গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী খাবার

ঢাকা বিভাগের ঐতিহ্যবাহী ও প্রশাসনিক জেলা গাজীপুর। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই গাজীপুর জেলায় অবস্থিত। ইতিহাসের কালজয়ী বিভিন্ন আন্দোলনের চাক্ষুষ সাক্ষী এই গাজীপুর জেলা।বর্তমানে সবথেকে বেশি গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠেছে গাজীপুরে,তাইতো বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার লোকজন জীবীকার তাগিদে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছে।

এসকল লোকজনের আনাগোনায় ফলে এই জেলার সংস্কৃতিতে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের বৈচিত্র্যতা।তবুও গাজীপুরের স্থানীয়দের নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য কিন্তু বিলীন হয়ে যায় নি।গাজীপুরের সংস্কৃতির এক বিশাল স্থান জুড়ে রয়েছে এই অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস। স্থানীয় কালচারের খাবার দাবারের সাথে অন্য অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস এর মধ্যে রয়েছে বিরাট ব্যবধান। গাজীপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো এই জেলার সংস্কৃতির ধারক ও বাহন। চলুন জেনে নেয়া যাক গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত।

১. খুদের ভাত

গাজীপুরের স্থানীয়রা উত্তরাধিকার সূত্রে এখনও অনেক জমির মালিক।শহর হোক কিংবা গ্রাম,সব এলাকাতেই প্রচুর পরিমান ধান উৎপাদন করা হয় এই জেলায়।সেই ধান ভাঙানোর সময় চালের যে ভাঙা অংশ বের হয় তাকে বলে ক্ষুদ।সেই ক্ষুদ দিয়ে রান্না করা হয় বিশেষ এক ধরনের খাবার যা খুদের ভাত নামে পরিচিত। সকালের নাশতায় গাজীপুর বাসীর প্রথম পছন্দ খুদের ভাত। বর্তমানে শুধু গাজীপুরেই নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই এই খাবারটি খুবই জনপ্রিয়।

প্রস্তুত প্রনালী :
পেয়াজ, মরিচ ও রসুন কুচি করে ভালো ভাবে ভেজে তার মধ্যে দিয়ে দিতে হয় ধুয়ে রাখা ক্ষুদ ও ডাল (ডালটা অপশনাল)। তারপর পরিমান মতো লবন ও পানি দিয়ে পোলাওয়ের মতো রান্না করা হয় ক্ষুদের ভাত।নতুন ক্ষুদ হলে ঘ্রানও আসে পোলাওয়ের মতোই।খেতেও অনেকটা পোলাওয়ের স্বাদ পাওয়া যায়।

পরিবেশন :
ক্ষুদের ভাত খওয়া হয় বিভিন্ন আইটেম এর ভর্তা দিয়ে।বিশেষ করে শুটি ভর্তার সাথে ক্ষুদের ভাত খুব বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়া আলু ভর্তা,কালিজিরা ভর্তা,ডাল ভর্তা,ডিম ভর্তা,মাছ ভর্তা দিয়েও পরিবেশন করা হয় এই খাবারটি।

২. ঝুড়ি পিঠা

গাজীপুরের সবথেকে ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন খাবার ঝুড়ি পিঠা।গাজীপুর ছাড়া অন্য কোনো এলাকার মানুষ খুব কমই জানে এই পিঠা সম্পর্কে। ঈদের আগে পুরো রোজার মাস জুড়েই ঝুড়ি পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায় সব ঘরে ঘরে।ঝুড়ি পিঠা ছাড়া যেন ঈদ পরিপূর্ণ হয়ই না।ঝুড়ি পিঠা বানাতে ৩/৪ জন মানুষের প্রয়োজন হয় বলে এই পিঠা বানানোর সময় ঘরে ঘরে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ তৈরি হয়।

প্রস্তুত প্রনালী :
প্রথমে খুব নরম করে ভাত রান্না করে নিতে হয়। তার পর সেই ভাত চটকে একদম আঠালো করে নিতে হয়।বৈচিত্র্যতা আনার জন্য তিন চার ভাগ করে কাই নিয়ে বিভিন্ন রং মেশানো হয়। ঝুড়ি পিঠা বানানোর জন্য আছে বিশেষ এক ধরনের জালি,সেই লোহার জালির উপর চটকে নেয়া ভাত ডলতে থাকলে নিচে লম্বা লম্বা হয়ে পড়ে পিঠা।এই পিঠা বানাতে কড়া রোদ দরকার।কড়া রোদে শুকিয়ে সারা বছর সংরক্ষণ করে খাওয়া যায় ঝুড়ি পিঠা।

পরিবেশন:
শুকিয়ে রাখা ঝুড়ি তেলে ভেজে খাওয়া যায়।তেলে ভাজা পিঠাকে গুড়ের পাক দিলে সব থেকে বেশি মজা লাগে।ঈদের দিন সেমাই বা পায়েস এর সাথে মিশিয়েও খাওয়া হয় এই পিঠা।

৩. শাহী নাশতা

গাজীপুরের ব্যাস্ত মানুষের খুবই জনপ্রিয় খাবার শাহী নাশতা।সকাল হলেই দেখা যায় কাঠের একটা চারকোনা বিয়ারিং চালিত গাড়ি খটর খটর করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। উপরে থাকে লাল কাপড়ের ঢাকনা।খটর খটর আওয়াজ আর লাল কাপড় দেখলেই বোঝা যায় শাহী নাশতা ফেরি করা হচ্ছে। শাহি নাশতা আসলে কম তেলে ভাজা পরোটা ও সুজির শক্ত হালুয়া।এই বাজারে এখনও মাত্র ১০ টাকায় সকালের খাবার সেরে ফেলতে পারবেন শাহী নাশতা দিয়ে।স্কুল কলেজের স্টুডেন্ট, ছোট ছোট দোকানের ব্যবসায়ীদের সকালের খাবারে বেশির ভাগ সময়েই শাহী নাশতা খেতে দেখা যায়।দাম কম হলেও খেতে কিন্তু দারুণ মজা।শাহী নাশতা গাজীপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার।

প্রস্তুত প্রনালী :
ময়দা কাই করে বিশাল আকৃতির এক একটা পরোটা বানিয়ে সেগুলোকে কম তেলে বড় তাওয়ায় ভাজতে হয়।অন্যদিকে সুজি টেলে রেখে পাতিলে চিনি, পানি ও গরম মসলা জ্বাল করে তার মধ্যে সুজি দিয়ে একদম শক্ত করে হালুয়া তৈরি করা হয়।পরে সেগুলো একটি মাঝারি সাইজের গামলায় ঢালা হয়।

পরিবেশন:
বড় সাইজের পরোটাকে ছিড়ে ছোট টুকরো করে তার ওপরে মাঝারি সাইজের এক চাম হালুয়া কেটে দিয়ে দেওয়া হয় পলিথিনে করে।সেই পরোটা ও হালুয়া একসাথে খেতে দারুণ লাগে।

৪.চ্যাপা শুটকি

সেই প্রাচীন কাল থেকেই গাজীপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি প্রিয় খাবার চ্যাপা শুটকি।ঘরে রান্না করার কিছু নেই তো কি হয়েচে দু চারটা চ্যাপা শুটকি ভর্তা বা ভুনা করে ভাত খেয়ে ওঠা যায় ২ থেকে ৪ প্লেট।চ্যাপা শুটকির ঘ্রানটাই একে অন্যান্য শুটকির থেকে একদম আলাদা করে তুলেছে।

পুঁটি মাছকে মাটির হাঁড়ির মধ্যে রেখে বিশেষ এক পদ্ধতিতে চ্যাপা শুটকি তৈরি করা হয়।চ্যাপা শুটকি দিয়ে তৈরি করা যায় কয়েক পদের খাবার।
চ্যাপার বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় আইটেম হলো:

  1. চ্যাপা শুটকি শিল পাটায় বেটে ভর্তা
  2. চ্যপা শুটকি পেয়াজ মরিচ চটকে ভর্তা
  3.  চ্যাপা ভুনা
  4. বেগুন আলু দিয়ে চ্যাপার চচ্চড়ি
  5. কুমরো / লাউ পাতায় চ্যাপা
  6. কাঠাল বিচির সাথে চ্যাপা ভর্তা
  7. ডাটা দিয়ে চ্যাপার তরকারি (স্থানীয় নাম দাড়ার তরকারি)
  8. চ্যাপা পিঠা ( ইত্যাদি)

৫. নকশি পিঠা

গাজীপুরের বিয়ে বাড়ি নকশি পিঠা ছাড়া তো কল্পনাই করা যায় না।তাছাড়া মেহমান আপ্যায়ন, ঈদ,কুরবানির সময় নকশি পিঠা লাগবেই লাগবে।গাজীপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার এই নকশী পিঠা।দেখতেও যেমন অসাধারণ খেতেও তেমন মজার।গাজীপুরের মেয়েদের গুনের পরিচয় ফুটে ওঠে নকশি পিঠার মাধ্যমে। বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাদের হাত ধরে নকশি পিঠার কদর ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ সহ বিদেশেও।

প্রস্তুত প্রনালী :
চালের গুড়ো সিদ্ধ করে রুটি পিঠার মতো কাই করে নিতে হবে।তার পর মোটা করে বেলে গোল,চারকোনা বা তিনকোনা আকৃতিতে কেটে নিতে হবে।কেটে নেওয়া মাঝারি আকৃতির পিঠার ওপর খেজুর কাটা দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হয় বাহারি নকশা।এই পিঠা তৈরি করাও একটা আর্ট,যা সবাই পারে না।পিঠার বাহারি এই নকশা দেখলে খাওয়ার আগেই চোখ জুড়িয়ে যায়।নকশা করা শেষ হলে ২/৩ ধাপে তেলে ভেজে নিতে হবে নকশি পিঠা।প্রথম ভাজা দেয়ার পর বায়ুরোধী বয়ামে অনেক দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়,তবে অবশ্যই কিছু দিন পর পর রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।

পরিবেশনঃ
শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা পিঠা তেলে মচমচে করে ভেজে গরম গরম পরিবেশন করা হয়। ভাজা পিঠা গুড়ের পাক দিলে খেতে বেশি ভালো লাগে।

৬. কাঁঠালের চাপটি

চাপটি বা চটা পিঠা যাই বলেন না কেন সবারই কম বেশি এই খাবারটি পছন্দ। তবে কাঁঠালের চাপটি খুব কম মানুষই খেয়ে থাকবেন।গাজীপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার এই কাঁঠালের চাপটি। বাংলাদেশের মধ্যে সবথেকে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয় গাজীপুর জেলায়।যাদের বাড়িতে কাঁঠাল গাছ নেই বলে মনে হবে তাদেরও কম করে হলে বাড়ির আনাচে কানাচে একটা কাঁঠাল গাছ আছে।এতো কাঠাল তো আর এমনি এমনি খাওয়া যায় না।তাই সেই কাঁঠাল দিয়ে তৈরি করা হয় চাপটি।

প্রস্তুত প্রনালী :
নরম কাঁঠালের বিচি ছাড়িয়ে ভালো করে চটকে তার সাথে চালের গুড়ো / আটা/ ময়দা মিশিয়ে নিতে হবে।তার ভেতর দিতে হবে পরিমান মতো লবন ও চিনি।সব উপকরণ ভালো ভাবে মিশিয়ে কলা পাতায় লেপটে দিয়ে উপর থেকে আরেকটা কলাপাতা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।তারপর তাওয়ায় দিলে উল্টে পাল্টে ভেজে নিতে হবে।

পরিবেশন:
কাঠালের চাপটি চুলার পাশে বসে গরম গরম খেতেই খুব ভালো লাগে।এর সাথে আর কিছু না হলেও চলে।

এছাড়াও গাজীপুরের আরও কয়েকটি বিখ্যাত খাবার হলো:

১. সিরিস পিঠা
২. সিমের বিচি দিয়ে জিওল মাছের তরকারি
৩. হলুদ ভাজি
৪. ধনির চিঁড়া
৫. কালিয়াকৈর এর তেলেভাজা
৬. কাঁঠাল
৭. পেয়ারা
৮. শাপলা চিংড়ি
৯. কালীগঞ্জের কালোজাম
১০. লইট্যা শুটকি ( ইত্যাদি )

Scroll to Top