ভোজনরসিক বাঙালির রসনা বিলাসে খাবারের স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন মুখরোচক উপাদান। তেমনই একটি মুখরোচক উপাদান হলে ঘি। খাবারকে সুস্বাদু করতে ঘি ব্যবহারের প্রচলন প্রাচীন রাজা বাদশাহ দের আমল থেকেই চলে আসছে।
ঘি একটি দুগ্ধ জাত মুখরোচক খাদ্য যা অন্যান্য খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তুলতে ব্যবহার করা হয়। বিরিয়ানি থেকে শুরু করে খিচুড়ি, পোলাও কিংবা শুধু এক প্লেট গরম ভাতের সাথে ঘি থাকলে দারুণ জমে যায়। শুধু যে স্বাদের দিক থেকেই এর কদর রয়েছে এমনটা কিন্তু না।
পুষ্টি গুনেও ভরপুর ঘি এর প্রতিটি ফোটা। স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এই দুগ্ধ জাত খাবারটি পছন্দ করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভাড়। চলুন জেনে নেয়া যাক বিভিন্ন ধরনের ঘি সম্পর্কে বিস্তারিত, আরও জানতে পারবেন ঘি খাওয়ার উপকারিতা ও খাটি ঘি কীভাবে চিনবেন তার উপায়।
ঘি এর প্রকারভেদ
খাটি গরুর দুধ থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে এর স্নেহ পদার্থ আলাদা করে ঘি প্রস্তুত করা হয়, এটা কমবেশি সবাই জানি। তবে দুধ থেকে ঘি উত্তোলনের আলাদা আলাদা পদ্ধতি আছে। ঘি তৈরির পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে একে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই দুই শ্রেনীর ঘি এর সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। একটি হলো সরের ঘি এবং অন্যটি হলো বাটার ঘি। পুষ্টিমানের দিক থেকে সরের ঘি আর বাটার ঘি এর মধ্যে খুব বেশি তফাত না থাকলেও এর প্রস্তুত প্রনালী ও গঠনগত দিক থেকে বৈচিত্র্য রয়েছে।
১. সরের ঘি
সরের ঘি তৈরি করা হয় প্রাচীন গ্রাম বাংলার অথেনটিক পদ্ধতিতে। গরুর খাটি দুধ সংগ্রহ করে জ্বাল করতে করতে যখন ঘন হয়ে আসে তখন হাঁড়ি সহ রেখে দেয়া হয় ঠান্ডা হওয়ার জন্য। ঠান্ডা হওয়ার পর দুধের ওপর একটা মোটা সর পড়ে। এই সর উপর থেকে তুলে নেয়া হয়।
একই পদ্ধতিতে কয়েকবার দুধ জ্বাল করে সর তোলা হয়, যতক্ষণ না এটা একদম পাতলা সরে পরিনত হয়। এভাবে সর জমিয়ে রেখে, সেই সর জ্বাল করে দুধের স্নেহ পদার্থ আলাদা করা হয়। এই আলাদা করা স্নেহ পদার্থটিই মূলত সরের ঘি। এই ঘি এর স্বাদ হয় একদমই অথেনটিক এবং ঘ্রানও হয় খুব কড়া। সরের ঘি তোলা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং এটির উৎপাদন অনেক কম হয়, তাই তুলনামূলক দামটাও একটু বেশি হয়।
সরের ঘি এর বৈশিষ্ট্য

জমাট বাঁধা অবস্থায় সরের ঘি কিছুটা দানাদার থাকে। এর রঙ হয় হলুদ থেকে সেনালি বর্নের। এই ঘি এর স্বাদ অন্যান্য ঘি এর তুলনায় একটু বেশিই তীক্ষ্ণ এবং ঘ্রানও বেশ কড়া৷ খাঁটি সরের ঘি দিয়ে বিভিন্ন ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার তৈরি করা হয়, খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তুলতে রান্নার শেষে খাবারের ওপরে এই ঘি ছড়িয়ে দেয়া হয়। তাছাড়া গরম ভাতের সাথে খাঁটি সরের ঘি খাওয়ার প্রচলন অনেক আগে থেকেই। তবে সরের ঘি এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর রঙ, স্বাদ এবং গন্ধ।
খাঁটি সটের ঘি এর দাম
উৎপাদক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভেদে এক কেজি খাঁটি সরের ঘি এর দাম ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা বা তার বেশিও হতে পারে। তবে খুব সস্তা মানের ঘি কিনতে গেলে তাতে ভ্যাজাল থাকার সম্ভাবনা বেশি।
২. বাটার ঘি
তৈরির পদ্ধতি এবং বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সরের ঘি ও বাটার ঘি এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বাটার ঘি তৈরি করা হয় সরাসরি দুধ থেকে উত্তোলিত ক্রিম ব্যবহার করে। গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে মেশিনের সাহায্যে ক্রিম উত্তোলন করা হয়। সেই ক্রিমকে জ্বাল করে ক্রিম থেকে দুধের স্নেহ পদার্থ আলাদা করে বাটার ঘি তৈরি করা হয়। বাটার উত্তোলনের পড় উচ্চ তাপমাত্রায় সেটা জ্বাল করা হয়।
- ঘি অর্ডার করুন আমাদের শপেঃ দেশীয় বাজার
এতে করে বাটারের তেল টা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে আসে আর প্রোটিনগুলো হাঁড়ির নিচে জমা হতে থাকে। উপরে ভেসে ওঠা তরল স্বেহ পদার্থ আলাদা করে ঢেলে নেয়া হয়। এটাই মূলত খাঁটি বাটার ঘি। খাঁটি বাটার ঘি খুব সহযেই উত্তোলন করা যায় এবং এটি একসাথে অনেক উৎপাদন করা যায়, তাই কমবেশি সবাই এখন বাটার ঘি ব্যবহার করে। কারণ সরের ঘি এর তুলনায় বাটার ঘি এর দাম কিছুটা কম।
বাটার ঘি এর বৈশিষ্ট্য
বাটার ঘি সরের ঘি এর মতো হালকা দানাদার হয় না, বরং এটি তুলনামূলক একটু বড় দানা যুক্ত থাকে। বাটার ঘি এর রং সরের ঘি এর তুলনায় হালকা হয়। এটি সাধারনত সাদা থেকে হালকা হলুদ রঙের হয়। বাটার ঘি এর ঘ্রাণ খুব বেশি কড়া হয় না এবং স্বাদও তুলনামূলক কম বলা চলে।
সাধারণত মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরিতে বাটার ঘি ব্যবহার করা হয়। তবে অন্যান্য খাবারের সরের ঘি এর বদলে বাটার ঘি ব্যবহার করা যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখন বাটার ঘি-ই ব্যবহার করা হচ্ছে।
খাঁটি বাটার ঘি এর দাম
উৎপাদক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ভেদে এক কেজি বাটার ঘি এর দাম এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকা বা তার বেশিও হতে পারে।
খাঁটি ঘি চেনার উপায়
সরের ঘি হোক কিংবা বাটার ঘি, বর্তমানে সব ধরনের ঘি এর সাথেই মেশানো হয় ডালডা ও চর্বি জাতীয় পদার্থ। সুগন্ধের জন্য ডালডার সাথে সামান্য পরিমান ঘি মিশিয়ে সেটা বাজারজাত করা হয়। কিন্তু নকল ঘি এর সুগন্ধ খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। যার ফলে খাবারের স্বাদ বা গন্ধ কিছুই আশানুরূপ পাওয়া যায় না। পাশাপাশি নকল ঘি খাওয়ার ফলে শারিরীক ক্ষতি তো হচ্ছেই। তাই জেনে নেয়া দরকার আসল ঘি চেনার কিছু সহজ কৌশল।
১. দ্রুত গলে যাবে
একটি কড়াইয়ে এক চামচ ঘি দিয়ে লক্ষ করুন ঘি সাথে সাথে গলে যাচ্ছে কিনা। যদি দেখা যায় ঘি সাথে সাথে তরলে পরিনত হয়েছে তবে বুঝতে হবে এটা খাঁটি ঘি। তরলে পরিনত হওয়ার সাথে সাথে এটি বাদামী বর্ণ ধারন করবে। অপরদিকে ডালডা বা চর্বি মিশ্রিত থাকলে এটি জমাট বেঁধে থাকবে এবং আস্তে আস্তে সময় নিয়ে গলবে। গলিত অবস্থায় এটি বাদামী না হয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করবে।
২. হাতের তালু পরীক্ষা
হাতের তালুতে ঘি নিয়ে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। যদি দেখা যায় ঘি গলে গেছে তাহলে বুঝতে হবে এটি খাঁটি ঘি। কারণ খাটি ঘি এর গলনাঙ্ক এতোটাই বেশি যে এটা শরীরের তাপমাত্রায় গলতে শুরু করে। যদি দেখা যায় শরীরের সংস্পর্শে এসেও ঘি গলছে না তবে বুঝতে হবে এটি খাঁটি ঘি না।
৩. ঘ্রান
হাতের তালুতে ঘি নিয়ে খুব জোরে জোরে কিছুক্ষণ ঘসতে থাকুন। এরপর হাতের তালুর গন্ধ শুকে যদি দেখতে পান এখনও ঘি এর তীব্র গন্ধ আছে, তবে বুঝতে হবে এটি খাঁটি ঘি। কেননা খাঁটি ঘি এর সুঘ্রাণ খুব সহযে মিলিয়ে যায় না।
৪. লেয়ার পরীক্ষা
ঘি এর মধ্যে যদি অন্য কোনো উপাদান মিশ্রিত থাকে তাহলে ঘি গলানোর পরে আবার জমাট বাধলে তা দুইটি লেয়ারে পরিনত হয়। একটি লেয়ার হবে খাটি ঘি এর এবং অন্যটি হবে ঘি এর সাথে মিশ্রিত অতিরিক্ত পদার্থের। লেয়ার পরিক্ষা করার জন্য একটি কাচের বয়ামে ঘি নিয়ে পাতিলে গরম পানি করে তার মধ্যে বসিয়ে দিন। গরম পানির সংস্পর্শে এসে ঘি গলে গেলে তা ফ্রিজে রেখে দিন। ঘি জমাট বাধলে যদি আলাদা রঙের দুইটি লেয়ার দেখতে পাওয়া যায় তবে বুঝতে হবে এটি খাঁটি ঘি নয়। খাঁটি ঘি হলে শুধুমাত্র একই রঙের একটি লেয়ার পড়বে।
৫. একটি স্বচ্ছ প্লাস্টিক বা কাচের বোতলে সামান্য পরিমান ঘি গলিয়ে নিন। তার মধ্যে একটু চিনি দিয়ে খুব জোরে জোরে ঝাঁকাতে হবে৷ তারপর বোতলটি স্থির করে পাঁচ মিনিট রাখার পর যদি দেখা যায় এর নিচে লাল রঙের আস্তরণ পড়েছে তবে বুঝতে হবে এটি খাঁটি ঘি নয়।
৬. আরেকটি পদ্ধতি হলো আয়োডিন টেস্ট। এই টেস্ট এর মাধ্যমে নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায় ঘি পুরোপুরি খাঁটি কিনা। একটি পাত্রে ঘি গলিয়ে তার মধ্যে দুই ফোঁটা আয়োডিন সলিউশন মিশিয়ে নিতে হবে। আয়োডিন যদি বেগুনি বর্ণ ধারণ করে তাহলে বুঝতে হবে ঘি খাঁটি নয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ঘি আসল না নকল তা চেনার পরীক্ষা গুলো আমরা নিজেরা টেস্ট করিনি তাই এগুলোর শতভাগ গ্যারান্টি আমরা দিতে পারছি না।
তাছাড়া নকল পণ্য তৈরিকারকরা বিভিন্ন সময়ে তাদের পদ্ধতি পরিবর্তন করে নতুন নতুন পদ্ধতিতে ভেজাল পণ্য বিক্রি করে এজন্য আপনার উচিৎ হবে ট্রাস্টেড কোন সেলারের কাছ থেকে এসব পণ্য কেনা।
নিয়মিত ঘি খাওয়ার উপকারিতা
সরের ঘি হোক কিংবা বাটার ঘি, নিয়মিত খাবারের সাথে ঘি ব্যবহার করলে এটি হবে স্বাস্থ্য উপকারী। অনেকেই মনে করেন ঘি যেহেতু একটি ফ্যাট জাতীয় খাবার তাই এতে হয়তো শারিরীক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এই ধারনা পুরোপুরি ভুল। ঘি-এ আছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। পাশাপাশি নিয়মিত ঘি খেলে বিভিন্ন রোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চলুন জেনে নেয়া যাক ঘি খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত।
১. নিয়মিত ঘি খেলে আমাদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি কয়েকগুণ পর্যন্ত কমে যায়। এতে থাকা মনোস্যাচুরেট ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট হার্টের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে ফলে হার্টের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমতে থাকে।
২. নিয়মিত ঘি খেলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই বিশেষ করে বাড়ন্ত বাচ্চাদের খাবারে ঘি এড করা দরকার। ঘি এ থাকা ভিটামিন এ, বি এবং ভিটামিন কে ব্রেইন এর বিকাশে সহায়তা করা। ফলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়, বুদ্ধির বিকাশ ঘটে।
৩. ত্বক এবং চুলের ময়েশ্চারাইজিং এর জন্য ঘি একটি উপকারী খাদ্য উপাদান। ঘি এ থাকা ভিটামিন এ, বি এবং কে চুল এবং ত্বকের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে এবং ত্বক ও চুলকে মোলায়েম করে।
৪. ঘি- তে থাকা ভিটামিন এ চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। এটি চোখের রেটিনার সুষ্ঠু গঠন নিশ্চিত করে ও সুস্থ রাখে।
৫. যারা ডায়েট করছেন তাদের জন্য ঘি হতে পারে একটি আদর্শ খাদ্য উপাদান। কেননা ঘি তে থাকা এসেনশিয়াল ফ্যাট শরীরের ক্ষতিকর ফ্যাট কাটতে সহায়তা করে। তাই যাদের ভুল ধারনা আছে যে ঘি খেলে শরীরের ফ্যাট বৃদ্ধি পায় তারা নিশ্চিন্তে ডায়েট চার্টে ঘি রাখতে পারেন।
৬. ঘি রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল কমায় ফলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কম থাকে। তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তারা নিয়মিত ঘি খেলে এই রোগের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে।
৭. নিয়মিত ঘি খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। ঘি তে থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার সহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ করার জন্য শরীরকে কর্মক্ষম করে তোলে।
৮. ঘি আমাদের শরিরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে কাজ করার শক্তি জোগায়। পাশাপাশি এতে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও এন্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেহকে সুস্থ রাখে।
সুষম খাদ্য তালিকায় ঘি একটি উপযুক্ত খাবার। নিয়মিত খাদ্য তালিকায় কমপক্ষে এক চামচ ঘি থাকলে আমরা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও নিশ্চিত থাকতে পারি। আর সবথেকে বড় কথা হলো ঘি আমাদের শরীরের স্নেহ পদার্থের জোগান দেয় তাও আবার শরীরের কোনো ক্ষতি না করেই।
তবে ভেজাল যুক্ত ঘি খেলে উপকারের বদলে ক্ষতিই বেশি হবে। তাই দাম একটু বেশি নিলেও এটা নিশ্চিত করুন যে আপনার সংগ্রহে থাকা ঘি আসল কি না। আশাকরি আসল ও নকল ঘি এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে এখন আর কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে না। আসল খাবার বাছাই করুন, সুস্থ থাকুন।