খাওয়া পাগল বাঙালি জাতি শুধু ক্ষিদে পেলেই খায় না, বরং খাওয়ার ইচ্ছে হলেই আয়োজন করে বাহারি সব খাবারের। বৃষ্টি পড়লে খিচুড়ি, শীত পড়লে পিঠা-পায়েশ, শেষ পাতে দই-মিষ্টি এ যেন বাঙালির শখের খাবার। তাইতো বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাই তাদের নিজস্ব খাবারের ঐতিহ্যে বিখ্যাত। প্রত্যেকটি জেলারই আছে বিশেষ বিশেষ রন্ধনপ্রণালী ও ঐতিহ্যবাহী খাবার। তারই ধারাবাহিকতায় কুষ্টিয়া জেলাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। এই জেলার আছে নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবার।চলুন জেনে নেয়া যাক কুষ্টিয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত খাবার সম্পর্কে।
১. কুষ্টিয়ার তিলের খাজা
‘তিলের খাজা’ খাবারটির নামের সাথেই যেন কুষ্টিয়া জেলা জড়িত। কুষ্টিয়া জেলায় এই খাবারটির উদ্ভব হয়েছিল এবং এখনও পর্যন্ত এর ঐতিহ্য বহন করছে এই জেলা। তিলের খাজা চিনি, দুধ, তিল দিয়ে তৈরি একধরনের মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার। ছোট থেকে বড় সবারই খুব পছন্দের খাবার এই তিলের খাজা।
৪৬ বছর ধরে কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়া নামক স্থানের কয়েকটি কারখানায় তিলের খাজা তৈরি হয়ে আসছে। সারা বিকেল ও রাত জুড়ে তিলের খাজা তৈরির কাজ চলে এবং সকালে তা বিক্রির জন্য চালান করা হয় কুষ্টিয়া জেলা সহ বাংলাদেশের সব জেলায়।
বড় কড়াইয়ে দুধ,চিনি,পানি, এলাচ গুঁড়ো একসাথে জ্বাল করে পাতলা করে ঠান্ডা হওয়ার জন্য রাখা হয়। ঠান্ডা হলে আঠালো কাই তৈরি হয়। সেই আঠালো কাই আংটার সাথে আটকে টানা হয় বেশ কয়েক মিনিট ধরে। তার পর দুজন লোক দুই দিক থেকে টেনে টেনে লাম্বা করতে থাকে, আবার ভাজ করে টানা হয়। ফলে এর মাঝখানটা ফাপা হয়। এরপর নির্দিষ্ট সাইজ করে কেটে খোসা ছাড়ানো সাদা তিল চারপাশে ভরিয়ে প্যাকেটজাত করা হয়। দেখতেও হয় যেমন আকর্ষণীয় খেতেও খুব সুস্বাদু।
২. কুলফি মালাই
কুষ্টিয়ার কুলফি মালাই বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মানুষের কাছেই বেশ জনপ্রিয়। কুষ্টিয়া জেলার আশরাফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি এই মালাই প্রস্তুত করেন। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে আসা লোকজনের কাছে কুলফি মালাই বেশ প্রিয়।
বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় কুষ্টিয়ার বিখ্যাত এই কুলফি মালাই বিক্রি হয়।
কুলফি মালাই তৈরির মূল উপকরণ দুধ, কিচমিস, ডিম, কলা, বাদাম, বরফ ইত্যাদি। কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে তার মধ্যে মালাই, ডিম, কিসমিস, বাদাম দেয়া হয়। ঠান্ডা হলে কলা মিশিয়ে নির্দিষ্ট আকৃতির মালাই তৈরি করা হয়। কুলফি মালাই এর অনন্য স্বাদের জন্য এটি ছোট বড় সবার কাছেই খুব প্রিয়।
৩. মাসকলাই ডালের খিচুড়ি
বাঙালির খাদ্য তালিকায় খিচুড়ি একটি কমন খাবার। একটু কোনো উপলক্ষ পেলেই বাংলার ঘরে ঘরে রান্না করা হয় নানান স্বাদের খিচুড়ি। কুষ্টিয়া জেলার মাসকলাই ডালের খিচুড়ি এই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। মাসকলাই ডাল দিয়ে রান্না করা হয় বলে এর স্বাদ হয় একটু আলাদা।
মাসকলাই ডার এর সাথে সামান্য মসুর ডাল মিশিয়ে নেয়া হয়। তার সাথে চাল, পেয়াজ, আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ ও অন্যান্য মসলা মিশিয়ে হাড়িতে বসিয়ে দেয়া হয় খিচুড়ি। সিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত জ্বাল করে ঝরঝরে খিচুড়ি গরম গরম পরিবেশন করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, ডিম ভাজা দিয়ে পরিবেশন করা হয় মাসকলাই ডালের সুস্বাদু খিচুড়ি। বৃষ্টির দিনে গরম গরম খিচুড়ি খাওয়ার মজাই একেবারে অন্যরকম।
৪. ডালের বড়ি
কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার ডালের বড়ি। যে কোনো তরকারি, মাছের ঝোলের সাথে ডালের বড়ি খেতে দারুণ মজা। তাছাড়া ডালের বড়ির ভর্তাও বেশ ভালো লাগে। কুষ্টিয়া জেলার মানুষ মাসকলাই এর ডাল দিয়ে বড়ি তৈরি করে।
পাকা চাল কুমড়ো পাতলা করে কুচি করে রস ফেলে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া হয়। মাসকলাই ডাল বেটে তার সাথে পানি ঝড়ানো কাটা চাল কুমড়ো ভালোভাবে মিশিয়ে ছোট ছোট বড়ির আকার বানিয়ে রোদে শুকানো হয়। শুকনো বড়ি সংরক্ষণ করে বারোমাস বিভিন্ন তরকারির সাথে খাওয়া হয়।
ডালের বড়ি শুধু কুষ্টিয়াতেই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়ই খুব জনপ্রিয় একটি খাবার।
৫. শনপাপড়ি
কুষ্টিয়া জেলার আরও একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার শনপাপড়ি। কুষ্টিয়ার শনপাপড়ি পুরো বাংলাদেশে বিখ্যাত। এখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং এই মিষ্টান্নের কদর বেড়েছে দেশ ছেড়ে বিদেশেও। কুষ্টিয়ায় শনপাপড়ি তৈরির বেশ কিছু কারখানা আছে। প্রতিটি কারখানায়ি ১০/১৫ জন করে জনবল খাটে এবং এই কাজই তাদের একমাত্র জীবীকার মাধ্যম।
শনপাপড়ি তৈরির মূল উপকরণ চিনি। চিনি জ্বাল দিয়ে সিরা করে ট্রেতে ঠান্ডা হওয়ার জন্য রাখা হয়। অন্য একটি কড়াইয়ে ময়দা, সামান্য বেশন ও ডালডা হালকা ভেজে নিয়ে বড় চ্যাপ্টা পাত্রে ঢেলে নিয়ে তার ভেতর চিনির সিরা জমে যে ডো তৈরি হয়েছে তা নিয়ে নেয়া হয়। এরপর ৫/৭ জন লোক মিলে চিনির ডো কে টানতে টানতে ডো এর মধ্যে আশ ধরায়। এভানে টানতে টানতে ডো হালকা হয়ে সেমাই এর মতো হয়ে যায়। পুরো প্রসেসিং টা হয় কারিগরদের হাতের ছোয়ায়। ছোট ছোট কাপে ভরে প্যাকেট করে বাজারজাত করা হয় সুস্বাদু এই শনপাপড়ি।
৬. আনারসের খাট্টা
কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার আনারসের খাট্টা। কুষ্টিয়া জেলায় আনারসের ফলন বেশ ভালো হয়। তাই আনারসের সিজনে এই অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে আনারস দিয়ে। সেসব খাবারের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় খাবার হলো আনারসের খাট্টা।
পেয়াজ, গরম মসলা, চিনি ও আনারস দিয়ে এই খাবারটি তৈরি করা হয়। আনারস কেটে শিল পাটায় বেটে নেয়া হয়। কড়াইয়ে তেল পেয়াজ দিয়ে ভেজে আনারসের পেস্ট ও গরম মসলা দিয়ে রান্না করা হয় আনারসের খাট্টা। পাকা আনারসের ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ করতে থাকে। খেতেও হয় দরুন মজা।
৭. সেমাই সুজির ঝাল পিঠা
বিকেলের নাশতায় কুষ্টিয়ার মানুষের প্রথম পছন্দ সেমাই সুজির ঝাল পিঠা। বাড়িতে মেহমান আসলে মুখরোচক খাবার হিসেবে বানানো হয় এই খাবার। মিষ্টি ছাড়া পিঠা বলে খাওয়া যায় তৃপ্তি সহকারে। ছোট থেকে বুড়ো সবারই খুব প্রিয় খাবার এই সুজির ঝাল বরফি।
সেমাই সুজির ঝাল পিঠা তৈরি করা হয় সুজি,ডিম, পেয়াজ, মরিচ, সেমাই ও তেল দিয়ে। ডিম ভেঙে তার ভেতরে সুজি মেখে রেখে দেয়া হয় কিছুক্ষণের জন্য। তার মধ্যে পেয়াজ মরিচ মেখে বরফির আকারে কেটে নেয়া হয়। কেটে নেয়া বরফি ফেটানো ডিমে চুবিয়ে সেমাই গুড়ো দিয়ে কোটিং করে তেলে ভাজা হয়। গরম গরম মুচমুচে ঝাল পিঠা দিয়ে বিকেলের নাশতা বেশ জমে যায়।
৮. কাউনের চালের ক্ষীর
ক্ষীর তো সব জেলাতেই কম বেশি খাওয়া হয়। কিন্তু কুষ্টিয়া জেলার ক্ষীর এর বিশেষত্ব হলো – এই ক্ষীর তৈরি হয় কাউনের চাল দিয়ে। কাউন চালের ক্ষীরের স্বাদ অন্যান্য চালের থেকে একদমই ব্যতিক্রম।
হাঁড়িতে দুধ জ্বাল করে তার মধ্যে কাউন চাল দিয়ে ফুটতে থাকা পর্যন্ত জ্বাল করা হয়। চাল ফুটলে তার মধ্যে গুড়, দুধ, গরম মসলা দিয়ে রান্না করা হয় বেশ সময় নিয়ে।
এই ক্ষীর ঠান্ডা হলে খেতে বেশি ভালো লাগে।
৯. কই মাছের পাতুরি
কুষ্টিয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার কই মাছের পাতুরি। গরম ভাতের সাথে কই মাছের পাতুরি মাংসের স্বাদকেও হার মানায়।
কৈ মাছের সাথে শর্ষে বাটা, নারকেল বাটা, পেয়াজ বাটা, আদা বাটা, রসুন বাটা ও অন্যান্য মসলা মিশিয়ে রেখে দেয়া হয় কতক্ষণ। কুমড়ো পাতায় সেই মাছ পেচিয়ে সুতোয় বেধে সিদ্ধ করা হয়। পানি শুকিয়ে গেলে সুতা খুলে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয় মজাদার কই মাছের পাতুরি।
কুষ্টিয়া জেলার আরও কিছু জনপ্রিয় খাবারের তালিকা:
১. দই
২. বড় বাজারের চমচম
৩. কুমড়ো ভাপা চিংড়ি
৪. রুই মাছ দিয়ে ফুলকপি ও ডালের বড়ি
৫. লাহিনীর পোড়া রুটি
৬. পালং শাক দিয়ে মাসকলাই ডাল (ইত্যাদি)