আমাদের বাসা সাতক্ষীরা। অনেকদিন হলো বাইরে কোথাও পরিবারের সাথে ঘুরতে যাওয়া হয় না। তাই ভাবলাম এবার দূরে কোথাও যাওয়া যায় কিনা। কোথায় যাওয়া যায় এই নিয়ে আমরা একটি মিটিং বসালাম। আমার ছোট ভাই বলল কক্সবাজার যাবে আবার আমার আম্মু বলল সিলেট যাবে আবার আব্বু বলল রাঙ্গামাটি যাবে।
অনেক ভাবনা চিন্তার পরে আমরা খাগড়াছড়ি কে নিজেদের ভ্রমণকেন্দ্র হিসেবে বেছে নিলাম। আমার ছোট ভাই ও বোন অনেক খুশি হল কারণ অনেকদিন পর তারা কোথাও ঘুরতে যেতে পারছে। খাগড়াছড়িতে আমার এক চাচা থাকতেন আমরা তার বাসাতে গিয়ে উঠবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। শুক্রবার দুপুর একটার সময় আমরা আমাদের গাড়িতে উঠলাম।
ঈগল পরিবহন এর গাড়ি। তখন ছিল রোজার মাস। দিনটি ছিল 29 তম রোজা। বাসে প্রতি সিটের ভাড়া নিয়েছিল ১০০০ টাকা। আমরা পাঁচজন চারটি সিট নিয়েছিলাম 4000 টাকার বিনিময়ে। আমাদের বাসে একজন চাকমা উঠেছিল। জীবনে প্রথমবার আমি কোন চাকমা মানুষ দেখলাম।
খুবই ভালো লাগলো। আমাদের বাস ছাড়ল। বাসের সিট গুলো একটু চাপাচাপা ছিল বলে আমাদের বসতে অসুবিধা হচ্ছিল। বাস চলছে কিন্তু হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মাঝে যশোরে একটু বিরতি দেয়া হয়েছিল এবং সেখান থেকে আমরা কিছু খাবার কিনে নিয়েছিলাম ইফতারি করার জন্য। সেগুলো দিয়েই আমরা ইফতারি করে নিলাম কারণ ইফতারের জন্য আমাদের আলাদা করে কোন সময় দেওয়া হয়েছিল না।
তারপর আমাদের বাস আর কোন জায়গায় থামেনি যেতে যেতে রাত সাড়ে তিনটার দিকে সেহরির সময় হয়ে গিয়েছিল এই জন্য কুমিল্লায় একটি হোটেলে আমাদের সেহরির বিরতি দেয়া হয়েছিল। তবে সেই হোটেলে খাবারের মান ছিল যেমন খারাপ কিন্তু দামটা ছিল অনেক বেশি। তাই আমরা হোটেলের ভিতর থেকে খাবার না খেয়ে বাইরে একটা দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে সেহেরির কাজটা শেষ করলাম। যাইহোক পরের দিন সকাল আটটার দিকে আমরা খাগড়াছড়ি পৌছালাম।
আমাদের বাস লক্ষ্মীছড়ি মোড়ে দাঁড়ালো। আমরা বাস থেকে নামলাম তখন হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। দ্রুত একটি ইজিবাইকে ওঠে আমরা আমার চাচার বাড়ি গিয়ে উঠলাম। রাস্তা গুলো ছিল উঁচু-নিচু যেহেতু জায়গাটা পাহাড়ি রাস্তার ডান দিকে ছিল পাহাড় এবং বাম দিকে ছিল গভীর খাদ। খুবই সাবধানে আমাদের গাড়ি চলেছিল। চাচার বাড়ি রাত্রিটা কাটিয়ে পরের দিন আমরা রওনা দিলাম খাগড়াছড়ি হর্টিকালচার পার্কের উদ্দেশ্যে।
ওখানকার একজন চাচাতো ভাই আমাদেরকে গাইড করছিল। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন। প্রথমে আমরা একটি বাসে উঠলাম। বাসে ওঠে আমরা পার্কের উদ্দেশ্যে চলা শুরু করলাম। খুবই উঁচু-নিচু রাস্তা। আমাদের ভয় করছিল। বাস ভাড়া ছিল ২০ টাকা করে। খুবই সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলাম তাই দ্রুত আমরা পার্কে পৌঁছে গেলাম। পার্কে ঢুকলাম। টিকিটের মূল্য ছিল ৮০ টাকা করে।
আমরা ভিতরে ঢুকলাম। ভেতরেও বেশ কিছু পাহাড় ছিল এবং ভেতরের জায়গাটা বেশ বড়। পাহাড়ি সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা শহর খাগড়াছড়ির জিরো পয়েন্ট থেকে তিন কিলোমিটার দূরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ এর তত্ত্বাবধানে নির্মিত সবুজ বেশতো নিতে ঘেরা মনোরম সুন্দর পরিবেশে ভরা এই পার্কটি বিনোদনের একটি সুপরিচিত কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
এই পার্কে রয়েছে বেশ বড় এবং সুন্দর একটি ঝুলন্ত ব্রিজ। এছাড়াও ব্রিজের নিচ দিয়ে একটি লেক ও রয়েছে। লেকটি বেশ ভালই বড়। ঝুলন্ত ব্রিজে অনেক লোক সমাগম ছিল। অনেকে একসাথে ঝুলন্ত ব্রিজে উঠেছিল যে কারণে ব্রিজটা একটু বেশি দুলছিল। আমার ছোট ভাই বোন ব্রিজে উঠতে ভয় পাচ্ছিল। তাই তাদেরকে কোলে করে নিয়েই আমরা ব্রিজ এ হাঁটাহাঁটি করলাম।
সবাই খুব ভালোভাবেই উপভোগ করছিলাম। ব্রিজ থেকে লেকটা অসাধারণ লাগছিল। পার্কের পশ্চিম পাশ থেকে শহরের ভিউ টা ছিল অসাধারণ। আমরা বেশ কয়েকটি ছবিও তুলে নিলাম। একটা কথা বলে রাখা ভালো এই ব্রিজে উঠতে কোন টাকা খরচ করার দরকার পড়েনি। পার্কের একদিকে খুবই উঁচু একটি ওয়াচটাওয়ার রয়েছে। সেটি খুবই সুন্দরভাবে সাজানো। ওয়াচটাওয়ারের উপর থেকে দর্শণার্থীদের লক্ষ্য রাখা হচ্ছিল। এছাড়াও পার্কের মধ্যে রয়েছে ফুলবাগান,দোলনা এবং ফলের বাগান।
বেশ কিছু ভাস্কর্য রয়েছে। ভাস্কর্যগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। সেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই ছবি তুললাম। ভেতরে কিছু দোকান রয়েছে। আমরা সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। পার্কের ভেতরের দোকানের খাবারের মূল্য খুব বেশি ছিল না। তাই আমরা দুপুরের লাঞ্চ বেশ ভালোভাবে করতে পেরেছিলাম। খেতে খেতে চারিদিকে সৌন্দর্য দেখছিলাম। যেহেতু আমরা সাতক্ষীরাতে থাকি এরকম পাহাড়ি এলাকায় আগে আসা হয়নি তাই খুবই ভালো লাগছিল আশেপাশে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে।
দৃশ্য গুলো খুবই মনোমুগ্ধকর ছিল। আগে যেমনটি বললাম পার্কের ভেতরে বেশ অনেক জায়গা রয়েছে। এতটাই জায়গা ছিল যে আমরা ঘুরে সম্পূর্ণ পার্কটি শেষ করতে পেরেছিলাম না। বিকালের দিকে পার্কের ভেতরে বেশ কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গান বাজনা বাজানো হচ্ছিল। একটা জিনিস খেয়াল করলাম এই পার্কের ভেতরে তেমন কোনো রাইড ছিল না। তাই আমরা কোন রাইডে উঠতে পারলাম না।
বিকাল হয়ে আসছে তাই আমরা বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পার্কের পাশেই বেশ কিছু হোটেল গড়ে উঠেছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ওই হোটেল গুলোর ভাড়া আমার কাছে একটু বেশি মনে হচ্ছিল। প্রতি রাতের জন্য হোটেলের ভাড়া ছিল ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। সবগুলো হোটেলে প্রায় একই রকম ভাড়া। আমরা বিকালের একটু আগে আগে পার্ক থেকে বের হলাম।
আমার চাচাতো ভাই বললেন বাড়ি ফেরার আগে বিখ্যাত আলুটিলা গুহাটি দেখে যাওয়ার জন্য। এই আলুটিলা গুহাটির নাম অনেক আগে থেকে শুনে আসছি। আজ প্রথমবার সেখানে ঢুকবো ভেবে খুব উৎসাহিত ছিলাম। আমরা একই রুটের বাসে উঠলাম যেই বাসে করে আমরা পার্কে এসেছিলাম।
কিন্তু এবার আমরা আলুটিলা গুহার সামনে নেমে গেলাম। ভেতরে অনেক জায়গা। প্রবেশ মূল্য ছিল ১০০ টাকা। ভেতরে ঢুকেই আমাদেরকে বেশ অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছিল কারণ গুহাটি প্রবেশ মুখ হতে বেশ কিছুটা দূরে। তারপরও কষ্ট সত্ত্বেও আমাদের মাঝে যে আনন্দ ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল সে কারণে হাঁটার এই কষ্টটি একরকম দূর হয়ে গিয়েছিল।