গরমে স্বস্তি পাওয়ার ১০টি ঘরোয়া উপায়

তাপদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন। দিন কিংবা রাত, অতিরিক্ত গরমে শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না এক মুহুর্তও। তার ওপরে লোডশেডিং এর জ্বালাতন তো রয়েছেই। আর এই তাপদাহের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে শিশু, বৃদ্ধ, যোয়ান, বুড়ো সবার ওপরে। দিনে কাজ করে শান্তি নেই আর রাতে ঘুমোতে গেলেও একই অবস্থা। তাপদাহে পুরছে দেশ আর তাপদাহের প্রভাবে দৈনন্দিন জীবনে তৈরি হচ্ছে নানান জটিলতা ও অস্বস্তি। কী করে গরম থেকে স্বস্তি পাওয়া যাবে এই ভাবনাই সারাক্ষণ ঘুরতে থাকে মাথায়। তো বর্তমান সময়ের অসহ্য এই গরমে স্বস্তি পাওয়ার ১০ টি ঘরোয়া উপায় জেনে নিন এখুনি। আশাকরি টিপস গুলো এই গরমে আপনাকে একটু হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে সহায়তা করবে।

১. খাদ্যাভ্যাসে বিশেষ নজর দিন

আমাদের শরীরকে শীতল রাখতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস। খাদ্য তালিকায় কম মসলায় রান্না করা সবজি অবশ্যই রাখা উচিত। যেমন: লাউ, কুমরো, ঝিঙে, ধুন্দল, পটল ইত্যাদি। গরমের সময় যে কোনো রান্নায়ই পাতলা ঝোল থাকলে ভালো হয়। এছাড়া ফল ও ফলের রস শরীরকে হাইড্রেট রাখতে সহায়তা করে। গরমে ঘামের সাথে প্রচুর পরিমানে লবন ও পানি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। তাই স্যালাইন, ডাবের পানি, জুস, মাঠা ইত্যাদি পানীয় পান করা উচিত। গরমের প্রভাবে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের উপদ্রব বেশি দেখা যায়, তাই শরীরকে সুস্থ রাখতে ভিটামিন সি জাতীয় ফল খেতে হবে। যেমন: আমলকি, লেবু, আনারস, কমলা ইত্যাদি। মনে রাখবেন গরমের সময়টা স্বস্তিতে কাটানোর পূর্বশর্ত হলো শরীরকে সুস্থ রাখা।

২. পোশাক নির্বাচনে সচেতন হোন

আপনার শরীরের তাপমাত্রা কেমন থাকবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে আপনার পরিধেয় পোশাকের ওপর। এই গরমে টাইট ফিটিং পোশাক বর্জন করে ঢিলেঢলা পোশাক পরিধান করা উচিত। অতিরিক্ত গর্জিয়াস পোশাক গরমের মধ্যে না পরাই উত্তম। তাছাড়া পোশাকের রং একটু হালকা ধাচের হওয়া বাঞ্ছনীয়। কালো বা যে কোনো ডার্ক রঙের পোশাক সূর্যের আলো বেশি শোষণ করে তাই শরীরের তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি অনুভব হয়। তাই ডার্ক রঙের পোশাক গরমের সময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। তাছাড়া সিল্ক, জর্জেট বা মোটা কাপড় এর পরিবর্তে বাছাই করে নিতে পারেন হালকা রঙের নরম সুতি কাপড়ের পোশাক। সুতি পোশাক দেখতেও যেমন স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করতেও আরামদায়ক। 

৩. প্রচুর পরিমানে পানি পান করুন

এই গরমে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন শরীরে পানির ঘাটতি না হয়। মানবদেহের প্রায় ৬০ থেকে ৭৫ ভাগই পানি। এর পরিমান ১০% কমে গেলে মানুষ জ্ঞান হারাতে পারে। গরমের সময় ঘামের মাধ্যমে যেহেতু প্রচুর পরিমানে পানি শরীর থেকে বের হয়ে যায়, তাই আমাদের বার বার পানি পান করা উচিত। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করা উচিত। কিছুক্ষণ পর পর শীতল পানি পান করলে শরীরের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে ফলে গরম কম অনুভূত হয়। তবে সরাসরি ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন। 

৪. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন

গরমে ঘাম ও ধুলোবালির সংমিশ্রণে আমাদের শরীর, চুল ও পোশাকের অবস্থা নাজেহাল হয়ে যায়। আর শরীর ভর্তি ধুলোবালি থাকলে আমাদের ত্বকের বহিরাংশে বায়ু চলাচল ব্যহত হয়। ফলে গরমে বেশি অস্বস্তি লাগে। তাই প্রতিদিন কমপক্ষে এক বার সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে (প্রয়োজনে একাধিক বার)। এক দিন পর পর চুলে শ্যাম্পু করতে হবে, যাতে স্ক্যাল্পে বায়ু চলাচল অব্যাহত থাকে। কিছুক্ষণ পর পর হাত মুখ শীতল পানি দিয়ে ধুয়ে নিলে অনেকটা স্বস্তি পাওয়া যায়। তাছাড়া পরিধেয় পোশাক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এই সময়ে অত্যন্ত জরুরি। এতে যেমন মানসিক প্রশান্তি আসে তেমনই শারীরিক ভাবে স্বস্তি পাওয়া যায়। এছাড়াও বাড়ির পর্দা বিছানার চাদর ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। কেননা নোংরা পরিবেশ গরমের অস্বস্তি কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়। 

৫. ঘরের সঠিক রং বাছাই করুন

ঘরের দেয়ালের দিকে তাকালে একটি প্রশান্তির ছায়া যেন নেমে আসে আপনার মনে, এই বিষয়টি নিশ্চিত করুন। কটকটে কালার বাদ দিয়ে ঘরের দেয়াল রাঙিয়ে তুলুন নীলাভ, শুভ্র সাদা অথবা সবুজাভ রঙে। এই রংগুলো হিট রিফ্লেক্টিভ কালার হিসেবে জনপ্রিয়। ফলে এই রং সূর্যের আলোর প্রতিফল ঘটায় এবং ঘরকে রাখে শীতল। তাছাড়া ঘরের দেয়ালে সবুজ লতাপাতা কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্য পেইন্টিং করতে পারেন। এতে আপাতদৃষ্টিতে ঘরকে ঠান্ডা ও শীতল মনে হবে। 

৬. বাড়িতে ইনডোর প্লান্ট রাখুন

পরিবেশ শীতল রাখতে গাছের কোনো বিকল্প নেই, একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু আমরা যারা শহরে বহুতল ভবনে থাকি তাদের বাড়ির আশেপাশে গাছপালা লাগানোর তেমন সুযোগ থাকে না। তাই বাড়ির ড্রয়িং রুম, বাড়ান্দা, ডাইনিং রুম, বেডরুম এমনকি ওয়াশরুম সহ বাড়ির আনাচে কানাচে ইনডোর প্ল্যান্ট রাখুন। কেননা বেশিরভাগ  ইনডোর প্ল্যান্ট মাটি ছাড়াই শুধু পানিতে বাঁচতে পারে। এসব ইনডোর প্ল্যান্ট প্রচন্ড গরমে ঘরের আদ্রতা ধরে রেখে ঘরকে শীতল করে তোলে। পাশাপাশি ঘরের সৌন্দর্যও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে এই গাছ। 

৭. বাড়ির ছাদে পানি দিন ও জমিয়ে রাখুন

প্রচন্ড গরমে সূর্যের তাপমাত্রা এতো বেশি থাকে যে, বাড়ির ছাদ থেকে মনে হয় আগুনের গোলা ছুটে আসে রুমের মধ্যে। সিলিং ফ্যানের বাতাসও তখন অসহ্য লাগে। এই সময়ে বাড়ির ছাদে পাইপ এর সাহায্যে অথবা অন্য যে কোনো উপায়ে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করুন। টিনের চালা হোক বা পাকা বাড়ির ছাদ হোক, ছাদে পানি দিলে তা পুরো বাড়ির তাপমাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। সম্ভব হলে এই পানি বাড়ির ছাদে জমিয়ে রাখুন। ফলে বাতাসে আদ্রতার পরিমাণ খুব বেশি কমে যাবে না। আর সূর্যোর তাপ বাড়ির ছাদ ভেদ করে পুরোপুরি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করবে না। ফলে পুরো বাড়ি শীতল থাকবে। 

৮. কিছু কাজ অভ্যাসে পরিনত করুন

গরম থেকে স্বস্তি পেতে চাইলে দৈনন্দিন জীবনে কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যেমন কিছুক্ষণ পর পর শীতল ও পরিষ্কার পানি দিয়ে হাতমুখ ধোয়া। মাথার তালু ও চোখে মুখে পানি দেওয়া। গরম খাবার এরিয়ে চলা। কিছুক্ষণ পর পর পানি পান করা। বাইরে যাওয়ার সময় ছাতা, সানগ্লাস, ওয়াটারপট ইত্যাদি সাথে রাখা। তাছাড়া প্রয়োজন না হলে বাড়ির চুলা, লাইট সহ তাপ উৎপাদন করে এমন সকল যন্ত্র বন্ধ করে রাখা। পায়ে হাটা পথ এরিয়ে চলা এবং রিকশা কিংবা সিএনজি ব্যবহার করা। যথাসম্ভব শারিরীক কসরত থেকে দূরে থাকা। 

৯. মানসিক ভাবে চাপমুক্ত থাকুন

আমাদের শরীরের সুস্থতা ও আরাম আমাদের মন সাপেক্ষ। কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করলে কিংবা কোনো বিষয় নিয়ে রেগে গেলে দেখবেন আপনি ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছেন। তাই যতোটা সম্ভব মানসিক ভাবে চাপমুক্ত থাকুন। লোডশেডিং হলে বিরক্তি প্রকাশ না করে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিন ও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। এতে গরম অনেকাংশে কম লাগবে ও অস্বস্তি এড়ানো সহজ হবে। তাছাড়া অকারনে উত্তেজিত হওয়া ও চিৎকার চেচামেচি থেকে দূরে থাকুন। মানসিক ভাবে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আপনাকে আরও বেশি গরম অনুভব করাবে। 

১০. শব্দদূষণ থেকে দূরে থাকুন

শব্দদূষণ আপনার মানসিক প্রশান্তি ক্ষুন্ন করার জন্য বেশি দায়ী। চারপাশ নিরিবিলি চুপচাপ থাকলে আমরা মানসিক ভাবে চাপমুক্ত থাকি। অতিরিক্ত চিৎকার চেচামেচি, অন্যান্য শব্দ, কোলাহল, গানবাজনা আমাদের মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে। ফলে শারিরীক ভাবেও আমরা অস্থির হয়ে পরি। এর ফলে আমাদের গরম বেশি অনুভূত হয়। তাই গরমে একটু স্বস্তিতে থাকতে চাইলে একটি শব্দদূষণ মুক্ত শীতল পরিবেশে অবস্থান করুন। 

শেষকথা 

আশাকরি উপরিউক্ত টিপস গুলো এই গরমে আপনাকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি দেবে। আসলে তাপমাত্রা যতোটুকু থাকে তার থোকেও বেশি তাপমাত্রা আমরা অনুভব করি যখন আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মানসিক অবস্থা প্রতিকূল থাকে। তাই একটি সুন্দর সুস্থ লাইফস্টাইল ও সুন্দর পরিবেশই পারে প্রচন্ডে গরমে আমাদের জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসতে। 

Scroll to Top