ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেসে চর কুকরি মুকরি অবস্থিত। চর কুকরি মুকরি শুধু একটি দ্বীপই নয় এখানে আছে চমৎকার ম্যানগ্রোভ বন ও সমুদ্রের বীচ।
একই দ্বীপে ম্যানগ্রোভ বন ভ্রমনের অভিজ্ঞতা, সমুদ্রের বীচে হাটার অভজ্ঞতা এবং সেই সাথে সমতল ভূমি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ ভ্রমনের অভিজ্ঞতা একসাথে অর্জন করতে চাইলে অবশ্যই যেতে হবে চর কুকরি মুকরি।
চর কুকরি মুকরির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতোটাই মনোমুগ্ধকর যে একে অনেকে স্বপ্নের দ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। হাজারো গাছগাছালি, বণ্যপ্রাণী, অতিথি পাখির জীবনধারা যেন একসাথে এসে মিশেছে এই দ্বীপে এসে।
চর কুকরি মুকরি দ্বীপে কী কী আছে?
১৯৮৯ সালের ১৪ মে বন বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চর কুকরি মুকরিতে প্রচুর পরিমানে শ্বাসমূলীয় গাছের চারা রোপন করা হয়েছিল। এই গাছগুলোই পরবর্তীতে ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি করেছে। তাই এই দ্বীপে ম্যানগ্রোভ বনে ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার অভিজ্ঞতা হবে। এছাড়াও পরবর্তীতে অনেক সুন্দরী, গেওয়া, পশুর প্রভৃতি প্রজাতির উদ্ভিদ জন্মায় এখানে।
আরও আছে প্রচুর পরিমান নারকেল, বাঁশ, তাল, সুপারি গাছের চমৎকার বাগান। মানবসৃষ্ট এই ম্যানগ্রোভ বনটি অসংখ্য বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। এই বনে দেখতে পাওয়া যায় চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বন্য মহিষ, বন্য গরু, বন-বিড়াল, বন মোরগ সহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অবাধ বিচরণ। শীতকালে চর কুকরি মুকরি দ্বীপের রূপ যেন একেবারেই বদলে যায়।
এই দ্বীপে সূদূর সাইবেরিয়া থেকে ছুটে আসে হাজার হাজার অতিথি পাখির দল। পুরো দ্বীপ জুড়ে চলে অতিথি পাখির গানের সুরের কলতান। সে যেন এক মায়ায় ঘেরা ভূবণ। চর কুকরি মুকরি দ্বীপের সবথেকে বড় আকর্ষণ হলো সাগরপাড় যেটি স্থানীয়দের কাছে বালুর ধুম নামে পরিচিত।
এটি একটি পরিচ্ছন্ন ও অসম্ভব সুন্দর সি বীচ। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যখন তীরে এসে আছড়ে পড়ে তখন কুয়াকাটা বা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বসে থাকার মতো অনুভূতি হয়। তাছাড়াও এখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দারুণ দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
চর কুকরি মুকরি দ্বীপের মাঝখান দিয়ে একটি খাল বয়ে গেছে যার নাম ভাড়ানি খাল। খালটি মেঘনা নদী থেকে সৃষ্টি হয়ে দ্বীপের মাঝখান থেকে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।
জানা গেছে কোনো এক সময় এই দ্বীপে শুধু কুকুর আর ইঁদুর ছাড়া আর তেমন কোনো প্রাণীর চিহ্ন ছিল না। স্থানীয়দের কাছে এই প্রাণীগুলো মেকুর নামে পরিচিত। সেই থেকেই এই দ্বীপের নাম হয়েছে চর কুকরি মুকরি।
চর কুকরি মুকরি দ্বীপে ঘুরতে গিয়ে কী কী করবেন?
চর কুকরি মুকরি দ্বীপে উপভোগের সবথেকে আকর্ষণীয় দিক হলো এর সমুদ্র সৈকত। সাগরের ঢেউ এসে যখন ভাসিয়ে নিয়ে যায় দ্বীপের কিনারা তখন বিশাল এক সমুদ্র সৈকতে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার অনুভূতি হয়। পরিচ্ছন্ন এই বীচের স্বচ্ছ পানিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে হুটোপুটি করার আনন্দ আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন ম্যানগ্রোভ বনের গভীরে এবং সেই সাথে দেখতে পারবেন চমৎকার সব বন্য প্রাণী। বুনো গাছগাছালি ও বন্য প্রাণীর জগৎ থেকে একদিন ঘুরে আসলে বেশ হয়।
চর কুকরি মুকরি দ্বীপ ভ্রমনের আরও একটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো ক্যাম্পিং। বন্ধু বান্ধবের সাথে তাবু খাটিয়ে তাবুর পাশে আগুন জ্বালিয়ে বারবিকিউ পার্টি করার আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন এই দ্বীপে এসে। ক্যাম্পিং এর মাধ্যমে দ্বীপে রাত কোথায় কাটাবেন এই ভাবনা থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে।
শীতের সময় গেলে উপভোগ করতে পারবেন হাজারো অতিথি পাখির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ও মন মাতানো কলকাকলি।মোটকথা অবকাশের দিনগুলোতে একদমই স্বপ্নের ভুবনের মতো একটি জায়গায় কাটাতে পারবেন চর কুকরি মুকরি দ্বীপ ভ্রমণের মাধ্যমে।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়:
চর কুকরি মুকরি দ্বীপে ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। এ সময়ে গেলে প্রচুর অতিথি পাখির দেখা মিলবে এবং চরের পানি নেমে গিয়ে সুন্দর বালুকাময় তীর জেগে উঠবে। শুধুমাত্র শীতকালেই এই দ্বীপে ক্যাম্পিং করা যায়। তাই শীতের সময় ট্যুর প্লান করাই ভালো। বর্ষায় চরের বেশিরভাগ অঞ্চলই পানির নিচে ডুবন্ত অবস্থায় থাকে এবং নদী ও সমুদ্র বেশ উত্তাল থাকে বিধায় ঝুঁকিও বেশি থাকে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চর কুকরি মুকরি যাওয়ার উপযুক্ত সময়।
চর কুকরি মুকরি যাওয়ার উপায় :
চর কুকরি মুকরি যাওয়ার বেশ কয়েকটি পদ্ধতি থাকলেও সবথেকে সহজ পদ্ধতি হলো সরাসরি ভোলার চরফ্যাশনের বেতুয়া হয়ে চর কুকরি মুকরি যাওয়া।আর অবশ্যই নদীপথে যেতে হবে। ঢাকার সদরঘাট থেকে চরফ্যাশনের বেতুয়াগামী লঞ্চ পাওয়া যায়। ঢাকা টু বেতুয়া রুটে কর্ণফুলী, টিপু, তাসরিফ সহ আরও বেশ কয়েকটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে।
এই রুটের প্রতিটি লঞ্চই সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৮ টার মধ্যে ঢাকার সদরঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে এবং সকাল ৬ টা থেকে ৭ টার মধ্যে চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাটে গিয়ে পৌঁছায়। লঞ্চের ডেক ভাড়া সাধারণত ২০০ থেকে ২৫০ টাকা হয়ে থাকে। সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ১০০০ টাকা এবং ডবল কেবিন ভাড়া ১৮০০ টাকা। লঞ্চ গুলোর মধ্যে কর্ণফুলী লঞ্চের বেশিরভাগ কেবিনেই এসি সার্ভিস চালু আছে।
সকালে বেতুয়া ঘাট পৌঁছে সেখান থেকে অটো বা মোটর সাইকেলে চেপে চলে যেতে হবে চরফ্যাশন সদরে। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৪০ থেকে ৮০ টাকা এবং সময় লাগবে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। চরফ্যাশন সদর আইচা যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। ৫০ টাকা ভাড়ায় চরফ্যাশন থেকে দক্ষিণ আইচা চলে যেতে হবে। সময় লাগবে এক থেকে দেড় ঘন্টা।
দক্ষিণ আইচা নেমে সেখান থেকে অটো নিয়ে চলে যেতে হবে চর কচ্ছপিয়া ঘাটে।অটো ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা। চর কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ট্রলার বা স্পিডবোট রিজার্ভ করে তেঁতুলিয়া নদী পাড়ি দিয়ে চলে যেতে পারবেন চর কুকরি মুকরি দ্বীপে। রিজার্ভ ট্রলারে ভাড়া পড়বে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। স্পিডবোটে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১৫০ টাকা।
চর কচ্ছপিয়া থেকে সকাল ৯ টা এবং দুপুর ১২ টায় লোকাল ট্রলার চর কুকরি মুকরি দ্বীপে যায়। এই ট্রলার সময় মতো ধরতে পারলে খরচ অনেকটা কম হবে। চর কুকরি মুকরি থেকে আবার দুপুর তিনটায় লোকাল ট্রলার চর কচ্ছপিয়ার উদ্যেশ্যে ছেড়ে আসে।
চর কুকরি মুকরি দ্বীপে থাকার ব্যবস্থা
এই দ্বীপে থাকার সবথেকে ভালে ব্যবস্থা আছে এখানকার রেস্ট হাউজে। রেস্ট হাউজের প্রতিটি রুমের ভাড়া ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা। এখানে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা রয়েছে, যেমন: এসি সার্ভিস, টেনিস কোট, সুইমিং পুল, সোলার এনার্জি ইত্যাদি। রেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার হানিফ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। হানিফ ভাইয়ের মোবাইল নম্বর: ০১৭৩৯-৯০৮০১৩
তাছারা একটি সাইক্লোন সেন্টার এবং কিছু এনজিও অফিস আছে, যেখানে অনুমতি নিয়ে থাকার সুযোগ পাবেন।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা তার সেক্রেটারির সাথে যোগাযোগ করলেও থাকার জন্য সুবিধাজনক অবস্থা করে দেবে।
বর্তমানে চর কুকরি মুকরি অঞ্চলের মহিলারা হোম স্টে সার্ভিস দিয়ে থাকে, এখানে থাকা খাওয়ার বেশ সুবিধাজনক সুযোগ হবে।
খাওয়ার ব্যবস্থা
চর কুকরি মুকরি দ্বীপে দুইটি খাবার হোটেল আছে।একটি নিমাই হোটেল এবং আরেকটি মিজান ভাইয়ের হোটেল। আগে থেকে অর্ডার করে রাখলে বেশ ভালো মানের খাবার পাবেন এখানে৷ তাছাড়া রেস্ট হাউজে থাকলে সেখানেও খাবারের ব্যবস্থা হবে। ক্যাম্পিং এর সময় চাইলে নিজেরাও রান্না করে খেতে পারবেন।এই দ্বীপে রান্নার জন্য প্রচুর শুকনো লাকড়ি পাবেন।
সতর্কতা:
বন্য প্রাণীর ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
দ্বীপে বিদ্যুৎ সুবিধা নেই তাই সাথে পর্যাপ্ত পাওয়ার ব্যাংক রাখতে হবে।
গ্রামীণ ফোন ও রবি সিমের নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায়, তাই এই অপারেটর এর সিমকার্ড সাথে রাখুন।
সব সময় দলের সাথে থাকবেন, দলচ্যুত হলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ছবিঃShariful Islam Apu