মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাণের উৎসব কুরবানি। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের আশায়, ত্যাগের মহিমায় সামর্থ্যবান মুসলমানেরা পশু জবেহ করেন ও গরিব দুঃখী সহ আত্নীয় স্বজনদের মধ্যে ভাগ করে দেন সেই গোসত। বাংলাদেশে কুরবানিতে সাধারণত গরু জবেহ করার প্রচলন সবথেকে বেশি।
কুরবানি উপলক্ষে গরিব, ধনী, মধ্যবিত্ত সব ঘরেই কম বেশি মাংস খাওয়া হয়। কুরবানি যেমন মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব তেমনি বাঙালির সংস্কৃতির সাথেও নিবিড় ভাবে মিশে আছে এই উৎসবটি। কুরবানি উপলক্ষে ঘরে ঘরে খাওয়া দাওয়ার ধুম পড়ে যায় তখন। রান্না করা হয় নানা স্টাইলে নানা স্বাদের সব খাবার। আর সাধারনত বেশির ভাগ খাবারেরই মূল উপকরণ হয় গরুর মাংস।
চলুন জেনে নেয়া যাক কুরবানির ঈদের জনপ্রিয় ১০ টি খাবার আইটেম সম্পর্কে বিস্তারিত।
১. গরুর মাংস ভুনা
কুরবানির ঈদে গরুর মাংস ভুনা হয় না এমন মুসলমান পরিবার হয়তো বাংলাদেশে একটিও পাওয়া যাবে না। কুরবানির ঈদের সবথেকে কমন খাবার গরুর মাংস ভুনা।
পেয়াজ, আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ, গরম মসলা, তেল ও অন্যান্য মসলা একসাথে মেখে বসিয়ে দেয়া হয় গরুর মাংস। গরুর মাংসের মন মাতানো সুগন্ধে চারদিক ভরে যায়। আর কুরবানির গরুর মাংসের আলাদা একটা চমৎকার একটা ঘ্রাণ রয়েছে।
পোলাও, ভাত, খিচুড়ি বা রুটি সব কিছুর সাথেই গরুর মাংস ভুনা বেশ জমে যায়।
২. রুটি পিঠা
কুরবানির ঈদে গরুর মাংসের সাথে রুটি পিঠা খাওয়ার প্রচলন বাঙালির সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে। সকালে মাংস নিয়ে সব ব্যস্ততা শেষ করে বিকেল বেলা বাড়ির মহিলারা বসে পড়েন রুটি পিঠা বানাতে। সে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। ছোট বড় সবাই মিলে একসাথে আনন্দ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয়ে যায় গরম গরম চালের রুটি। চালের রুটির সাথে গরুর মাংসের ঝোল, সে যেন এক অমৃত।
চাল ভিজিয়ে রেখে শিল পাটায় বেটে চাল গুড়ো করে বানানো হয় চালের আাটার রুটি। বর্তমানে অবশ্য মেশিনেই ভাঙানো হয় আতপ চাল। সেই চালের গুড়ো সিদ্ধ করে বানানো হয় মজাদার চালের রুটি। গরুর মাংসের ঝোল দিলে যে কেউ অনায়াসে ৫/১০ টা রুটি খেয়ে ফেলতে পারে তৃপ্তি সহকারে।
৩. গরুর মাংসের বিরিয়ানি
কুরবানির মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না হবে না এ আবার কখনও হয় নাকি। দুপুরে পোলাও ও ভাত খেলে বিকেলের মেনুতে বিরিয়ানি থাকা চাই ই চাই। অথবা ঈদের দ্বিতীয় দিনও রান্না করা হয় গরুর মাংসের সুস্বাদু বিরিয়ানি।
আলাদা করে গরুর মাংস হলুদ ছাড়া ভুনা করে রাখা হয় একটি পাতিলে।
অন্য পাতিলে পোলাও রান্না করে তার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয় আগে থেকে ভুনা করে রাখা গরুর মাংস। এরপর কিছুক্ষণ দমে দিয়ে রাখলেই হয়ে যায় মজাদার গরুর মাংসের বিরিয়ানি। মাংস দিয়ে বিরিয়ানির রান্না করা হলেও অনেকেই আবার আলাদা করে গরুর মাংস ভুনা করে বিরিয়ানির সাথে খেতে পছন্দ করে। ঈদ স্পেশাল গরুর মাংসের এই বিরিয়ানি না হলে ঈদ কেমন অপূর্ণই থেকে যায়।
৪. গরুর শুকনা মাংস
কুরবানির ঈদ মানেই তো গরুর মাংসের বাহারি সব পদ। তেমনই গরুর মাংসের জনপ্রিয় একটি খাবার গরুর শুকনা মাংস। গরুর মাংস শুকিয়ে সংরক্ষণ করার প্রচলন সেই প্রাচীন কাল থেকেই। গরুর মাংস রোদে শুকিয়ে বয়ামে ভারে রেখে দেয়া যায় অনেকদিন।
সেই শুকনো মাংস ভুনা করলে খেতে দারুণ স্বাদ। শুকনে মাংস পানিতে ভিজিয়ে রেখে নরম করে নিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে নেয়া হয়। তারপর সব ধরনের মসলা দিয়ে ভুনা করা হয় শুকনো গরুর মাংস। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আগের বছরের সংরক্ষণ করে রাখা শুকনো গরুর মাংস রান্না করা হয় ঈদের দিন। ভাত, পোলাও বা খিচুরির সাথে খেতে একদমই অসাধারণ লাগে শুকনো গরুর মাংস।
৫. ছিট রুটি / ছিটা রুটি
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে খুবই প্রচলিত একটি খাবার ছিট রুটি। গরুর মাংস রান্না হলেই ভোজন রসিক বাঙালির চাই নানা বৈচিত্র্যময় খাবার। কুরবানির ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে ছিট রুটি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।
চালের গুড়ো, হালকা রসুন বাটা, একটা ডিম ডিয়ে পাতলা করে গোলা তৈরি করা হয়। মাটির খোলায় হাতের সাহায্যে ছিটিয়ে ছিটিয়ে গোলা ছাড়া হয়। হাতের সাহায্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোলা দেয়ার ফলে গোলাকৃতির জাল জাল পিঠা তৈরি হয়। হয়ে গেলে দুই ভাজ করে উঠিয়ে ফেলা হয় মজাদার ছিট রুটি পিঠা।
গরুর মাংসের ঝোলে ভিজিয়ে ছিট রুটি পিঠা খাওয়ার মজাই অন্যরকম।
৬. নেহারি
বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় একটি খাবার নেহারি। গরুর পায়া দিয়ে রান্না করা হয় এই খাবারটি। ছোট বড় সবারই নেহারি অত্যন্ত প্রিয় খাবার।
গরুর পায়ের চামড়া ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নেয়া হয়। মরিচ গুড়ো ও হলুদ গুড়ো বাদে সব ধরনের মসলা দিয়ে একটু ঝোল ঝোল করে রান্না করা হয় নেহারি।ঈদের পরের দিন বেশিরভাগ বাড়িতেই সকালের নাশতা হিসেবে নেহারি রান্না করা হয়।
৭. মাংস পুলি পিঠা / ভাজা পুলি
কুরবানির ঈদে বেশ কয়েকদিন ধরেই চলতে তাকে নানা রকম মুখরোচক খাবার তৈরির উৎসব। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভাজা পুলি বা মাংস পুলি খাওয়ার প্রচলন আছে।
মাংসকে একদম কিমা করে বিভিন্ন মসলা দিয়ে ভাজা ভাজা করা হয়। রুটি মতো করে চালের গুড়োর কাই করা হয়। তারপর ছোট ছোট রুটি বেলে তারমধ্যে মাংসের কিমা দিয়ে ডিজাইন করে চারদিক মুড়ে দেয়া হয়। এরপর ডুবো তেলে ভেজে গরম গরম পরিবেশন করা হয় মাংস পুলি পিঠা। মাংস পুলি পিঠা দেখতে হুবহু নারকেল পুলির মতো। কিন্তু স্বাদ একেবারেই ভিন্ন এবং অসম্ভব মজা।
৮. হালিম
কুরবানির ঈদের বিকেলের নাশতায় সবথেকে বেশি গুরুত্ব পায় হালিম। গরুর মাংস আর বোম্বাই মরিচ দিয়ে হালিম না খেলে পুরো ঈদ টাই যেন মাটি। কুরবানির ঈদের ঐতিহ্যের সাথে এই খাবারটি যেন মিশে আছে।
বিভিন্ন প্রকার ডাল,চালের গুড়ো ও মসলার সাথে গরুর মাংস দিয়ে রান্না করা হয় হালিম। রাঁধুনিদের ঝামেলা কমাতে এখন তো বাজারে কেনা হালিম মিক্স বেশি জনপ্রিয়।
বেশি করে মাংস দিয়ে গরম গরম হালিম সেই সাথে যদি থাকে পুরি বা লুচি তাহলে তো কোনো কথাই নেই।
৯. ঝুরা মাংস
কুরবানির ঈদে হিসেব করে মাংস রান্না করার প্রচলন কখনোই ছিল না। একসাথে বড় হাড়িতে বসিয়ে দেয়া হয় গরুর মাংস ভুনা। দেখা যায় এতো পরিমান মাংশ রান্না হয়ে যায় যে তা শেষ করতে দুই তিন দিন গেলে যায়। ফলে প্রতিদিনই দু একবার করে মাংস জ্বাল দিতে হয়। মাংস জ্বাল করতে করতে টুকরো গুলো একেবারে খুলে যায় এবং ঝুরা হয়ে যায়। মূলত এটাই হলো ঝুরা মাংস তৈরির অথেনটিক পদ্ধতি।
কিন্তু ঝুরা মাংসের স্বাদ ভুনা গরুর মাংসের থেকেও অনেক বেশি। ফলে এখন ইচ্ছে করেই রান্না করা হয় ঝুরা মাংস। বিভিন্ন মসলা দিয়ে মাংস সিদ্ধ করে ছিড়ে ঝুরা করা হয়। তারপর সব ধরনের মসলা দিয়ে সেই মাংস ভাজা ভাজা করলেই হয়ে যায় ঝুরা মাংস।
তবে এতে অথেনটিক স্বাদটা একদমই পাওয়া যায় না।
গরম গরম ভাত, সাথে ঝুরা মাংস আর পাতে এক টুকরো লেবু – এ যেন একেবারে সোনায় সোহাগা।
১০. টিকিয়া কাবাব
ঈদের দিন পোলাও সব বাড়িতেই একটি কমন খাবার। সেই পোলাওয়ের সাথে মুখরোচক খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয় টিকিয়া কাবাব। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের মানুষের পছন্দের খাবার এটি।
গরুর মাংস, বুটের ডাল সিদ্ধ করে বেটে তার সাথে পুদিনা পতা ও সব ধরনের মসলা মিশিয়ে ছোট ছোট গোলাকৃতির টিকিয়া ডুবো তেলে ভাজা হয়। পোলাওয়ের সাথে টিকিয়া কাবাব না হলে খাওয়া দাওয়া কেমন অসম্পূর্ণ মনে হয়।
কুরবানির ঈদে খাওয়া হয় এমন আরও কিছু খাবারের তালিকা:
১. বিভিন্ন স্টাইলে রান্না করা সেমাই
২. পায়েস
৩. জর্দা
৪. বিফ খিচুড়ি
৫. ছেচা কাবাব
৬. শিক কাবাব
৭. বিফ চাপ
৮. গরুর মাংসের কোড়মা
৯. গরুর মাংসের নরমাল কাবাব
১০. কালা ভুনা
১১. বিফ কোফতা কারি
১২. ভাপা গোস্ত পোলাও (ইত্যাদি)