বন,পাহাড়, ঝর্না ও সমুদ্রের এক অনন্য সৌন্দর্য নিয়ে স্ব গর্বে বিদ্যমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলা। তাবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড অঞ্চলটি এই জেলার সবথেকে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা। জনপ্রিয় এই পর্যটন এলাকায় অবস্থিত গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত যা অন্যান্য সমুদ্র সৈকত থেকে একদমই আলাদা।
যদিও এখনও পর্যন্ত গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতকে সরকারি ভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি তবুও হাজার হাজার পর্যটক এই বীচের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাতছানিতে ধরা দিতে বার বার ছুটে আসে এখানে। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক ছাত্র এই বীচে ঘুরতে গিয়ে সেখানকার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়।
তার পর থেকেই পর্যটকদের আনাগোনা ঘটতে থাকে এই সমুদ্র সৈকতে। বর্তমানে চট্টগ্রামের পর্যটন কেন্দ্র গুলোর মধ্যে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত বেশ জনপ্রিয়।চলুন জেনে নেয়া যাক গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যাওয়ার উপায়, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত কেন যাবেন?
সমুদ্র সৈকত ভ্রমনের সাথে সাথে ম্যানগ্রোভ বনে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা একসাথে উপভোগ করতে চাইলে যেতে হবে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে। একপাশে সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ আর ঠিক উল্টো পাশেই গাছগাছালিতে ভরা গভীর জঙ্গল। বনের গাছগুলো চলে এসেছে একদম সমুদ্রের কাছাকাছি।
সাধারনত সমুদ্র সৈকতের তীর হয় বালুকাময় তবে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের পুরো বীচটি সবুজ ঘাসের গালিচার মোড়ানো। এই বীচটি সম্পর্কে এখনও অনেকেই ভালোভাবে জানে না বিধায় লোকসমাগম তুলনামূলক অনেক কম ফলে একটি সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশে অবসর সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়া যাবে৷ গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে শীতের সময় ক্যাম্পিং করতে বেশ ভালো লাগবে৷ জনকোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বন্ধু বান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের সাথে চমৎকার একটি ক্যাম্পিং এর আয়োজন করলে মন্দ হয় না।
সমুদ্র থেকে বীচ পাড় হয়ে বনের ভেতর চলে গেছে অসংখ্য খাল। এই খাল বর্ষার সময় পানিতে টইটুম্বুর থাকে যেন দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। খালের কিনারার লবনাক্ত পানির উদ্ভিদ এর শ্বাসমূল দেখতে পাওয়া যায়। ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে খালের পথ ধরে বনের চমৎকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
সমুদ্রের বুকে নৌকায় ঘুরতে চাইলে ভাড়া করতে হবে জেলে নৌকা জেলে নৌকায় সারাদিন সমুদ্রের বুকে ঘুড়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সত্যিই খুব রোমাঞ্চকর। আরও উপভোগ করতে পারবেন চমৎকার সূর্যোদয় এবং সুর্যাস্তের দৃশ্য। সেই সাথে সমুদ্রের বীচে পানির মধ্যে হুটোপুটি ও গোসল করার মতো এডভেঞ্চার এর সুযোগ তো রয়েছেই৷ সব মিলিয়ে দারুণ একটা ছুটির দিন কাটিয়ে আসতে পারবেন গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত থেকে।

গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত যাওয়ার উপায়
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত যাওয়ার জন্য প্রথমেই চলে যেতে হবে সীতাকুণ্ড। সরাসরি ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ড যাওয়া যায় আবার অন্যান্য জেলা থেকে প্রথমে চট্টগ্রাম হয়ে তারপর সীতাকুণ্ড যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ড যাওয়ার দুইটি পদ্ধতি আছে। একটি রেলপথ আরেকটি সড়কপথ। ঢাকা থেকে রেলপথে ও সড়কপথে সীতাকুণ্ড যাওয়ার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
সড়কপথ: ঢাকা থেকে সড়কপথে সীতাকুণ্ড যেতে চাইলে আপনাকে ঢাকা টু চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী বাস ধরতে হবে। ঢাকা টু চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী নন এসি বাস এর মধ্যে জনপ্রিয় হলো: এস আলম, শ্যামলী, ইউনিক, সৌদিয়া, হানিফ, ঈগল, এনা ইত্যাদি। নন এসি বাস সার্ভিস এর ভাড়া পড়বে ৪২০ টাকা থেকে ৪৮০ টাকা।
এসি বাস সার্ভিস এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : গ্রীণলাইন, সৌদিয়া, এনা, টি আর ট্রাভেলস ইত্যাদি। এসি সার্ভিস এর ভাড়া পড়বে ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা। এসকল বাসগুলো ঢাকার সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ফকিরাপুল, মহাখালী থেকে নিয়মিত চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করে। বাসের কনট্রাকটর কে বলে রাখলে সীতাকুণ্ড বাস স্ট্যান্ডে আপনাকে নামিয়ে দেবে।
রেলপথ: ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে মেইল ট্রেন ধরতে পারলে সরাসরি সীতাকুণ্ড চলে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১২০ টাকা
তাছাড়া কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে চেপে ফেনী হয়ে সীতাকুণ্ড পৌঁছাতে পারবেন। ফেনী স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে লোকাল বাসে সীতাকুণ্ড যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ট্রেন ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২২০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। ফেনী স্টেশন থেকে সীতাকুণ্ড যাওয়ার লোকাল বাস পাওয়া যায়। এই বাসে চেপে জনপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা ভাড়ায় চলে যেতে পারবেন সীতাকুণ্ড।
চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড
চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ডের দূরত্ব ৪১ কিলোমিটার। লোকাল বাস, সিএনজি বা অটোরিকশায় করে চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড যেতে পারবেন। চট্টগ্রামের অলংকার মোড়, এ কে খান মোড় অথবা কদমতলী থেকে নিয়মিত লোকাল বাস সীতাকুণ্ডের উদ্যেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে ৪০ থেকে ৮০ টাকা। অথবা একটু আরামে যেতে চাইলে সিএনজি বা অটোরিক্সা রিজার্ভ করে সরাসরি সীতাকুণ্ড বাজারে চলে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে রিজার্ভ ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
সীতাকুণ্ড থেকে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত যাওয়ার উপায় –
সীতাকুণ্ড থেকে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। সীতাকুণ্ড বাজারে এসে বাসস্ট্যান্ড ব্রীজের নিচ থেকে সিএনজি বা অটোরিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবেন গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে। লোকাল অটো বা সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা। গাড়ি রিজার্ভ করে গেলে ভাড়া নেবে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। তবে গাড়ি একদম সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত যেতে পারবে না।
গুলিয়াখালী ব্রিজের বাঁধ পর্যন্ত গিয়ে নেমে পড়তে হবে। বাকিটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। এবং পুরোটা পথই কাদায় মাখামাখি। কিছু কিছু পথ পাড়ি দেয়ার সময় হাঁটু পর্যন্ত কাদার নিচে চলে যেতে পারে। এভাবে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই দেখা মিলবে অসাধারণ সৌন্দর্যে ভরপুর গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের। সৈকতের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য দেখলে পুরো পথের কষ্টটা মুহুর্তের মধ্যে দূরে চলে যাবে। তবে ভরা বর্ষার সময়ে ঘুরতে গেলে এই কর্দমাক্ত অংশটুকুতে পানি টইটুম্বুর করবে।
তখন এই পথে হেঁটে যেতে পারবেন না।ছোট ছোট নৌকা ভাড়া করে খাল পাড়ি দিয়ে পৌছে যেতে পারবেন সমুদ্র সৈকতে। অনেক সময় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে বাঁধের কাছে কোনো অটো বা সিএনজি পাওয়া যায় না, তাই আসার সময় আপ ডাউন এর চুক্তি করে গাড়ি ভারা করলে এবং ড্রাইভারের মোবাইল নম্বর নিয়ে রাখলে চিন্তামুক্ত থাকা যাবে।
কোথায় খাবেন?
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত খাওয়ার জন্য কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নেই। বীচের কাছে শুধু ছোট দুইটি দোকান আছে। তাই আসার সময় প্রয়োজনীয় খাবার ও পানি সাথে করে নিয়ে আসবেন। আর ফেরার পথে সীতাকুণ্ড গিয়ে খাওয়া দাওয়া করতে পারবেন।
সীতাকুণ্ডে বেশ কয়েকটি লোকাল হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে ভাত,মাছ, মাংস,সবজি,ডালসহ বিভিন্ন নাশতার আইটেম পাবেন। এখানকার হোটেল গুলোর মধ্যে সৌদিয়া, আপন ও আল আমিন হোটেলের খাবার বোশ মানসম্মত ও স্বাস্থ্যকর। তবে এর থেকেও ভালো মানের খাবারের ব্যবস্থা চাইলে চলে যেতে হবে চট্টগ্রাম শহরে।
কোথায় থাকবেন?
গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের আশেপাশে কোথাও রাত কাটানোর জায়গা নেই। যদি থাকতে চান তবে দলবল নিয়ে ক্যাম্পিং করে থাকতে পারবেন। এছাড়া সীতাকুণ্ড এলে থাকার জন্য কয়েকটি সাধারণ মানের হোটেল পাবেন। এর মধ্যে সাইমুম ও সৌদিয়া হোটেল উল্লেখযোগ্য। সাইমুম হোটেলে প্রতি রাতের জন্য রুম ভারা পড়বে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা।
আর সৌদিয়া হোটেলে ভাড়া পড়বে ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত।
প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন: ০১৯৯১-৭৮৭৯৭৯
অথবা, ০১৮১৬-৫১৮১১৯
খুব ভালো মানের হোটেলে বা রেস্ট হাউজে রাত কাটাতে চাইলে চলে যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহরে।
পরামর্শ:
- ১. রাতে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।তাই ক্যাম্পিং করতে চাইলে সতর্কতা অবলম্বন করুন।
- ২. হাটার পথে ছোট ছোট গর্তে প্রচুর পরিমানে কেওড়া গাছের শ্বাসমূল থাকে,তাই সাবধানে দেখে হাটুন।
- ৩. সীতাকুণ্ড ভ্রমনে আসলে একসাথে বেশ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে দেখার প্লান করে আসুন। এতে একই খরচে অনেক স্পট ঘুরতে পারবেন।
- ৪. গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে বিকেলের পরিবেশ সবথেকে বেশি সুন্দর। তাই অন্যান্য স্পষ্ট গুলো আগে ঘুরে শেষের দিকে এই সৈকত দেখতে আসুন।