ঢাকা থেকে খুব কাছাকাছি পিকনিক করতে কিংবা ছুটির দিনে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে আসার জন্য উপযুক্ত গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। এটি গাজীপুর ন্যাশনাল পার্ক নামেই সবথেকে বেশি পরিচিত। জঙ্গলের মধ্যে একটা দিনের জন্য হারিয়ে যেতে পারবেন এই পার্কে এসে।
ঢাকার মহাখালী থেকে মাত্র ২৮ কিলোমিটার এবং গাজীপুর সদর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে ঢাকা ময়মনসিংহ হাইওয়ের ঠিক পাশেই ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। ৫০২২ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত এই পার্কের পুরোটা একদিনে ঘুরে দেখা কিন্তু সহজ বিষয় না।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালে জাতীয় উদ্যান এর কার্যক্রম শুরু হলেও এটি স্বীকৃতি পায় ১৯৮২ সালে এসে।শাল ও গজারি বনে আচ্ছাদিত এই পার্কের পুরোটাই যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।
পাশাপাশি মিনি চিড়িয়াখানা, পিকনিক স্পট, শিশুপার্ক, ওয়াচ টাওয়ার, পদ্ম পুকুর, টেরাকোটা খচিত গেইট আপনার ভ্রমণকে পরিপূর্ণ করতে সক্ষম। তাই পিকনিক কিংবা অন্যান্য যে কোনো প্রোগ্রাম অথবা ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান একটি আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান যাওয়ার উপায়
গাজীপুর সদর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ঢাকা ময়মনসিংহ হাইয়ের পাশে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। তাই আপনি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ময়মনসিংহ গামী যে কোনো বাসে উঠলে সরাসরি পার্কের প্রধান গেইটে নামতে পারবেন। সৌখিন, শ্যামলি, রাজিব, সোনার বাংলা সহ বেশ কয়েকটি বাস নিয়মিত এই রুটে চলাচল করে।
গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে যাওয়ার পথে হাতের ডান সাইডে পার্কের গেইট অবস্থিত। এটি জাতীয় উদ্যানের ৩ নম্বর গেইট এবং প্রধান গেইট। বাসে উঠে কনট্রাকটরকে বললেই হবে যে আপনি ন্যাশনাল পার্কের মেইন গেইটে নামবেন। তারাই আপনাকে গেইটের সামনে নামিয়ে দেবে৷ হাইওয়ে পাড় হয়ে ওপাড়ে গেলেই প্রবেশ গেইট পেয়ে যাবেন৷ জনপ্রতি বাস ভাড়া লাগবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
তাছাড়া গুলিস্তান থেকে ‘প্রভাতী বনশ্রী’ নামক একটিমাত্র বাস ১৫ মিনিট পর পর গাজীপুরের মাওনার উদ্যেশ্যে ছেড়ে যায়। এই বাসে চেপেও আপনি ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের প্রধান গেইটে নামতে পারবেন৷ এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ১০০ থেকে ১২০ টাকা।
যদি ময়মনসিংহ কিংবা মাওনার উদ্যেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বাস ধরতে না পারেন তাহলে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ঢাকার যে কোনো প্রান্ত থেকে চলে যেতে পারবেন।
ঢাকার যে কোনো প্রান্ত থেকে সহজেই গাজীপুরের বাস পেয়ে যাবেন। ভাড়া নির্ভর করবে আপনি কোথা থেকে বাসে উঠবেন তার ওপরে। চৌরাস্তা নেমে সেখান থেকে তাকওয়া নামক মিনি বাসে করে জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ গেইটে চলে যেতে পারবেন। ভাড়া লাগবে ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকা।
খাওয়ার ব্যবস্থা
খাওয়ার জন্য ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ভেতরে ছোটখাটো চায়ের দোকান পাবেন। সেখানে হালকা নাশতা করতে পারবেন। পিকনিক গ্রুপ করে গেলে আপনাকে রান্না করে নিয়ে যেতে হবে কিংবা রান্নার সরঞ্জাম ও রান্নার লোক সাথে নিয়ে যেতে হবে।
ব্যক্তিগত ভাবে ঘুরতে গেলে খাবার কিনে নিয়ে যেতে পারেন কিংবা বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে যেতে পারেন। অথবা পার্কের ক্যান্টিনে খাবার অর্ডার করে রাখতে পারেন।
ক্যান্টিনে খেতে চাইলে আগে থেকেই খাবার অর্ডার করে রাখতে হবে। পিকনিকের আয়োজন ও খাওয়াদাওয়া করার জন্য ৩১ টি পিকনিক স্পট রয়েছে। তাই খাওয়া দাওয়া ও রান্নার জায়গা নিয়ে বিশেষ সমস্যায় পড়তে হবে না।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে থাকার ব্যবস্থা
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তাই খুব সকালে চলে গেলে সন্ধ্যার মধ্যেই ঘুরে আসতে পারবেন। তবুও যদি একান্তই থাকার প্রয়োজন হয় তাহলে জাতীয় উদ্যানের রেস্ট হাউজে থাকতে পারবেন। তবে এজন্য অবশ্যই পূর্ব অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে।
অনুমতি ছাড়া চাইলেও আপনি রেস্ট হাউজে থাকতে পারবেন না।
এছাড়াও জাতীয় উদ্যানের আসেপাশে অনেক রিসোর্ট আছে যেখানে চমৎকার পরিবেশে রাত্রিযাপন করতে পারবেন৷ এর মধ্যে রিভারিয়া হলিডে রিসোর্ট, সোহাগ পল্লী রিসোর্ট, নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট, জল ও জঙ্গলের কাব্য উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া গাজীপুর চৌরাস্তা ও জয়দেবপুরে থাকার জন্য খুব ভালো থেকে সাধারণ মানের আবাসিক হোটেল পাবেন৷
জাতীয় উদ্যানে থাকা ও খাওয়ার জন্য অনুমতি কীভাবে পাবেন?
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের মহাখালী কার্যালয়ে যোগাযোগ করে অনুমতি সংগ্রহ করতে পারবেন। আবার জাতীয় উদ্যানের খুব কাছেই রাজেন্দ্রপুরে জাতীয় উদ্যানের রেঞ্জ কার্যালয় রয়েছে। এখান থেকেও অনুমতি নিয়ে জাতীয় উদ্যানের রেস্ট হাউজে থাকতে পারবেন।
সেই সাথে ক্যান্টিনে খাওয়ার জন্য অর্ডার করে রাখতে পারবেন।
তাছাড়া পিকনিক করতে চাইলে তো অবশ্যই আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হবে।
অনুমতি সংগ্রহ কিংবা বুকিং এর জন্য যোগাযোগ –
০১৭৮১-৭৩৩০০০ বা, ০১৭১৩-৫৭৫০৫৫
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ খরচ
জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণের জন্য মূলত উল্লেখযোগ্য কোনো খরচ নেই। জনপ্রতি প্রবেশ মূল্য দিতে হবে মাত্র ২০ টাকা। এছাড়া প্রাইভেট কার নিয়ে প্রবেশ করতে চাইলে ৬০ টাকা, মিনি বাস নিয়ে আসলে ১০০ টাকা এবং বড় বাসের জন্য ২০০ টাকা চার্জ দিতে হবে। ২০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে আপনি পুরো পার্ক ঘুরে দেখার সুযোগ পাবেন এর মধ্যে আর কোনো হিডেন চার্জ নেই।
তাছাড়া ঢাকা থেকে যদি বাসে আসতে চান তাহলে জনপ্রতি আসা যাওয়ার জন্য যাতায়াত খরচ ধরতে পারেন ৩০০ টাকা। আর খাওয়া দাওয়ার খরচ নির্ভর করবে আপনার সিদ্ধান্তের ওপর। বাড়ি থেকে রান্না করে আনলে তো এক্সট্রা কোনো খরচই লাগছে না।
অন্যদিকে আপনি সাধারণ মানের হোটেলে খাবেন নাকি ফাইল স্টার হোটেলে খাবেন তা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। পিকনিক গ্রুপ হলে তো খাবারের খরচের হিসাব একদমই আলাদা। তবে এটা বলাই যায় জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ খরচ অন্যান্য পার্ক কিংবা রিসোর্ট ভ্রমণের থেকে তুলনামূলক অনেক কম।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের উপভোগ্য বিষয়বস্তু
জাতীয় উদ্যানের প্রধান গেইটের সামনে গেলেই আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। কেননা পুরো গেইটের ডেকোরেশন করা হয়েছে টেরাকোটা দিয়ে।
তবে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের উপভোগ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হলো শালবন ও গজারি বন। যে দিকে চোখ যায় শুধু ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে দিন ফুরিয়ে যাবে তা বুঝতেই পারবেন না। হঠাৎ করেই দেখবেন গাছে বানর ঝুলে আছে৷ এ যেন এক অন্যরকম এডভেঞ্চার।
পার্কের মধ্যে বেশ কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। এখান থেকে পুরো পার্কের ভিউ খুব সহজেই উপভোগ করতে পারবেন৷ আরও আছে চমৎকার একটি পদ্ম পুকুর। ন্যাশনাল পার্কে ঘুরতে গেলে পদ্ম পুকুর না দেখে আসবেন না যেন৷ পুকুরের পানিতে ভেসে থাকা চমৎকার পদ্মফুল মুহূর্তেই আপনার মন ভালো করে দেবে৷ বনের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আরও বেশ কয়েকটি পুকুর ও লেক চোখে পড়বে।
এখানে চাইলে নৌকা নিয়ে ঘুরতে পারবেন এবং মাছ ধরতে পারবেন৷ কিন্তু সেজন্য আপনাকে অবশ্যই এক্সট্রা চার্জ দিতে হবে।
আছে শিশুপার্ক ও মিনি চিড়িয়াখানা। শিশুপার্কে বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য থাকছে পূর্নাঙ্গ ব্যবস্থা। বিভিন্ন রাইডে চেপে ও মিনি চিড়িয়াখানার পশুপাখি দেখে কাটিয়ে দিতে পারবেন অনেকটা সময়।
এছাড়া ন্যাশনাল পার্কের আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো প্রজাপতি বাগান। এখানে রঙ বেরঙের হরেক রকম প্রজাপতির দেখা মিলবে। বনের মধ্যে এমন রঙিন এক পরিবেশ সত্যিই দারুন।
তাই বলা যায় জঙ্গল, লেক, পুকুর, জীববৈচিত্র্য, ওয়াচ টাওয়ার, চিড়িয়াখানা, পিকনিক স্পট, শিশুপার্ক, পদ্ম পুকুর সব মিলিয়ে অবকাশ যাপনের এক দারুন আয়োজন রয়েছে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে।
সতর্কতা:
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের বেশিরভাগ এলাকাই ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। তাই ব্যক্তিগতভাবে না গিয়ে পিকনিক দল নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে।
পার্কের ভেতরে উচ্চ শব্দে গান বাজনা করা নিষেধ। এই নিয়ম ভঙ্গ করলে জরিমানা দিতে হবে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন।
সাথে থাকা বচ্চাদের চেখে চোখে রাখবেন নয়তো বনের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে। তখন খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
বন্যপ্রাণী কিংবা উদ্ভিদের ক্ষতি সাধিত হয় এমন কোনো কাজ করলে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবে।