা গামী ট্রেন ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেসে’ চেপে সিরাজগঞ্জ যেতে পারবেন। তাছাড়া রাজশাহী গামী ট্রেন ‘সিল্কসিটি এক্সপ্রেস’, ‘পদ্না’ অথবা ‘লালমনি’ ট্রেনে চেপেও পৌছুতে পারবেন। উল্লিখিত প্রতিটি ট্রেনই সানন্দপুর স্টেশনে বিরতি দেয়। চলনবিল যেতে চাইলে অবশ্যই সানন্দপুর স্টেশনে নেমে পড়তে হবে। ট্রেন ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা।

সানন্দপুর স্টেশন থেকে সিরাজগঞ্জ জেলাসদর এর দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। স্থানীয় যাতায়াত মাধ্যম ব্যবহার করে প্রথমে সিরাজগঞ্জ জেলা শদর হয়ে চলনবিল পৌছুতে পারবেন। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারবেন পুরো একটা দিন চলনবিলের বুকে।

থাকার ব্যবস্থা

চলনবিলের আশেপাশে থাকার জন্য কোনো সুব্যবস্থা নেই। নাটোর চলনবিলে গেলে দিনে দিনে ভ্রমন শেষ করেই চলে আসতে হবে নাটোর জেলা সদরে, আর সিরাজগঞ্জ চলনবিলে ঘুরলে সন্ধ্যার মধ্যেই সিরাজগঞ্জ জেলা সদরে চলে আসতে হবে। জেলা সদর গুলোতে থাকার জন্য বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে।

নাটোরে থাকার জন্য –
১. হোটেল ভিআাইপি
২. হোটেল রুখসানা
এসকল হোটেলে প্রতিটি সিঙ্গেল বেডের রুম ভাড়া পড়বে মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। প্রতিটি ডবল বেডের রুম ভাড়া পড়বে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।

সিরাজগঞ্জে থাকার ক্ষেত্রে :
১. হোটেল আল হামরা (স্বাধীনতা স্কোয়ার)
মোবাইলঃ ০১৭৪৫-৬২৯২৬৪
প্রতিটি এসি রুমের ভাড়া পড়বে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা
প্রতিটি নন এসি রুমের ভাড়া পড়বে ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা

২. হোটেল অনিক (শেখ মুজিব রোড)
মোবাইলঃ ০১৭২১-৭১৯২৩৫
প্রতিটি এসি রুমের ভাড়া পড়বে ৪৫০ থেকে ৭০০ টাকা।
প্রতিটি নন এসি রুমের ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

খাওয়ার ব্যবস্থা 

চাচকৈর বাজারে খুব সাধারণ মানের কিছু হোটেল পাবেন।তবে এসব হোটেলে বিলের ধরা তরতাজা মাছের স্বাদ একবার হলেও ট্রাই করা উচিত। তাছাড়া নৌকায়ও ছোটখাটো বনভোজনের চমৎকার আয়োজন করে নিতে পারবেন। বিলের মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামের বাজার গুলোতে পাওয়া যাবে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। নৌকায় বসে মাছ কিনে রান্না করে খাওয়ার বেশ চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা তো নিজের ঝুলিতে পুরে নেয়াই যেতে পারে।

সিরাজগঞ্জ সদরে এবং নাটোর সদরে আছে বেশ ভালো মানের বেশ কিছু হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট।সারাদিনের ভ্রমন শেষে এসব হোটেলে এসেও ভূরিভোজ সেরে ফেলতে পারেন। তাছাড়া আবাসিক হোটেল গুলোতেও খাবারের সুব্যবস্থা পাবেন।

মনে রাখবেন:
সাতার না জানা থাকলে অবশ্যই সাথে লাইফ জ্যাকেট রাখবেন।
পুরো একদিনের ট্যুর প্লান করলে নৌকায় ওঠার আগে প্রয়োজনীয় খাবার ও মিনারেল ওয়াটার সাথে নিয়ে নিবেন।

নৌকা ভাড়া করার সময় অবশ্যই দরদাম করে নিবেন। প্রয়োজনে বেশ কয়েকটি নৌকায় কথা বলে সুবিধামতো নৌকাটি বাছাই করে নিবেন।
এবং অবশ্যই সময় হিসাব করে ভাড়ার চুক্তি করবেন।

Scroll to Top