বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম নগর খুলনা।এই শহরের বেশ কিছু এলাকা একেক খাবারের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে বিখ্যাত। আমাদের খুবই পরিচিত খাবারগুলো একদমই আলাদা একটা স্বাদে পরিবেশন করা হয় এই এলাকার বিখ্যাত খাবারের হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে।এই শহরের বেশ কিছু হোটেল ও ছোট ছোট খাবারের দোকান তাদের বিখ্যাত সব খাবারের জন্য একচেটিয়া ভাবে ব্যবসা করে আসছে।
তাদের রান্নার কৌশল ও সুনাম অন্য কেউ দখল করতে পারেনি সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে।খুলনার স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো ঘরোয়া ভাবে প্রকাশিত না হয়ে বরং নিজেদের পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছে বিখ্যাত সব খাবারের দোকানের হাত ধরে।খুলনায় ঘুরতে আসলে আপনার আর যাই হোক খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে না।বরং অভিজ্ঞতা হবে খুলনার ঐতিহ্যবাহী বেশ কিছু খাবারের স্বাদ নেওয়ার।খুলনায় আসলে যে খাবাগুলো আপনার অবশ্যই টেস্ট করা উচিত চলুন জেনে আসি সেসব খাবার সম্পর্কে।
১. আব্বাস হোটেলের চুইঝালের খাসি
চুইঝাল খুলনার খুবই বিখ্যাত একটি খাবার।চুইঝাল ব্যতিক্রমধর্মী একপ্রকার সবজি জাতীয় খাবার যা গরু অথবা খাসির মাংস দিয়ে খাওয়া হয়।এই খাবারের অথেনটিক স্বাদ আপনি খুলনার আব্বাস হোটেলে গেলেই পাবেন।আব্বাস হোটেলের গরু অথবা খাসির মাংসের চুইঝাল পুরো খুলনা শহরের মধ্যে বিখ্যাত। খুলনার স্থানীয়দের মধ্যে এমন কেউ নেই যে কিনা আব্বাস হোটেল সম্পর্কে অবগত নয়।
প্রতিদিন অসংখ্য ক্রেতার ভিড় পড়ে এই হোটেলে।হোটেলের সামনে গাড়ির ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকাটাই দায় হয়ে যায়।এই হোটেলের চুইঝাল গোসত এতোটাই সুস্বাদু যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ক্রেতা এখান থেকে খাবার কিনে নিয়ে গেছেন সুদূর চিন, জাপান ও আরও কয়েকটি দেশে।সেখানকার স্থানীয়রা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই খাবার খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বিখ্যাত এই হোটেলটি খুলনা জেলার কচুনগরে অবস্থিত।
২. সেমাই পিঠা
খুলনার খুবই ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার সেমাই পিঠা। স্থানীয়দের কাছে এটি শেয়াই পিঠা মানেই পরিচিত।
শীতকালে যখন চারদিকে পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়, তখন খুলনার ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় সেমাই পিঠা।বাড়িতে কোনো মেহমান এলে সেমাই পিঠা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।জামাই আপ্যায়নে শেয়াই পিঠাই সবার আগে প্রাধান্য পায়।দুপুরে বা রাতে ভাতের বদলে পরিবেশন করা হয় ঐতিহ্যবাহী এই সেমাই পিঠা।
সেমাই পিঠা অনেকটা নুডলস এর মতো।এই পিঠা তৈরি করতে প্রয়োজন বিশেষ এক ধরনের কল।আগে কাঠের কলে এই পিঠা বানানো হলেও বর্তমানে তার প্রচলন উঠে গেছে।এখন বাজারে কিনতে পাওয়া পিতলের কলের মাধ্যমে সেমাই পিঠা বানানো হয়।
চালের গুড়ো রুটির কাই এর মতো সিদ্ধ করে কলের ভেতরে ভরা হয়।তারপর সেই কল ঘোরালে নুডলস এর মতো লম্বা লম্বা হয়ে বের হয় পিঠা।তারপর এগুলোকে ভাপে সিদ্ধ করে গরম গরম পরিবেশন করা হয়।
সেমাই পিঠা খাওয়া হয় মূলতখুলনার বিখ্যাত চুই ঝাল দিয়ে রান্না করা হাঁসের মাংসের সাথে।তাছাড়া গরুর মাংস বা অন্যান্য মাংশের সাথেও খাওয়া যায়।
খুলনার ঐতিহ্যবাহী খাবার হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক জেলাতেই সেমাই পিঠা খাওয়ার প্রচলন ঘটেছে।
৩. মুসলিম হোটেলের গরুর মাংস
খুলনার বেশ কয়েকটি হোটেল গরু ও খাসির মাংসের জন্য বিখ্যাত। তার মধ্যে খুলনার বেজেড়ডাঙার মুসলিম হোটেল অন্যতম।গরুর মাংসের মধ্যে তারা আস্ড রসুন দেয়।এজন্য তাদের খাবারের স্বাদটাই একদম বদলে যায়,পাশাপাশি তাদের নিজস্ব সিক্রেট রেসিপি তো আছেই।
পুরো খুলনার মানুষের কাছে এই মুসলিম হোটেলের গরুর মাংস বিখ্যাত। যারা গরুর মাংসের খান না তারা খাসির মাংস খেতে পারেন। এই মাংসের স্বাদও গরুর মাংসের থেকে কম না। হোটেলটির বয়স বেশি দিন না হলেও সব সময়ই এখানে থাকে উপচে পড়া ভীড়। এখানে খেতে আসলে আপনার একবেলায় খরচ পড়বে মাত্র ১৫০/২০০ টাকা।
খুলনায় গেলে অবশ্যই একবার বেজেড়ডাঙার বিখ্যাত এই মুসলিম হোটেলের গরুর মাংস চেখে আসবেন।
৪. জিরো পয়েন্ট এর গরুর মাংস
খুলনায় যে কয়টি জনপ্রিয় খাবারের হোটেল তার বেশিরভাগই মাংসের আইটেমের জন্য বিখ্যাত। ঠিক তেমনই একটি জনপ্রিয় হোটেল হলো জিরো পয়েন্ট এর চুকনগর হোটেল।
এখানকার গরুর মাংস চুকনগরের গরুর মাংস হিসেবেই বহুল জনপ্রিয়।
চুইঝাল দিয়ে লাল লাল করে রান্না করা এই মাংস একবার খেলে এর স্বাদ আজীবন মুখে লেগে থাকবে।
খুলনা ভার্সিটি রোড হয়ে জিরো পয়েন্ট থেকে সোজা ২/৩ মিনিট হাটলেই পেয়ে যাবেন বিখ্যাত এই চুকনগর হোটেল।
৫. মান্নান এর ফুচকা চটপটি
খুলনার সবথেকে জনপ্রিয় ফুচকা চটপটি পাওয়া যায় এই মান্নান এর চটপটি ফুচকার দোকানে।খুলনার সবাই এখানকার খাবার সম্পর্কে কম বেশি জানে।অসাধারণ কারিগরি দক্ষতার কারনে তারা ধরে রেখেছে নিজের সুনাম।শুনলে অবাক হবেন যে শুধু ফুচকা চটপটি বিক্রি কটে এই দোকানের কর্ণধার চার তলা বাড়ি করে ফেলেচেন।তাহলে বুঝতেই পারছেন এখানকার মানুষের কাছে মান্নান এর ফুচকা কতোটা জনপ্রিয় এবং কতো ক্রেতার সমাগম হয় এই দোকানে।
চটপটি,ফুচকার পাশাপাশি ফালুদাটাও বেশ মজার খেতে হয় এখানকার।
খুলনার যে কোনো রিকশাওয়ালাকে বললেই নিয়ে যাবে আপনাকে মান্নান এর ফুচকা চটপটির দোকানে।
৬. এক টাকার পুরি
হ্যাঁ, ভুল শোনেনি। এই বাজারে এখনও এক টাকায় পুরি পাবেন খুলনায়।১ টাকায় বিক্রি হয় বলে যে এর স্বাদ খারাপ তা কিন্তু নয়।দামে কম হলেও খেতে স্বাদ অসাধারণ। তাইতো প্রতিদিন লম্বা ভিড় পড়ে যায় এই ছোট দোকান টির সামনে।অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে তবেই পাওয়া যাবে বিখ্যাত এই এক টাকার পুরি।
এক টাকার পুরির স্বাদ নিতে হলে আপনাকে চলে জেতে হবে খুলনার স্টার সিনেমা হলের কাছে। মিনা বাজারের পাশের রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই পেয়ে যাবেন বিখ্যাত এই দোকানটি।
৭. হোটেল ডিলাক্স এর ফালুদা
খুলনায় ফালুদা খাওয়ার প্রচলন শুরুই হয়েছে হোটেল ডিলাক্স এর হাত ধরে। খুলনায় ফালুদা জনপ্রিয় করার মূল কারিগর বলা হয় হোটেল ডিলাক্স কে।বর্তমানে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ও ফুড কোর্টে ফালুদা পাওয়া গেলেও হোটেল ডিলাক্স এর মতো অথেনটিক স্বাদ কেউই অর্জন করতে পারে নি।খুলনার ফালুদার অথেকটিক স্বাদ পেতে হলে আপনার অবশ্যই একবার হোটেল ডিলাক্স এর ফালুদা টেস্ট করা উচিত।
ফালুদার কথা উঠলেই তাই খুলনাবাসীর সবার আগে মনে আসে হোটেল ডিলাক্স এর কথা।
খুলনার পিকচার প্যালেস মোড়ে ফালুদার এই বিখ্যাত হোটেলটি অবস্থিত।
৮. রাজকচুরির রাজস্থানি খাসি
খাসির গোসত তো সবাই কম বেশি খেয়েছি,কিন্তু এই খাসির মাংসের স্বাদ যদি হয় একদমই আলাদা তখন এর জনপ্রিয়তা বহুল অংশে বেড়ে যায়।খুলনার রাজস্থানি খাসিও এমনই ব্যতিক্রমধর্মী একটি আইটেম।পুরো খুলনা জুড়ে এই রাজস্থানি খাসির একটা আলাদা কদর রয়েছে।
খাসির মাংসের মধ্যে দেয়া হয় আস্ত রসুন সেই সাথে এড হয় তাদের অথেনটিক মসলা ও রান্নার কৌশল।গাজর পোলাওয়ের সাথে পরিবেশন করা হয় বিখ্যাত এই কাসির মাংস।তবে মাংসের সাথে পোলাওয়ের পরিমানটা তুলনামূলক একটু কম থাকে।
যদি ভিন্ন স্বাদের খাসির মাংসের স্বাদ নিতে চান তবে অবশ্যই চলে আসতে হবে খুলনার দৌলতপুরে।এখানেই পেয়ে যাবেন বিখ্যাত রাজস্থানি খাসির মাংসের হোটেল।
১০.কাচ্চি ঘরের কাচ্চি
খুলনায় কাচ্চি বিরিয়ানির একমাত্র ঐতিহ্যবাহী কাচ্চির সন্ধান পাবেন শুধুমাত্র কাচ্চি ঘরে।এখানকার কাচ্চিতে যে অথেনটিক স্বাদ পাবেন তা আর কোথাও পাবেন না।
কাচ্চি ঘরের ডেকোরেশনও মনোরম।কাচ্চির সাথে পরিবেশন করা হবে ডিম,সালাদ ও বোরহানি। কাচ্চির সাথে বোরহানি পাবেন একদম ফ্রী তে।
কাচ্চি ঘরের কাচ্চির স্বাদটাই আলাদা।তাদের নিজস্ব অথেনটিক রেসিপি ফলো করে রান্না করা এই কাচ্চির স্বাদ নিতে প্রতিদিন ভীড় জমে যায় খুলনার ঐতিহ্যবাহী এই কাচ্চিঘরে।যেমন মনোরম পরিবেশ তেমনই সুস্বাদু খাবার।এখানে আসলে আপনি তৃপ্তি সহকারে পরিবার পরিজন নিয়ে খেতে পারবেন স্বাচ্ছন্দে।
কাচ্চি ঘর খুলনার রয়েলের মোড়ে অবস্থিত।
ভেজন প্রিয় বাঙালি একবার যেখানে কাবারের স্বাদ পেয়ে সন্তুষ্ট হয় বার বার সেখানে গিয়ে ভিড় জমায়।তাইতো এ দেশের প্রতিটি জেলার আনাচে কানাচে বিভিন্ন জায়গা তাদের নিজস্ব খাবারের রেসিপিতে বিখ্যাত। তেমনই খুলনার ভোজন রসিক বাসিন্দারা সুযোগ পেলেই চলে যায় নামকরা সব খাবারের দোকানগুলোতে বিখ্যাত সব খাবারের অথেনটিক স্বাদ নিতে।